(অক্টোবর ২১, ১৯০০ – ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮)
লীলা রায়ের জন্ম ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ২১ শে অক্টোবর। বাঙালি সাংবাদিক, জনহিতৈষী এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন। তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী ছিলেন।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
লীলা নাগ আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ অবসর প্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তার পিতৃ-পরিবার ছিল তৎকালীন সিলেটের অন্যতম সংস্কৃতমনা ও শিক্ষিত একটি পরিবার। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগ বিয়ে করেন বিপ্লবী অনিল রায়কে। বিয়ের পর তার নাম হয় লীলা রায়।
শিক্ষাজীবন
তাঁর ছাত্রজীবন শুরু হয় ঢাকার ইডেন স্কুলে। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল়য়ে ইংরেজি বিষয়ে এমএ ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রীধারী। তখনকার পরিবেশে সহশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলে লীলা রায়ের মেধা ও আকাঙ্খা বিচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চান্সেলর ডঃ হার্টস তাকে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন।
শিক্ষা বিস্তার
লীলা নাগ ঢাকা কলেজে পড়তেন। তার এক ক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তার স্মৃতিকথা নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, এঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের পন্থা উন্মুক্ত করে দেন।”
বাঙালি নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তিনি বিশেষ ভুমিকা পালন করেছেন। তিনি ঢাকার আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় (তৎকালীন নারী শিক্ষামন্দির) প্রতিষ্ঠাকরেন। ভারত বিভাগের পর লীলা নাগ কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে ও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৯২৩ সালে লীলা রায় ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে কৃতিত্বের সাথে এম. এ. পাশ করেন। পরীক্ষা পাশের পর বাংলার নারী সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন অভিশপ্ত জীবনে জ্ঞানের আলো বিকিরণের উদ্দেশ্যে ১২ জন সাথী নিয়ে গড়ে তোলেন ‘দীপালি সংঘ’।
মেয়েদের প্রতি অন্যায় অবিচার, অসম্মানের বিরুদ্ধে তাঁর চিরদ্রোহী মন ধীরে ধীরে অনিবার্যভাবে প্রসারিত হয় মাতৃভূমির পরাধীনতার পুঞ্জীভূত অবমাননা ও বেদনার অবসান সংকল্পে।
রাজনীতি
১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস ও বাংলার বিপ্লবী দলগুলো সুভাষচন্দ্রের চারপাশে সমবেত হতে থাকে। সহকর্মীদের সাথে অনিল রায় ও লীলা রায়সেখানে উপস্থিত হন। লীলা রায় তখনও বিপ্লবী দলের নেপথ্যে। নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনে বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস উপস্থাপনের সময় লীলা মঞ্চে উঠেন। বিপ্লবী দলে যোগদানের পথ এরই মধ্য দিয়ে প্রশস্ত হয়।
এর ক’ বছরের মধ্যে দীপালি সংঘের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। দলে দলে মেয়েরা এর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। বিপ্লবী নেত্রী লীলা রায়ের কাছে দলের ছেলেরাও আসেন নানা আলোচনার উন্মুখতা নিয়ে। নেত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে গণ আন্দোলনের সম্পর্ক ছিল। দীপালি সংঘ ছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন অনিল রায়ের শ্রীসংঘের সাথে। শ্রীসংঘে যোগদানের পর বিপ্লবী আন্দোলনেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যান প্রথম সারিতে। ১৯৩০ সালে বাংলার সব বিপ্লবী দলের নেতৃস্থানীয়দের ইংরেজ সরকার একযোগে গ্রেপ্তার শুরু করলে অনিল রায় ও তাঁর সহকর্মীরাও গ্রেপ্তার হন। তখন শ্রীসংঘের সর্বময় নেতৃত্বের দায়িত্ব লীলা রায়ের কাঁধে বর্তায়।
শ্রীসংঘের সদস্যরা সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনা করার জন্য অস্ত্রসংগ্রহ ও বোমা তৈরী করেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার জন্য লীলা রায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ইন্দুমতি সিংহ কে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে দেন। সূর্যসেনের পরামর্শে প্রথম নারী বিপ্লবী শহীদ প্রীতিলতা দীপালি সংঘের সদস্য হয়ে বিপ্লবী জীবনের পাঠ নিয়েছিলেন লীলা নাগের কাছে।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর দুর্ধর্ষ রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের পর বিপ্লবীদের কার্যকলাপ আরো জোরদার হয়। ১৯৩১ সালের এপ্রিলে বি.ভির সদস্যদের গুলিতে পরপর ৩ জন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং আলিপুরের জেলা জজ গার্লিক ও কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সর নিহত হন। ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সের হত্যাকান্ডের সাথে দু’জন তরুণী জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ তৎপরহয়েউঠে। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর দীপালির প্রদর্শনীর কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পর লীলা নাগকে গ্রেপ্তার করা হয়।
লীলা রায় ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক প্রথম নারী রাজবন্দী। লীলা রায়ের গ্রেপ্তারের পর তাঁর অনেক নারী সহকর্মী গ্রেপ্তার ও বন্দী হন। কেউবা বাংলাদেশ থেকে বহিস্কৃত হন। জেলে গিয়ে লীলা নাগ দলীয় কর্মীদের দলের সাংগঠনিক সঙ্হতিকে বৈপ্লবিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড করার নির্দেশ দেন। নেত্রীর নির্দেশে এই কাজের দায়িত্ব কাঁধে নেন অনিল দাস।
১৯৩৬ এর সাধারণ নির্বাচনে ঢাকার নারী কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীরূপে তিনি মনোনয়ন পান। কিন্তু ভোটার তালিকায় নাম না থাকায় তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। তাঁর পরিবর্তে হেমপ্রভা মজুমদার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
১৯৩৭ এর অক্টোবরে লীলা রায় কারামুক্ত হন। কারামুক্তির আগেই অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে তাঁর গোপন যোগাযোগ হয়। ফলে বাইরের পরিস্থিতি তিনি কিছুটা আঁচ করতে পারেন। ৮ অক্টোবর তাঁর কর্ম তৎপরতাআগেরমতোশুরুহয়েযায়।
লীলা রায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেত্রী ছিলেন। এজন্য কয়েকবার তাঁকে কারা বরণ করতে হয়। তিনি নারী সমাজে মুখপাত্র হিসেবে “জয়শ্রী” নামে একটি পত্রিকা বের করেন। লীলা রায় ছবি আঁকতেন এবং গান ও সেতার বাজাতে জানতেন।
মৃত্যু
১৯৬৬ সাল থেকে লীলা রায়ের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে থাকে। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁকে পি.জি. (বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও বাকশক্তি ফিরে আসেনা। ডানদিক সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। ৪ আগস্ট শেষ সেরিব্রাল আক্রমনে তাঁর সংজ্ঞা লোপ পায়। আড়াই বছর সংজ্ঞাহীন থাকার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন ভারতে এই মহিয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।