২ রা মে আমি যখন বাংলার নির্বাচনের ফলাফল টেলিভিশনের পর্দায় প্রকাশিত হতে দেখছিলাম, তখনই একটি সমান আকর্ষণীয় ট্রেন্ড সোশ্যাল মিডিয়াতেও লক্ষণীয় ছিল। আমার দক্ষিণ কলকাতার অনেক – প্রজনিত বাঙালি বন্ধু, যারা অন্যথায় অলস উইকএন্ডে অভিজাত স্কচে চুমুক দিত এবং রায়-ঘটক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে প্রাণবন্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ত, হঠাৎ করে তারা পোস্ট করা শুরু করল। সেই সময় আমার একটা কথাই মনে পড়ছিল, নিম্নপদস্থ সেনাপতিদের জন্য একটি স্লোগান … ”খেলা হবে”। সত্যি? কী হচ্ছে এটা? আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম। মজার বিষয় হল, বিজেপি যে হিন্দিভাষী নেতাদের সামনে এনেছিল, শহরের অভিজাতরা তাঁদের উদ্দেশ করে কুৎসা ছোঁড়ার পাশাপাশি মানুষের মনে উত্তর ভারত থেকে আসা কিছু কুখ্যাত গুণ্ডার ছবিও এঁকে দিয়েছিল।
এই সমস্ত বুদ্ধিজীবী এবং শান্তির ধ্বজাধারীরা যে কীভাবে “খেলা হবে” কথাটিতে সায় দিয়েছিলেন, যা কিনা আসলে বাংলার ভোট-পরবর্তী হিংসাকালে শুধুমাত্র একটি অশ্লীল যুদ্ধোল্লাসে পরিগণিত হয়েছিল। এটিই হল প্রথম প্যারাডক্স যা এই নির্বাচনকে চিহ্নিত করেছিল।
এই নির্বাচনের আর একটি কৌতূহলজনক ও মজার বিষয় হল বাম – কংগ্রেস – আইএসএফ জোটের সম্পূর্ণ নির্মূলকরণ ( একটিমাত্র আসন পেয়েছে এই জোট)। কিন্তু কেন এমন হল? এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, কট্টরপন্থী আলেম আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) সঙ্গে থাকায় ধর্মনিরপেক্ষ ভোট জোটের থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। তবে তা ভুল যুক্তি বলে মনে হচ্ছে। শহরের বেশিরভাগ নির্বাচনী এলাকা (কলকাতা এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা), যেখানকার বেশিরভাগ মানুষ এক মেরুরই বাসিন্দা, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের একক আধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কেন? তার উত্তর লুকিয়ে আছে বাংলার এক বৃহৎ ভদ্রমণ্ডলীর উদ্যোগে দিকে দিকে ‘বিজেপিকে একটাও ভোট নয়’ প্রচার অভিযান।
কিন্তু, এই প্রচারের ভিত্তি কী? বহু ব্যবহৃত অথচ স্বল্প উপলব্ধ শব্দ – “ফ্যাসিবাদ”। মোদীকে হিটলার-সমতুল্য “ফ্যাসিবাদী” হিসাবে চিত্রিত করা এবং তার ফলে বাংলায় বিজেপির পায়ের তলার মাটিকে শক্ত হওয়া থেকে আটকানোই ছিল এহেন প্রচারের একটা অঙ্গ বলে মনে হয়। এবং বাম ঘ্যাঁষা “ভদ্রলোক”ও এই প্রচারণার ফাঁদে পা না দিয়ে পারেননি।
