প্রশাসনিক মেশিনারি ব্যবহার করে খোদ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে হিংসায় মদত দান, ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির অভিযোগ উঠছে। বলাই বাহুল্য রাজ্যটির নাম তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গ। বিশেষ পর্যবেক্ষক অজয় ডি নায়েকের মতে ১০/১৫ বছর আগে বিহারে এরকম পরিস্থিতি ছিল। তখন ওই রাজ্যেও নির্বাচনের সময় সবাই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলতো। শুধু মাত্র নির্বাচন ভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে বিশেষ পর্যবেক্ষকের বক্তব্যে কোনো ভুল নেই। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বলতে হবে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থা সুরাবর্দি শাসিত ৪৬ সালের অবিভক্ত বাঙ্গলার মতো। অথবা আটের দশকের ফারুক আবদুল্লা শাসিত কাশ্মীরের মতো। সে সময় ফারক আবদুল্লার মদতে জম্মু-কাশ্মীর সরকার এমন ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল যে ভূমিপুত্র কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ভিটে ছাড়া হতে হয়েছে, নৃশংস ভাবে খুন হতে হয়েছে। মা-বোনদের ধর্ষিতা হতে হয়েছে।
এরকম মনে হতে পারে নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, এই সময় অনেক ঘটনাই ঘটে। এই সমস্ত ঘটনাকে দেশভাগের বা কাশ্মীর পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা কি বাড়াবাড়ি নয় ? ঠাণ্ডা ঘরে বসে যারা লেখালেখি করেন তাদের কাছে এই ধরনের তুলনা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে নেমে এলে দেখা যাবে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা এবার কোনো ইসলামিক সংগঠন বা মুসলিম লিগের পতাকা নয়, মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলের পতাকা নিয়ে মুসলমানদের সঙ্ঘবদ্ধ ভোটদানের জন্য সক্রিয় ভাবে প্রচার করেছে, আবার যেখানে ক্ষমতায় কুলিয়েছে সেখানেই হিন্দুদের ভোট দানে বাধা দিয়েছে।
দেশভাগের সময় সিলেট জেলার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য যে নির্বাচন হয়েছিল তাতেও ঠিক এই ধরনের সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চোখে পড়েছিল। সে সময় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে কোনো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা থাকলে তার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য গণভোটের দাবি উঠেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম সিলেট জেলা। জিন্নাপন্থীরা দাবি তুললেন সিলেটের ভাগ্য নির্ধারণে গণভোট নিতে হবে। অসমের তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই দাবি মেনে নিলেন। ঠিক হয় ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই গণভোট হবে। এই ভোটকে কেন্দ্র করে মুসলিম লিগের গুন্ডারা দাঙ্গা বাঁধিয়ে এমন ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করল যে ভারতের পক্ষের ভোটদাতারা ভোটকেন্দ্রেই পৌঁছুতে পারলেন না। ভোটের দুই দিন সমগ্র সিলেট জুড়ে মুসলমান গুন্ডারা অবাধ রাজত্ব চালালেও কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বরদলই নেতত্বাধীন প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসন ছিল নির্বাক দর্শক। সিলেটের দু’ লক্ষ চা-শ্রমিক যারা অসম বিধান পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। মুসলিম লিগের পক্ষ থেকে তাদের ভোট দান থেকে বঞ্চিত রাখার দাবিও মেনে নেওয়া হলো। এক্ষেত্রে মুসলিম লিগের যুক্তি ছিল যে চা শ্রমিকরা ভাসমান নাগরিক, সিলেটের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের ভূমিকা থাকতে পারে না। সেদিনের সেই প্রহসনের গণভোটে ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে সিলেট পাকিস্তানে চলে গেল। সিলেটের পার্শ্ববর্তী জেলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কাছারে তখন মুসলমান গুন্ডাদের বলতে শোনা যেত ‘সিলেট নিলাম গণভোটে, কাছার নিমু লাঠির চোটে। বলা যায় এবারের লোকসভায়, এরকম একটি মহড়া হয়ে গেল। এই মহড়া সফল হয়ে গেলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গকে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
