বিহার মানেই বাহুবল।
বিহার মানেই বাহুবলীদের দাপাদাপি।
এটাই ছিল রেওয়াজ। ভোটের সময় বেশি। ভোটের আগে-পরেও ওই বাহুবলীদের রক্তচক্ষু নিয়ন্ত্রণ করতে বিহার রাজ্যের রাজনীতিকে।
এবার শোনা যাচ্ছে বাহুবলীরা তেমন কেউই পাত্তা পাচ্ছে না। না রাজনৈতিক দলগুলির কাছে, না ভোটারদের কাছে। ফলে ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে তারা রাজনৈতিক দলের দরজায় দরজায় ভোটের প্রার্থীপদের টিকিটের আশায় হন্যে হয়ে দরবার করে বেড়াচ্ছে। কে নেই সেই দলে–সেই কুখ্যাত পাপ্পু যাদব, তার স্ত্রী রঞ্জিতারঞ্জন, অনন্ত সিংহ, সুরজভান সিং-এর স্ত্রী বীণাদেবী, মায় সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী হিনা, রামকিশোর সিংহ, সুনীল পান্ডেও। স্বয়ং লালুপ্রসাদ যাদবের শ্যালক সাধু যাদবও দরজায় দরজায় ভিখ মাঙছে।
এই ছবিটা অন্তত একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে যে, বিহারে ভোট-সংস্কৃতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি পরিশীলিত হয়, তাহলে যে কোনও রাজ্যেই তা সামগ্ৰিক অর্থেই পরিবর্তনের শরিক হতে পারে, যে পরিবর্তন আসলে উন্নয়নের সূচক।
বিহার যে বদলাচ্ছে সেটা বোঝা গিয়েছিল ২০১৪ সালেই। যখন নির্বাচনী দামামায় গোটা বিহার তোলপাড়, তখনও স্বচক্ষে দেখেছি রাত ১২টায় কলেজ ছাত্রীদের রাস্তায় নাইট ওয়াকিং করতে। অর্থাৎ ভেজাল ভয়ের রাজত্বটা কোন এক জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় নির্ভেজাল শান্তির স্বর্গে পরিণত হয়েছিল।
যাদুদণ্ডের নামটা ছিল নীতিশ কুমার। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। আসলে বিহারে সন্ত্রাসটা ছিল সংস্কৃতির অঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন লালুপ্রসাদ যাদব বা তাঁর স্ত্রী রাবড়ি দেবীর কাছে বাহুবলীরাই বেশি প্রাধান্য পেতেন। বিহারের নব্য রাজনীতিতে স্বয়ং লালু-তনয় তেজস্বী যাদব কিন্তু এখন নীতিশ কুমারকে অনুসরণ করছেন। তিনিও বুঝেছেন সুস্থ সংস্কৃতির অপনোদন ঘটিয়ে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ কোনও ভোটারই ভাল চোখে দেখেন না। ভালো মনে গ্রহণ করেন না। ফলে তাঁর কাছে এই মুহূর্তে মামা সাধু যাদবও পরিত্যাজ্য।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ?
ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিকদের স্ক্যানারে পশ্চিমবঙ্গ চিরকালই সংস্কৃতিসম্পন্ন রাজ্য হিসাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ধুতি-পাঞ্জাবি-কোলাপুরি চটি পরা বাঙালিবাবুর সংখ্যা কমে এলেও প্যান্ট-সার্ট, স্যুট পরিহিত বাঙালি এখনও মননে ও চেতনে বাঙালিবাবুই রয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ রাজ্যে এখন এতটাই নিন্দনীয় এবং দুর্দম রূপ ধারণ করেছে যে ‘বঙ্গসংস্কৃতি’ শব্দটা লুপ্ত হতে বসেছে। শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬৭-৬৯ সালেই যখন প্রথম যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। পাড়ায় পাড়ায় লাল সেলোফেন পেপার মোড়া বাল্ব জ্বালিয়ে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষকে হ্যাটা করতে কানা বেগুন আর মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে ব্যঙ্গ করতে কাঁচকলার মালা ঝোলানো দিয়ে। তারপর পি ডি এফ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী গান্ধীবাদী কংগ্রেসী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মাথায় বিধানসভার অভ্যন্তরে দোয়াত সমেত কালি ঢেলে দেওয়া এবং অনুষঙ্গ হিসাবে পচা ডিম আর পচা টম্যাটো ছুঁড়ে মারার মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল নির্লজ্জ রাজনৈতিক সংস্কৃতির। সেটাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আরও বড় সংস্কৃতি রিগিং আর ছাপ্পা ভোটের কায়েমী প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন প্রণম্য দেশনেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্নেহের নাতি সাহেবি রাজনীতিবিদ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। সেই সময় অতি বাম নকশাল রাজনীতির ভ্রুণের সংস্কৃতি, এবং তারপর বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের রক্তপাত আর নিষ্কর্মা রাজনীতির সংস্কৃতিও প্রত্যক্ষ করল গোটা ভারতবর্ষ।
তিলে তিলে ক্ষয়িষ্ণু সেই রাজনীতি, সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন ফুলে ফেঁপে এমন এক বাহুবলী সংস্কৃতির চেহারা নিয়েছে যাকে ভয় পেতেই হবে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আজকের বাহুবলীদের মুখের ভাষা, শরীরের আস্ফালন, বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ, মেকি লোকদেখানো জনপ্রেম এবং তারপরেই রক্তপাতের হোলিখেলার নিত্যনৈমিত্তিক উন্মোচনে মানুষ হতবাক। এতটাই মানুষ হতচকিত যে সে প্রতিবাদের ভাষাটাই হারিয়ে ফেলেছে দ্রুত। ভুলে যাচ্ছে বাঙালির সাহসের প্রতীক বাঘা যতীনকে। যে মেরুদণ্ডের জন্য সুনাম ছিল বঙ্গসন্তানদের আজ তাদের মেরুদণ্ডগুলো প্রতিদিন বাঁকতে বাঁকতে ধনুকের মতো হয়ে যাচ্ছে। ছিলাহীন, তিরহীন ধনুকের মতো। আর সেই ডরপুক বঙ্গসন্তানদের এখন কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে আজকের রাজনীতি।
সেই রাজনীতিটা কেমন?
