পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন (১৮১৯ – ১৮৮৬) একজন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং সমাজসেবক।
দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার চাংড়িপোতা (বর্তমানে সুভাষগ্রাম) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন ভট্টাচার্য ছিলেন তার পিতা। দুই পুত্রের মধ্যে দ্বারকানাথ ছিলেন জ্যেষ্ঠ। কনিষ্ঠ শ্রীনাথ চক্রবর্তী। হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন ছিলেন দাক্ষিণাত্য বৈদিক সমাজে একজন বিশিষ্ট স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ ও বৈয়াকরণিক পন্ডিত। দ্বারকানাথ বাল্যকালে তার পিতার কাছেই ব্যাকরণ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। দ্বারকানাথের পিতা হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন কলকাতায় টোল চতুষ্পাঠি করে অধ্যাপনা করতেন। এটাই ছিল তার মূল জীবিকা। হরচন্দ্র ন্যায়রত্নের বহু কৃতী ছাত্রদের মধ্যে রামতনু লাহিড়ী ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত অন্যতম। ১৮৩১ সালে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা সম্পাদনার কাজে হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে সাহায্য করতেন।
দ্বারকানাথ বাল্যকালে তার পিতার কাছেই ব্যাকারণ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পরে পন্ডিত সর্বানন্দ সার্বভৌম বারো বছর বয়স পর্যন্ত দ্বারকানাথকে ব্যাকরণ শিক্ষা দান করেন।১৮৩২ সালে হরচন্দ্র পুত্র দ্বারকানাথকে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দেন। সংস্কৃত কলেজে ন্যায়, স্মৃতি,বেদান্ত,দর্শন, সাহিত্য অলংকার,কাব্য ও জ্যোতিষ শিক্ষা গ্রহণ করেন। কলেজে ছাত্রবৃত্তি চালু হলে দ্বারকানাথ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে প্রধান বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৪৫ সালে তাকে বিদ্যাভূষণ উপাধি দেওয়া হয়। এই সময় থেকে কলেজে ইংরেজি শিক্ষা ক্রমশঃ পাঠ্য হয়ে ওঠে। দ্বারকানাথ পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাও শুরু করেন। নিজের কঠোর অধ্যবসায় তিনি বেশি বয়সেও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন।
১৮৪৫ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা শেষ করে তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ফোর্ট উইলিয়ামে ব্রিটিশ প্রসাশকদের বাংলা ভাষা শেখানো তার কাজ ছিল। এরপরে তিনি সেই সংস্কৃত কলেজেই ফিরে আসেন। সংস্কৃত কলেজে তার প্রথম যোগদান গ্রন্থাগারিক হিসাবে। বেতন ছিল মাসে ৩০ টাকা। পরে পদোন্নতি হয়ে তিনি সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। বেতন বেড়ে হয় মাসে ১৫০ টাকা। গ্রন্থাগারিক থেকে অধ্যাপক পদে উন্নীত হবার সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ। বিদ্যাসাগরের সুপারিশক্রমেই তার পদোন্নতি হয়।
দ্বারকানাথ যখন সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন ও পরে অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন তখন নিজ গ্রাম চাংড়িপোতা (বর্তমানে সুভাষগ্রাম) থেকে কলকাতায় যাবার কোনো যানবাহন ছিল না। ১৮৬২ সালে চালু হয় মাতলা রেল (শিয়ালদহ-ক্যানিং শাখা)। রেল চালু হবার আগে তিনি পায়ে হেঁটেই কলকাতায় যাতায়াত করতেন। সেকালে অনেক পদস্থ ব্যক্তি একরকম ছক্কর গাড়িতে চেপে সোমবার রাজপুর-হরিনাভি থেকে কলকাতায় যেতেন।আবার শনিবার কলকাতা থেকে ঐ গাড়িতে বাড়ি ফিরতেন। দ্বারকানাথকে কখনো ঐ গাড়িতে চড়তে দেখা যায় নি।