প্রথম দুই পর্বের নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভাবে জনজাগরণের কাজ ও ভোটকর্মী হিসেবে যুক্ত থাকার সুবাদে যে সমস্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আমার মনে হয়েছে যে এই নির্বাচন উপলক্ষে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য নয় সমস্ত দেশের জন্যই এক অশনিসংকেত। এবার ভোটের দামামা বেজে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, রায়গঞ্জ, উত্তর ও দক্ষিণ মালদা লোকসভা আসনগুলির প্রচার পর্বে যে বিষয়টি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো কিছু ব্যতিক্রম বাদে হিন্দু জনবসতিগুলি সেজে উঠে ছিল বিজেপির ফ্ল্যাগ ফেস্টুনে, আর মুসলমান মহল্লাগুলি তৃণমূলের।নমাজ সেরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে হোক কিংবা তৃণমূলের পতাকা হাতে নিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক প্রচারে হোক মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিজেপিকে একটি ভোট নয়, কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিজেপিকে ভোট দিতে পারে না— এক শ্রেণীর মুসলমান সর্বশক্তি দিয়ে এই ধরনের প্রচার চালিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে হিন্দু ভোটারদের শাসানো হয়েছে তারা যেন ভোটকেন্দ্রে না যায়। শাসানি অগ্রাহ্য করে যে সমস্ত এলাকায় হিন্দুরা ভোট দিতে গেছে সেখানে বোমা পড়েছে গুলি চলেছে। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে এরকম দু’চারটে ঘটনা সর্বসমক্ষে এসেছে। যেমন প্রথম দফায় কোচবিহার লোকসভার শীতলখুচি, দিনহাটা বিধানসভা এলাকায় অনেক বুথে হিন্দুরা ভোট দিতে যেতে সাহস পায়নি। একদিকে নির্বাচন কমিশন বুথ রক্ষা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা হাতে নিয়ে মুসলমান দুষ্কৃতীরা এলাকা দখল করতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে মানুষ অনেক আশা করেছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে, প্রত্যেকটি এলাকায় রুট মার্চ করে মানুষের আস্থা ফেরাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল রুট মার্চ তো দূরের কথা ভোটের দিন প্রত্যেকটি বুথেও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হলো না। তবে যেখানই সুযোগ পেয়েছে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে সেখানেই ভোট দিয়েছে।
সমগ্র ভারতেই লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনী হিংসা, বুথদখল, ছাপ্পাভোট ও অনিয়মের অভিযোগে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রমী রাজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় অবাধ এবং নিরিবচ্ছিন্ন ছাপ্পা প্রদানের জন্য তৃণমূলি লুম্পেন ও বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা উর্দিপরা পুলিশের যৌথবাহিনী এমন তাণ্ডব চালিয়েছে যে সাধারণ মানুষ বুথে মুখো হতে পারেনি। স্থানীয়রা প্রতিরোধ গড়ে কোথাও ভোট করালেও গণনা কেন্দ্রে ছাপ্পা চালিয়ে ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। যারাই এই অনাচারের প্রতিবাদ করেছে তাদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো থেকে শুরু করে নানা ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। ছাপ্পার প্রতিবাদ করায় রাজকুমার রায় নামে এক প্রিসাইডিং অফিসারকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ফলে এবার লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে উত্তাল হয়েছে। সমস্ত রাজ্যের ভোটকর্মীরা। লোকসভা নির্বাচনে ভোটকর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষক অধ্যাপক সরকারি কর্মচারীরা বুথের নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। আওয়াজ উঠেছে কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার— চাই না হতে রাজকুমার, উই ওয়ান্ট সেন্ট্রাল ফোর্স। অনেক জায়গায় ভোটকর্মীরা অবস্থান আন্দোলন, পথঅবরোধ, গণস্বাক্ষর সংগ্রহের মতো আন্দোলনেও শামিল হয়েছে। প্রতিবাদের ভাষায় ফুটে উঠেছিল রাজ্য প্রশাসন, রাজ্য পুলিশের উপর তীব্র অনাস্থার ছাপ।
