সম্প্রতি সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে ৮ জানুয়ারি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ যখন দেশের জন্য নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল ২০১৬ আবার সংসদে পেশ করেন তখন দেখা গেল সরকার বিরােধী দলগুলি বিশেষ করে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, তৃণমূল দলের সাংসদরা যথারীতি সেকুলারিজমের দোহাই দিয়ে মানবতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সংসদ কক্ষ থেকে ‘ওয়াক আউট’ করলেন। কিন্তু ওয়াক আউট করার আগে এঁরা ‘সেকুলারিজম’ ‘মানবতা’ ইদ্যাদি নিয়ে এমনসব ভাষণ দিলেন, মনে হলাে এঁরা যেন সবাই এক একজন মহামতি বুদ্ধ। কিন্তু ভােটের কারণে মুসলমানদের তােষণ করা বা পার্শ্ববর্তী দেশগুলাে থেকে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে আশ্রয় দেওয়ার জন্যই যে তাঁদের এত উদ্বেগ ও আকুলতা এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ এই দলগুলির সবাই ‘মুসলমান ভােটব্যাঙ্ক’-এর দৌলতে ভােট বৈতরণী পার হতে চায়। কথা হলাে এদের ভণ্ডামি আর কতদিন মেনে নেবে দেশবাসী?
‘দি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫’ অনুযায়ী, বৈধ পাসপাের্ট ছাড়া কোনাে বিদেশি নাগরিক যদি ভারতে আসেন বা অনুমােদিত সময়ের অতিরিক্ত সময় ধরে যদি ভারতে বসবাস করেন তবে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু নরেন্দ্র মােদীর নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের প্রতিশ্রুতিমতাে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই নাগরিকত্বের সংশােধনী বিল সংসদে পেশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যাতে প্রস্তাব করা হয়— পাকিস্তান, বাংলাদেশে, আফগানিস্তান থেকে ৩১.১২.২০১৪ সালের আগে যেসব হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি এবং খ্রিস্টান লােকেরা ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন এবং ভারতে বসবাস করছেন তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা হবে না, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে যদি তারা ভারতে ৬ বছর ধরে বসবাস করে থাকেন। কারণ নিকট অতীতে উক্ত দেশগুলি ভারতেরই অংশ ছিল এবং ধর্মীয় কারণে উক্ত দেশগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে ইসলামিক রাষ্ট্র হয়েছে। ইসলামিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উক্ত দেশগুলিতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোনাে জায়গা নেই এবং তারা অমানুষের মতাে অত্যাচারিত হয়। কট্টর ইসলামপন্থীদের আর একটা উদ্দেশ্য হলাে অমুসলমানদের অত্যাচার করে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা এ ব্যাপারে মেয়েদের সফট টার্গেট করে। এই সমস্ত কারণে উক্ত ইসলামিক দেশগুলি গঠন হওয়ার পর থেকে বছরের পর বছর ধরে ওই সমস্ত দেশের সংখ্যালঘুরা অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি, খ্রিস্টানরা ভারতে চলে এসে বসবাস করছেন। কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব দানের ব্যাপারটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। কারণ সেকুলারবাদীদের বক্তব্য হলাে এভাবে সেকুলার ভারতে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না, তাহলে ওইসব দেশ থেকে আসা মুসলমানদেরও নাগরিকত্ব দিতে হবে। কথা হলাে, ইসলামের কানুন পুরােপুরি মেনে চলার তাগিদে হিন্দুদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতে পারবে না বলে ৯৫ শতাংশ মুসলমানই আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছিল বলেই ভারত ভাগ হয়েছে। হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শিরা ভারত ভাগ চায়নি। তারা ভারতের নাগরিক হয়েই থাকতে চেয়েছিলেন। পূর্ববর্তী কংগ্রেস কমিউনিস্ট নেতাদের সংকীর্ণ রাজনীতির কারণে দেশভাগের ফলে তাদের আদিবাসস্থান ভাগ্যের ফেরে উক্ত ইসলামিক দেশগুলির অংশীভূত হয়ে যায়, যার উপর এইসব মানুষগুলির কোনাে হাত ছিল না। তারা এখন ধর্মীয় বিদ্বেষের বলি হচ্ছেন। উক্ত দেশ থেকে আসা মুসলমানরা কিন্তু ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে পালিয়ে আসা লােক নয়। তারা ভারতে এসেছে বা আসছে এদেশের নানারকম সুযােগসুবিধা ভােগ করার আশায় ভারতের মানুষের সম্পদের উপর ভাগ বসাবার জন্য তারা অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু ভণ্ড সেকুলারবাদীরা ঐতিহাসিক সত্যকে মান্যতা না দিয়ে মুসলমান ভােটব্যাঙ্ক ব্যাবহার করার লালসায় সেকুলারবাদের মােড়কে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না বলে সংসদে হৈচৈ করে বিলটিকে পাশ করতে চায়নি। লােকসভায় এনডিএ সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় বিলটি পাশ করে দেয়; কিন্তু রাজ্যসভায় উপযুক্ত গরিষ্ঠতা না থাকায় বিলটি পাশ হয়নি। বিলটিকে জে পি সি তে পাঠানাে হয়।
