হরিনাথ দে (জন্ম ১২ ই আগস্ট ১৮৭৭ – মৃত্যু ৩০ আগস্ট ১৯১১) ছিলেন একজন বহুভাষাবিদ বাঙ্গালী পণ্ডিত। তিনি এশিয়া ও ইয়োরোপের বহুসংখ্যক ভাষায় পারদর্শিতা অর্জ্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বয়স ৩০ পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি পৃথিবীর ৩৪টি ভাষা আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। জীবিকা সূত্রে তিনি কোলকাতা ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমানে ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
হরিনাথ তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা রাইপুর হাই স্কুলে শেষ করে কলকাতা যাত্রা করেন পরবর্তী পড়াশোনার জন্য। কলকাতা এসে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে পড়েন এবং স্কুলের পাঠ শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে হরিনাথ প্রেসিডেন্সির ছাত্র হিসেবেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাটিন ও ইংরেজি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে ষান্মানিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ওই বছরই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাটিন ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ড যান কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য। সেখানে ক্রাইস্ট’স কলেজে ভর্তি হন। কেম্ব্রিজে পড়ার সময়েই হরিনাথ গ্রীক ভাষায় এম.এ.-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে। এর পর হরিনাথ প্যারিসে যান এবং সেখানকার সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা শেখেন। এরপর হরিনাথ মিশর গিয়ে আরবি ভাষাও শেখেন। আরবি ভাষা শেখা শেষ করে হরিনাথ জার্মানির মারমুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য যান এবং এখান থেকে তিনি সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ এবং আধুনিক ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করেন। ১৯০০ সাল নাগাদ তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘ক্লাসিক্যাল ট্রাইপস্’ পরীক্ষার প্রথম ভাগ দিলেন এবং এই পরীক্ষাতেও প্রথম শ্রেণীতেই উত্তীর্ণ হলেন। পরের বছরই তিনি মধ্যযুগীয় আধুনিক ভাষায় ট্রাইপস্ পরীক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করলেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরিনাথ দে গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন।
অকালে তার মৃত্যু হয় মাত্র ৩৪ বৎসর বয়সে। এর মধ্যে কর্মকাল কম-বেশি ১০ বৎসর। এই অল্প সময়েই তিনি ভাষা নিয়ে প্রচুর কাজ করেছিলেন। হরিনাথ দে সম্পাদনায় ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল “Macaulay’s Essay On Milton” গ্রন্থের এক অভিনব সংস্করণ। তার সম্পাদিত “Palgrave’s Golden Treasury” গ্রন্থের চমৎকার সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে । পরবর্তীতে ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্ত রেহেলা এবং জালালুদ্দিন আবু জাফর মুহাম্মদ- এর আল-ফখরি গ্রন্থদ্বয় আরবী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তিনি আরবী ব্যাকরণ প্রণয়ন নিয়ে কাজ করেছেন। এছাড়া তার গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনা, অনুবাদ এবং গবেষণাকর্মের মধ্যে রয়েছে ইংলিশ-পার্শিয়ান লেক্সিকন সংকলন, মূলসহ ঋগ বেদের অনেকগুলো শ্লোকের ইংরেজি ভাষান্তর, ফরাসী লেখক ঝাঁলর স্মৃতিকথা সম্পাদনা, সুবন্ধুর ‘বাসবদত্তা’র ইংরেজি অনুবাদ, ‘লংকাবতার সূত্র’ এবং ‘নির্বাণব্যাখ্যানশাস্ত্রম’-এর সম্পাদনা, কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলাম’-এর ছন্দোবদ্ধ ইংরেজি ভাষান্তর, ফার্সী ভাষায় রচিত ঢাকার ইতিহাস ‘তারিখ-ই-নুসরাত জঙ্গি’ সম্পাদনা করেছেন, বাংলায় রচিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ও ‘মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ এবং অমৃতলাল বসুর ‘বাবু’র ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ফার্সী ভাষায় রচিত বাদশাহ শাহ আলমের জীবনী ‘শাহ আলম নামা’ সম্পাদনা করেছেন। তিনি গ্রীক, আরবী, ফারসী, পালি, বাংলা, ইতালীয়, রুশ প্রভৃতি ভাষার কবিতার ছন্দোবদ্ধ ইংরেজি অনুবাদও সম্পাদন করেছেন।
এই বহুভাষী কৃতী বাঙ্গালী ১৯১১ সালের ৩০ আগস্ট মাত্র ৩৪ বছরে পরলোকগমন করেন।