এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জী ওবিই, (৫ মার্চ ১৯১১ – ৮ নভেম্বর ১৯৬০) ছিলেন ভারতীয় হিসেবে দেশটির বিমান বাহিনীর প্রথম চীফ অভ দ্যা এয়ার স্টাফ বা বিমান বাহিনীর প্রধান কর্মকর্তা; তার পূর্বের প্রধানগণ সবাই ব্রিটিশ ছিলেন। তার জন্ম একটি নামকরা বাঙালি পরিবারে। তিনি পড়াশোনা করেছেন ভারত ও ইংল্যান্ডে। তিনি প্রথমে রয়াল এয়ার ফোর্সে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রথম দিককার সদস্য ছিলেন। তার বৈচিত্রপূর্ণ জীবনে তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬০ সালে তিনি দুর্ঘটনায় মারা যান। তাকে বলা হয় “ভারতীয় বিমান বাহিনীর জনক”।
তাঁর দাদু ছিলেন ডঃ পি কে রায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ। দিদিমা সরলা রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গোখেল মেমোরিয়াল কলেজ।
ঠাকুরদা ছিলেন, নিবারণ চন্দ্র মুখার্জী, যিনি ব্রাহ্ম ছিলেন, এবং শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃত ছিলেন। বাবা সতীশ চন্দ্র মুখার্জী ছিলেন, প্রথম ভারতীয় আইসিএস। মামা ইন্দ্র লাল রায় রয়াল ফ্লাইং কর্প -এ যোগ দিয়েছিলেন, এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় প্রথম ভারতীয় হিসেবে ফ্লাইং ক্রস পেয়েছিলেন।
দিদি রেণুকা রায়ও বিখ্যাত ব্যাক্তি ছিলেন, কেমব্রিজ ও লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে পাশ করে, সাংসদ, ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রদূত হন।
দাদা প্রশান্ত মুখার্জী ছিলেন রেলওয়ে বোর্ডের প্রথম ভারতীয় চেয়ারম্যান।
এ হেন পরিবারের, চার ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট ছেলে সুব্রত, ১৯১১ সালের ৫ই মার্চ কলকাতায় জন্মেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই মামাকে দেখে ওড়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু মা একেবারেই চাইতেন না। তাই প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন একরকম জোর করেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কেমব্রিজে, ডাক্তারি পড়তে।
কিন্তু তাঁর বাবা ছেলের স্বপ্নকে সম্মান করতেন। ১৯২৯ সালে একটা কাগজের কাটিং তিনি ছেলেকে পাঠিয়ে দেন কেমব্রিজে। সেটাতে লেখা ছিল ব্রিটিশ সরকার ছ’জন ভারতীয়কে রয়্যাল এয়ার ফোর্সে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কাগজটা নিয়েই দেরী করেননা সুব্রত। ক্র্যানওয়েল এনট্রান্স টেস্টে প্রথম হন এবং অন্য পাঁচ জন ভারতীয়র সাথে যোগ দেন রয়্যাল এয়ার ফোর্সে।
এরপর শুরু হয় তাঁর স্বপ্নের উড়ান। উইলসায়ারের আর্মি স্কুল থেকে পাশ করেন। ১৯৩৩ সালের পয়লা এপ্রিল তৈরি হল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স, আর সেদিনই করাচি থেকে নাম্বার ওয়ান স্কোয়াড্রনের ফ্লাইট ‘এ’ নিয়ে আকাশে উড়লেন, সুব্রত মুখার্জী।
ছ বছরের মধ্যে তিনি হয়ে গেলে স্কোয়াড্রন লিডার। অবশ্যই প্রথম ভারতীয় যিনি এই পদে গেলেন। ১৯৪২ সালে রয়্যাল এয়ার ফোর্স স্টেশনের হেড। বলা বাহুল্য সেটাও একজন প্রথম ভারতীয় হিসেবে।