এ রাজনীতিতে উন্নয়ন মানে রাজ্যজুড়ে ল্যাম্পপোস্টে সাদা-নীল আলোর পাউডার, সরকারি ভবনের বাইরের দেওয়ালে নীল-সাদা রঙের লিপস্টিক। এ রাজনীতিতে উন্নয়ন মানে ডোল পলিটিক্স–পাইয়ে দেওয়ার ছক। কন্যাশ্রী প্রকল্পের নামে জনগণের অর্থে ছাত্রীদের হাতে একটা করে সস্তার সাইকেল তুলে দাও। পড়াশোনার জন্য অর্থ তুলে দাও। সাইকেল চড়ে সে স্কুল যাচ্ছে কিনা কিংবা কন্যাশ্রীর টাকায় নতুন মোবাইল কেনা হল কিনা দেখার দরকার নেই। রূপশ্রী প্রকল্পের নামে গ্রামের গরিব মেয়ের জন্য ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দাও। বিয়ে হল কি না হল তা নিয়ে মাথাব্যথার কোনও প্রয়োজন নেই। খেলাধূলার উন্নয়নের জন্য সব ক্লাবে ২ লক্ষ টাকা করে দিয়ে দাও। সে ক্লাব খেলাধূলার ক্লাব হোক আর নাই হোক। মিড ডে মিলের জন্য টাকার অনুমোদন দাও। ছাত্রছাত্রীরা কী খাচ্ছে, কতটা খাচ্ছে দেখার দরকার নেই। পাড়ায় পাড়ায় হাসপাতাল ভবন কর। ডাক্তার থাক বা না থাক। হাজারটা বিশ্ববিদ্যালয় কর। অধ্যক্ষ, অধ্যাপক থাক বা না থাক। গ্ৰামে গ্ৰামে আই টি আই কর। ছাত্র নাইবা রইল। হাজারটা বাস রুট চালু কর। বাস চলল বা নাই চলল। এ রাজনীতিতে উন্নয়নের আসল নামটা হল দলের ভোটব্যাঙ্কের উন্নয়ন। এ রাজ্যের শাসক দল এবং সরকারের কানের কাছে যতই বলা হোক না কেন, Nova c Quebral-এর সেই অমোঘ সংজ্ঞা–উন্নয়ন হল “speedy transformation of a country from poverty to dynamic state of economic growth that makes possible greater economic and social equality and larger fulfillment of the human potential”, সে কথা তাদের কানে ঢোকানো যাবে না।
কারণ সস্তার নাটকই আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সংজ্ঞা নির্ধারকরা বলে গেছেন ” culture is a complex whole that includes knowledge, belief, art, morals, law, customs and any other capabilities and habits acquired by man as a member of society”, অর্থাৎ সংস্কৃতি হল সামগ্ৰিক ভাবে মানুষের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইন, প্রথা এবং যাবতীয় যোগ্যতা ও অভ্যাসের সমন্বিত ফলাফল। কিংবা যেমন ক্লাইভ ক্লাকোহন এবং রেমন্ড কেলি বলে গেছেন : সংস্কৃতি হল ইতিহাসাশ্রয়ী নির্বাচিত পদ্ধতি যা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উদ্দীপক প্রসঙ্গে মানুষের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। অর্থাৎ সংস্কৃতির লক্ষণগুলি বিস্তৃত হয় যুগ যুগ ধরে। পরিবর্তনের কালস্রোতে তার বিবর্তন হতে পারে। বীজের সংস্কার সাধন হতে পারে, কিন্তু বীজটা থেকে যায়।
আজ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সেই বীজটাকেই ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আজ তাই সকল শাসক দল প্রধান, সরকারের প্রধান প্রকাশ্যে যে কোনও প্রশ্নকারীকে উত্তর না দিয়ে ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়ে জেলে ভরতে পারে। তার জন্য অন্য অপরাধ করার প্রয়োজন পড়ে না। আজ তাই ব্যঙ্গচিত্র শিল্পীকে তুলি হাতে নেবার আগে দু-বার ভাবতে হয়, তাঁকে অম্বিকেশ মহাপাত্র বলে পুলিশের গাড়িতে তোলা হবে না তো! আজ তাই ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’-এর নির্দেশে কলকাতার সমস্ত সিনেমা হল থেকে এক রাতেই উধাও হয়ে যায় একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। সুপ্রিমকোর্টে ওই চলচ্চিত্র ফের সিনেমা হলগুলিতে চালানোর জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিলেও তা চালানো হয় না। বরং শাসক দলের পেটোয়া এক স্যানিটারি ন্যাপকিন সদৃশ সংবাদপত্রে সম্পাদক নিজেই এক মহিলার ঘোমটার আড়ালে নানা খেউড় জাতীয় অলঙ্কারে বাংলা ভাষাকে সাজিয়ে লেখেন-‘ও যে যাই বলুক বাংলায় ভুতের নেত্য চালাতে দেব না’। (ভূত বানানটাও যিনি ভুল জানেন)।