আর ভোটের পরে যা ঘটল তা হল নারকীয় হত্যালীলা। ফল ঘোষণার ঠিক পরেই টিএমসি ক্যাডাররা গণহত্যার নেশায় উত্তাল হয়ে বাংলায় রক্তবন্যা বইয়ে দিল। হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ধ্বংসাত্মক মহামারীর সময়ে এই নির্মম গণহত্যায় অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। এবং আতঙ্কিত হয়ে আছেন অগণিত মানুষ। “বিজয়ী”-র ক্রোধের মুখোমুখি হয়েছিল যারা, তারা সবাই কি বিজেপির সমর্থক? অবশ্যই না। বাম দলের কর্মীদেরও হত্যা ও গণধর্ষণের পরে অনেক জেলায় সিপিআইএম-এর দলীয় কার্যালয়ও পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। তবে “ভদ্রলোকেরা” এখন নীরব আছেন। গণতন্ত্রের এই নিরঙ্কুশ বিদ্রূপের বিরুদ্ধে তাঁরা আওয়াজ তুলবেন বলেও মনে হয় না। এই নীরবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানের কথা, চীনে বসবাসকারী উইঘার মুসলিমদের প্রতিনিয়ত জাতিহত্যার শিকার হতে দেখেও তারা যেমন রা কাড়ে না।
স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য দ্বিতীয় আকর্ষক প্যারাডক্সটি হল হঠাৎ করে মাতৃভাষার প্রতি উগ্র প্রেমের নাটকীয় ব্যবহার। মানে, টিএমসির প্রচারে গলাফাটানো স্লোগান “বাংলা নিজের মেয়েকে চায়” থেকে কি জেনোফোবিয়ার দুর্গন্ধ ভেসে আসে না? কেউ কি ভাবতে পারেন, কেন এটা কেবল ভাষাগত ত্রুটি? অন্যান্য জাতিগত পরিচয়ের চিহ্ন কেন প্রাধান্য পায় না? উদাহরণস্বরূপ, লাতিন আমেরিকাকে দেখুন। প্রায় সমস্ত লাতিন আমেরিকান দেশে স্পেনীয় ভাষা সরকারি ভাষা হলেও সেটি কি একচেটিয়া একত্রীকরণের শক্তি হিসাবে সেখানে কাজ করে? তাহলে তো সেই দেশগুলির পৃথক অস্তিত্বই ধ্বংসের মুখে পড়বে।
লাতিন আমেরিকা গত ১০০ বছরে চারটি বড় সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে, সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি হল, ইকুয়েডর এবং পেরুর মধ্যে ঘটা ১৯৯৪-৯৯ সালের সেনেপা যুদ্ধ। বাংলার ক্ষেত্রে, বেশ কৌতূহলজনক হল, যে বাঙালি “ভদ্রলোক” আনন্দের সঙ্গে এবং বেশ নির্লজ্জভাবেই ‘উত্তর ভারতীয়রা গতানুগতিকভাবে হিন্দি আধিপত্যের পতাকাবাহী’ বলে মেনে নিয়েছেন এবং তাদের গায়ে “বহিরাগত ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছেন, সেই ভদ্রলোকের চোখেই, কোনও বাঙালি ব্রাহ্মণ মহিলার (যেমন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী) হিজাব পরা ছবি দেখে বিস্ময়ের এতটুকু আভাস পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। এই আরবীয় প্রভাব তাকে উত্তেজিত করে না। তার নারীবাদী আদর্শকেও উপহাস করে না এই ছবি, যখন একজন হিন্দু বাঙালি এমন এক পোশাক পড়ে জনসমক্ষে আসেন যার মতো ভিনদেশী আর পশ্চাদগামী রুচির উদাহরণ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। “জয় শ্রী রাম” ওঁদের কাছে বহিরাগত কিন্তু “ঈদ মোবারক” নয়। আমাদের প্রতিবেশী একাধিক রাষ্ট্রের আদর্শের তুলনায় কীভাবে এই আরবি প্রতীকগুলি আমাদের হৃদয় কেড়ে নিল?