জে পি সি থেকে রিপাের্ট আসার পরে এই শীতকালীন অধিবেশনে ৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার নাগরিকত্ব সংশােধনী বিলটি সংসদে পেশ করেন। যথারীতি ভণ্ড সেকুলারবাদী নেতারা জ্ঞানগম্ভীর বক্তৃতা দিয়ে বিলের বিরােধিতা করে সংসদ ছেড়ে বেরিয়ে যায়, যা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। এবারেও এনডিএ-র সংখ্যাধিক্যের কারণে লােকসভায় তা পাশ হয়ে যায়। কিন্তু রাজ্য সভায় উপযুক্ত সংখ্যা না থাকায় এবং বিরােধীদের চক্রান্তের কারণে অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয় জুড়ে ব্যাপক গােলমালের জেরে বিলটি রাজ্য সভায় পেশ করা যায়নি। অর্থাৎ এবারেও ঝুলে রইল নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল। এখানে উল্লেখ্য, শুধুমাত্র নাগরিকত্বের ব্যাপারে বিলের সংশােধন করলেই সমস্যার পুরােপুরি সমাধান হবে না। এর সঙ্গে সঙ্গে এন আর সি অর্থাৎ ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনের কাজ বা সঠিক নাগরিকদের চিহ্নিত করে নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজটিও সারা দেশ জুড়ে অনতিবিলম্বে করতে হবে। এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলি থেকে যে সব মুসলমান আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে এদেশের জনগণের সম্পদের উপর ভাগ বসাচ্ছে এবং এদেশের নিরাপত্তার ব্যাপারটিকেও যথেষ্ট উদ্বেগের মুখে ঠেলে দিছে দেশের জনবিন্যাসের (ডেমােগ্রাফির) ভারসাম্যকে বিপজ্জনকভাবে নষ্ট করছে তার বিরুদ্ধে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
সরকারকে এই সমস্ত ব্যাপারে যথাযথ ভাবে আইন প্রণয়ন করে এবং তার সঠিক প্রয়ােগ করে দেশের জনসাধারণের স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে হবে। নেতাদের এই নিয়ে ভােটের জন্য নােংরা রাজনীতি করলে হবে না। জনসাধারণকেও এ ব্যাপারে সতর্ক এবং সচেতন হতে হবে। তারা যেন এ বিষয়টির গুরত্ব অনুধাবন করে ভণ্ড রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁদে পা না দেন। এঁদের ভণ্ডামির জন্য যে দেশের ‘ডেমােগ্রাফি’র ভারসাম্য ভীষণভাবে নষ্ট হচ্ছে এবং যে কারণে ভারত বিভক্ত হয়েছিল সেই কারণ যে আবার ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছে তা যদি দেশবাসী দ্রুত উপলব্ধি করতে না পারেন তবে ভারত আবার বিভাজনের দিকে যাবে।
সূক্ষ্মভাবে তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এইসব অনুপ্রবেশকারীরা একটি দীর্ঘকালীন ইসলামিকরণের পরিকল্পনা নিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে। এরা ভারতের জনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে মুসলমানের সংখ্যাধিক্যের জোরে এ দেশে আবার ইসলামের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। ইসলামের ইতিহাস ভালােভাবে অনুধাবন করলে এ সত্যটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ৪টি মহাদেশ জুড়ে, ১৪০০ বছরে ৫৭টি ইসলামিক দেশ এ ভাবেই গঠিত হয়েছে। তারা জোটবদ্ধ হয়ে তৈরি করেছে ও আই সি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন)। এনডিএ-র শরিক রাজনৈতিক দলগুলি, যারা নাগরিক সংশােধনী বিল, এন আর সি এইসব চালু করার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন, তাদের উচিত জনসাধারণকে এ ব্যাপারে ভালােভাবে সচেতন করা। এ ব্যাপারে গণ-আন্দোলন গড়ে তােলা। কারণ দেখা যাচ্ছে বিরােধীরা ভােটের ফয়দা তােলার জন্য এ ব্যাপারে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে। এ ব্যাপারে গত ডিসেম্বরে মেঘালয় হাইকোর্টের বিচারপতি জাস্টিস সুদীপরঞ্জন সেন নাগরিক পঞ্জিকরণ সংক্রান্ত একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে নির্ভীক ভাবে যা বলেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেছেন—এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছে। মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতে পারবে না এই যুক্তিতেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য দেশ ভাগ করে আলাদা দেশ পাকিস্তান গঠন করেছে। স্বাভাবিক যুক্তিতেই ভারতবর্ষের হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া উচিত ছিল।
যাইহােক ভারতবর্ষের সেকুলারিজমের মর্যাদা দিয়ে তিনি বলেছেন যে— নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উক্ত ঐতিহাসিক সত্যটিকে আমাদের মাথায় রাখা উচিত এবং ভারত ভাগের ফলে যে সমস্ত হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পার্শি, খাসিয়া, জন্তিয়া, গারাে ইত্যাদি সম্প্রদায়ের অমুসলিম মানুষেরা ধর্মীয় নিপীড়নের স্বীকার হয়ে বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছে। তাদের এদেশে কোনাে ভিত্তিবৰ্ষ বিচার না করেই নাগরিকত্ব দিতে হবে এবং তার জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন— দেখা যাচ্ছে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা নানারকম ডকুমেন্ট জোগাড় করে এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে যাচ্ছেন কিন্তু যথার্থ কারণে যেসব অমুসলমানদের এদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা তারা নানা আইনি জটিলতার কারণে নাগরিকত্বের ব্যাপারে আটকে যাচ্ছেন। এটা খুব বিপজ্জনক। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন— “Nobody should try to make India another Islamic Country, otherwise it will be a doomsday for India and the world.”
কথায় আছে ‘পাগলও তার ভালােটা বােঝে’। কিন্তু আমরা কেন এখনাে আমাদের ভালােটা বুঝে উঠতে পারছি না? আমরা কি পাগলেরও অধম?
প্রণব দত্ত মজুমদার