১৯৪২ সালে নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ারে দুরূহ পরিস্থিতিতে অপারেশন চালানোর জন্য তিনি পেলেন, অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার। এই পুরস্কার কখনও কোনও ভারতীয় তো পানইনি, ব্রিটিশরাও এর জন্য অপেক্ষা করতেন সারা জীবন।
কিন্তু একজন নেটিভের এই পুরস্কারে, তাঁর ব্রিটিশ সহকর্মী এবং সুপিরিয়ররা তাঁকে পদে পদে অপমান, জাতি ভিত্তিক কু মন্তব্য, ফাঁসানোর চেষ্টা, এসব করা শুরু করলেন।
কিন্তু দেখতে দেখতে ১৯৪৭ সাল এসে গেল, ভারত স্বাধীনতা লাভ করল। লর্ড মাউন্টব্যাটন সুব্রত মুখার্জীকে ডেকে বললেন, তুমি কি চাও, আমাদের সব অফিসার এখান থেকে চলে যাক, না কয়েকজন থেকে যাক। সুব্রত নির্দ্বিধায় বললেন, আমাদের নিজস্ব অফিসার তৈরী না হওয়া অবধি, ট্রেনিং প্রয়োজন।
অনেকে মনে করেন, এটা তাঁর মহত্ত্বের পরিচয়। তিনি জানতেন, সব ব্রিটিশ অফিসার চলে গেলে, তিনি তখনই ‘চিফ অফ এয়ার স্টাফ’ হয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি নিজের স্বার্থের ওপর দেশের স্বার্থকে স্থান দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিলেন এবং নিজে ট্রেনিং নিতে গেলেন ইংল্যান্ডের ইম্পিরিয়াল ডিফেন্স কলেজে।
১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ‘চিফ অফ এয়ার স্টাফ’ হন।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ছিলেন ভারতের সিনিয়ার মোস্ট অফিসার। সে সময়ে ভারত মহাসাগরে বহু জাপানী অধিকৃত দ্বীপকে মুক্ত করতে তাঁর ফ্লাইট নাম্বার ওয়ান স্কোয়াড্রন যেন অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল।
অসম্ভব রকম লো ফ্লাইং, অদম্য সাহস, শত্রু ঘাঁটি তে ঢুকে গিয়ে ধ্বংস করে আসা, এসব নানান গল্প আছে তাঁকে নিয়ে।
ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুব স্নেহশীল। তাঁর স্ত্রী সারদা মুখার্জী ছিলেন গুজরাতের রাজ্যপাল।
দুজনে বহু অবসর প্রাপ্ত আর্মি পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেনা’র ছেলেরা তাঁর নিজের ছেলের মত ছিল।
১৯৬০ সালে প্রথম এয়ার ইন্ডিয়ার আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে যাত্রী হয়ে তিনি টোকিও গেছিলেন।
সেখানে একটা রেস্টুরেন্ট-এ খাবার সময় শ্বাসনালীতে খাবার আটকে যায় এবং মাত্র ৪৯ বছর বয়সে এই সার্থক জীবনের ওপর যবনিকা নেমে আসে।
শোনা যায়, যখন তাঁর মা তাঁর বায়ু সেনা তে যোগ দেবার কারণে খুব কান্না কাটি করতেন, তিনি বলেছিলেন, দেখো মা, আকাশে আমি অজেয়, সেখানে আমি মরব না।
তিনি ছোটবেলা থেকে ফুটবল প্রেমিক ছিলেন, এবং মোহনবাগানের অন্ধ ভক্ত ছিলেন, সদস্যও ছিলেন।
তিনি চাইতেন, স্কুল গুলোর মধ্যে টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হোক, এবং তার থেকে প্রতিভাশালী ফুটবলারের খোঁজ হোক। তাঁর মৃত্যুর পর ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট যখন চালু হল, তার নাম তাই হল ‘সুব্রত কাপ’।
BengalRising