আসুন বাংলার ইতিহাসের আলোকে এই ‘বহিরাগত’ শব্দটির ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বাধীন দিল্লি সুলতানির শাসনভার গ্রহণের আগে ১২০৪ সাল অবধি ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গদেশ হিন্দু রাজা দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। পাল ও সেন রাজবংশগুলির রাজত্বকালে সংস্কৃত সাহিত্য প্রচুর সমৃদ্ধ হয়েছিল। প্রায় সমগ্র বঙ্গই শৈব ও বৌদ্ধধর্মের চর্চা করত। বখতিয়ার খিলজির রক্তাক্ত বিজয় এবং পরবর্তীকালে মোগল আধিপত্য বাঙালি নীতিবোধকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্মূল করার প্রয়াস করেছিল। সহিংস অত্যাচারী বিজয়ীদের দেখানো ভয় এবং তার ফলে অবচেতনভাবে তাদের আচারের গ্রহণযোগ্যতা এত গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছিল যে, ১৭৫৭-সালে সিরাজ-উদ-দৌলা পলাশীর যুদ্ধে হেরে গেলে, বাঙালি ঐতিহাসিকরা এটিকে বঙ্গদেশের “স্বাধীনতার” হার হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। এটা কি সত্যিই তাই ছিল? এটি আসলে একটি ঔপনিবেশিক শক্তি অন্য একটিকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। আফগান ও মধ্য এশীয়রা যারা ৫৫৩ বছর ধরে (১২০৪ – ১৭৫৭) বাংলায় শাসন করত তারা কোনওভাবেই বাংলার মূল নীতিগুলির অংশ ছিল না। তারা ব্রিটিশদের মতোই “বহিরাগত” ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অতীত আমাদের মুখের মধ্যে যদি খারাপ স্বাদ এনে থাকে, তবে কেন আরবি পরিচয় ও প্রতীকগুলির প্রতি আমাদের এত প্রগাঢ় ভালবাসা, যারা কিনা আসল হানাদারদের জাজ্বল্যমান প্রতীক, যে হানাদাররা বাঙালির ঘরে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল, বাঙালিকে নিপীড়ন করেছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিগুণ সময় আমাদের শাসন করেছিল?
তো এখান থেকে আমরা কোন দিকে যাব? বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী?
যদিও মনে হয় বিজেপি কেবলমাত্র ৭৭ টি আসনে জয়লাভ করেছে, তবে এই সংখ্যাগুলির মধ্যে অবশ্যই লক্ষ্য করার মতো কিছু বিষয় আছে। প্রায় ৩০ টি আসনে মার্জিন কিন্তু খুবই কম। এই ভোট পরবর্তী হিংসা কি যথেষ্ট সন্ত্রাস তৈরি করবে যাতে মানুষ বিজেপির পতাকা (বা বাম / কংগ্রেসের) হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়? আমি বিশ্বাস করি যে, এটা নির্ভর করছে নির্লজ্জ রাজনৈতিক হিংসার শিকারদের পুনর্বাসিত ও সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রের গৃহীত পাল্টা পদক্ষেপের উপর। অন্যথায়, এটি প্রকৃতপক্ষে মনোবল নষ্ট করে দেবে, তখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে গণ-সংহতি গড়ে তোলা সত্যই কঠিন হয়ে উঠবে, যার ফলস্বরূপ প্রকাশ্যে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ হবে।
“ফ্যাসিবাদ ..” মনে আছে? তবে, এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে টিএমসি একটি একক নেতৃত্বাধীন দল। বাম এবং কংগ্রেস বাংলায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও আমি তাদের পুনরুত্থানের কোনও আশা দেখছি না। সেটার উপর ভিত্তি করে, বিজেপি সমর্থকদের আশাবাদী হওয়ার সমস্ত রকম কারণ আছে। এবং তার ফলে দলীয় কর্মীরা নিজেদের দেহেও মনে কিছুটা জোর অবশ্যই টেনে আনতে পারবে… অন্ধকার গুহার শেষে কিছুটা আলোর আশা অবশ্যই আছে। আছেই।