বেশ কয়েক বছর সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার পর বিদ্যাসাগর বিদ্যালয় পরিদর্শনে বেরোলে বিদ্যাসাগরের অবর্তমালে কিছুকাল তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। অবশেষে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে ১৮৭৩ সালে প্রায় ৫৪ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তার স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ তার অস্বাভাবিক পরিশ্রম। দ্বারকানাথের ভাগিনেয় শিবনাথ শাস্ত্রী তার রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থে তার মাতুল সম্পর্কে লিখেছেন –
” রাত্রি ১১টার সময় শয়ন করিতে যাইবার পূর্বে দেখিয়াছি তিনি কার্যে মগ্ন আছেন, রাত্রি ৪টার সময়ে উঠিয়া দেখিয়াছি তিনি কার্যে মগ্ন আছেন। আমার বয়সের মধ্যে প্রত্যূষে উঠিয়া তাহাকে কখনো ঘুমাইতে দেখিয়াছি এরূপ মনে হয় না।”
দ্বারকানাথের শ্রেষ্ঠ কীর্তি সোমপ্রকাশ পত্রিকা প্রকাশ।১৮৫৮ সালের ১৫ই নভেম্বর কলকাতার চাঁপাতলা থেকে সোমপ্রকাশ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়।
সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার সময় সোমপ্রকাশ সৃষ্টির কল্পনা করা হয়। সারদা প্রসাদ নামক এক বধির ভরণপোষণ করিবার জন্য বিদ্যাসাগর মশাই এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। তার পিতা হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন ১৮৫৬ সালে পুত্র দ্বারকানাথকে সহায় করিয়া নিজ গ্রাম চাংড়িপোতায় (বর্তমানে সুভাষগ্রাম) একটি মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ১৮৬২ সালে মাতলা রেল (শিয়ালদহ-ক্যানিং শাখা) চালু হবার পর তিনি সোমপ্রকাশ পত্রিকাটি নিজ গ্রাম থেকে প্রকাশিত করতে থাকেন। ঐ মুদ্রাযন্ত্র থেকে দ্বারকানাথের লিখিত রোম ও গ্রিসের ইতিহাস নামক দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সমসাময়িককালে বিদ্যাসাগর মহাশয়দের এইধরনের পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা মাথায় আসা স্বাবাভিক। কিন্তু কাজটি সহজ হয়েছিল হাতের কাছে দ্বারকানাথের নিজস্ব মুদ্রাযন্ত্র থাকার ফলেই। আবার একটি পত্রিকা মুদ্রণের ব্যায়ভার বহন করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও ছিল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের। এই পত্রিকা প্রকাশ ছিল দ্বারকানাথের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। তিনি দেখালেন একটি পত্রিকা কিভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেরণা আনতে পারে এবং অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে। ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট জারি করেন। দ্বারকানাথ এই অসম্মানজনক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এক বছরের বেশি সোমপ্রকাশের প্রকাশ বন্ধ রাখেন। সোমপ্রকাশ পত্রিকা আগেকার সাহেবি বাংলা, মৈথিলি বাংলা এবং সংস্কৃত বাংলা প্রভৃতি ভেঙে চুরে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা চালু করে বাংলাভাষা বিকাশে বড় অবদান রাখে। ১৮৮৩ সালের ৯ই এপ্রিল থেকে সোমপ্রকাশ আবার কলকাতার মিত্তজাপুর থেকে প্রকাশ শুরু হয়। এই ঘটনার পর নবপর্যায়ে প্রকাশিত সোমপ্রকাশের প্রভাব কিছুটা কমে গেলেও তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি। সোমপ্রকাশ বরাবরই সরকার বিরোধী সমালোচনা করে গেছে। দ্বারকানাথ ১৮৭৮ সালে কল্পদ্রুম নামে একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন।
দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের আর এক কৃর্তী হরিনাভি ইংরাজী-সংস্কৃত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ১৮৮৬ সালের ২৩ আগষ্ট পরলোকগমন করেন।