গত ১৮ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা ভোটে রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের বেশ কিছু বুথে রাজ্য পুলিশ দিয়ে ভোট নয় বলে গ্রামবাসীরা ভোট কর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীদের বুথে প্রবেশ করতে দেয়নি। অবশেষে গ্রামবাসীদের দাবি মেনে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়নের করিয়েই ভোট করাতে হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় দার্জিলিং লোকসভার চোপড়ার কোটগাছ, দিঘি কলোনি বুথ এলাকায় বোমাবাজি, শূন্যে গুলিচালনা, ভোট দিতে ব্যার্থ ভোটারদের পথ অবরোধের ঘটনা, রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের ইসলামপুর বিধানসভার কয়েকটি বুথে ভোটারদের ভোট দানে বাধাদানকে ঘিরে তৈরি হওয়া উত্তেজনার দৃশ্য মানুষ দেখেছে। রায়গঞ্জ কেন্দ্রের ইসলামপুর বিধানসভা ক্ষেত্রের আগড়িমটিখন্তি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৪টি বুথেই এদিন অবাধ ছাপ্পা চালিয়েছে শাসক তৃণমূলের গুন্ডারা। অনেকের মতে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় রিগিং ছাপ্পার দৃশ্য যতটা ধরা পড়েছে বা প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিবেদনে যতটা রিপোটিং হয়েছে সেটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। ১১ এপ্রিল প্রথম দফাতেও কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের শীতলখুচি, সিতাই ও দিনহাটা বিধানসভা সভায় অনেক বুথেই রিগিং ছাপ্পার ঘটনা ঘটেছে। প্রথমদফায় ভোটকর্মীদের আলাপচারিতায় রিগিং ছাপ্পার যত ঘটনা শোনা গেছে সংবাদমাধ্যমে তার সিকি ভাগও আসেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এরাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের এতটা তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও লোকসভা নির্বাচনে সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হলো কেন? কেনই বা বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক বললেন কোনো রাজ্যের প্রতিটি বুথ সেন্সেটিভ হতে পারে না। বুথ সেন্সেটিভিটি নিয়ে এমন তালিকা করা তৈরি। হলো যে প্রথম দফায় ষাট শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী আর চল্লিশ শতাংশ বুথে রাজ্য পুলিশ। প্রথম দু’ দফা ভোটের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বলছে পঞ্চায়েতে যে সমস্ত বুথে বেশি গোলমাল হয়েছে অর্থাৎ যে সমস্ত এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস শক্তিশালী যে গুলিতেই রাজ্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যে সমস্ত বুথে রাজ্য পুলিশ মোতয়েন ছিল সেগুলির অধিকাংশতেই করানো হয়েছে ছাপ্পা ভোট অথবা ইভিএমের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট করানোর ঘটনা। যে সমস্ত এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস দুর্বল সেই সমস্ত বুথেনিযুক্ত হয়েছে কেন্দ্রীয়বাহিনী। প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি পর্যায়েই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। এর থেকে স্পষ্ট যে এই তালিকা রাজ্য প্রশাসনের মদতে তৃণমূল কংগ্রেসের রিগিং মেশিনারীর তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়েছে। প্রথম দফায় নির্বাচনের একদিন আগে জেলা পুলিশ সুপারকে সরানো হয়েছে ঠিকই তবে ফোর্স ডিপ্লয়মেন্ট তালিকার কোনো পরিবর্তন হয়েছে এমনটা কারো মনে হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের কাজে নিযুক্ত ডিএম। এসপিদের এই ধরনের ঘৃণ্য কাজের খোঁজ পেলেন না, নাকি সর্ষেতেই ভুত। এই সমস্ত বিষয়ই বিশদ তদন্তের দাবি রাখে। তবে একটি মত কিন্তু উঠে আসছে তা হলো এ রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন ছাড়া মমতা নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারকে ক্ষমতায় রেখে কোনো ভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
২০১৪ সালের তুলনায় সমস্ত ভারতেই ভোট পড়ার হার কম। কিন্তু ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ। তৃতীয় দফায় সারাদেশে গড়ে ৬৪.৬৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। এই জাতীয় গড়কে ছাপিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ভোট পড়ছে ৭৮.৯৮ শতাংশ। অতীতেও দেখা গেছে। ভোটপড়ার উচ্চহার সাধারণত বড়ো ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করে। যেমন ২০১৪ সালর লোকসভায় ভোট পড়ার উচ্চহার বড়ো পরিবর্তন ঘটিয়ে ছিল। সব মিলে বলা যায় পশ্চিমবঙ্গে এবারের ভোটকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা ও ভোট পড়ার উচ্চহার যে এরাজ্যে বড়ো পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী এবিষেয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সাধন কুমার পাল
2019-05-09