মার্চের শেষে কলকাতার সুজাতা সদন মঞ্চে অভিনীত হওয়ার আগেই ‘হিন্দু চোর’ নামক একটি নাটক পুলিশ পাঠিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আজ তাই বঙ্গরাজনীতির রানিমা, গলাবাজি করতে পারেন “২০১৯ বিজেপি ফিনিশ। ৪২-এ বিয়াল্লিশটাই চাই” বলে চার ব্রাহ্মণকে দিয়ে যজ্ঞ করান। তিনি সরকারি ভাবে ইমামদের ভাতা মঞ্জুর করেন, অতি-মুসলিম হয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠলেই আবার নিজেকে শুদ্ধ করতে বেলপাতা, আমপাতা, গোবর জল, গঙ্গাজলের আশ্রয় নেন। আজ তাই চিটফান্ডের টাকা ও নথি লোপাটের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে কলকাতা পুলিশের লাঠি পড়ে সি বি আই অফিসারদের পিঠে আর চিটফান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত আম-জনতার ব্রহ্মতালুতে। আর চিটফান্ড চোরদের বাঁচাতে গোটা সরকারটাই নবান্ন ছেড়ে ধর্নায় বসে পড়ে রাজপথে। এ রাজ্যের রাজনীতিতে শাসক হুমকি দেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি দিয়ে ঘোরাবেন। প্রকাশ্য জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে চেঙ্গিস খাঁ, হিটলার, মুসোলিনি, গব্বর সিং অভিধায় ভূষিত করেন। আবার গলাবাজি করতেও ছাড়েন না, “আমরা ওদের মত অসভ্য নই। বর্বর নই। আমরা মিথ্যা বলি না। চুরি ডাকাতি করি না”। কিন্তু দু কেজি সোনা সহ দলের এক কর্মকর্তার স্ত্রী বিমানবন্দরে ধরা পড়ার পরও কোনও জাদুমন্ত্রে তাঁকে কাস্টমসের হাত থেকে সোনা সহ ছিনিয়ে নিয়ে যায় স্থানীয় পুলিশ। সেই অভিযোগ আজ সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে। তবুও গোটা রাজ্য জুড়ে সেই পরিচিত কণ্ঠের হুমকিতে খামতি নেই–গোটা রাজ্যে বিরোধীরা যেন একটা সিটও না পায়। ৪২-এ ৪২ টাই চাই। গোটা রাজ্য হবে বিরোধী শূন্য।
আজ্ঞে হ্যাঁ। বিরোধীশূন্য মানে বিরোধীশূন্যই। যেমনটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে হয়েছিল। শাসকদলের বাহুবলীদের কলুষিত হাত থেকে রেহাই পাননি মা বোনেরাও। আর এবার তো আসানসোল থেকে সরাসরি টাকার টোপ ঘোষণা করা হয়ে গেছে রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করতে। স্বৈরাচারিতার আর বাকি রইল কী? গণমাধ্যমে এ রাজ্যে সত্যি কথা এবং ‘খবর’ প্রচার করা যায় না। না, কোনও সরকারি নির্দেশ নেই লিখিতভাবে। কিন্তু একটা চাপা সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এমনভাবে যেখানে সব মিডিয়া কর্তৃপক্ষ এখন হীরক রাজার দেশে ধোলাইকৃত মগজে পরিণত। শাসকদলের বক্তব্যই খবর। বাকি দল বাতিল। অতএব এ রাজ্যে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ এখন তল্পিবাহকের ভূমিকায়। বাক্ স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনসত্তা–সব কিছুই এ রাজ্যে এখন ‘এক যে ছিল দেশ’-এর গল্প। সে গল্প আরও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন হাতে গোনা কয়েকটা সাংবাদিক কাঁচা পয়সায় ওজন দরে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন আর ‘সরকারি খবর’ লিখে রাজ্যের ‘সেরা সাংবাদিক’-এর তকমা পাচ্ছেন। এঁরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে, নিজেদের আখের গোছানোর খেলায় মেতেছেন নিজেদের মস্তিষ্ক আর সাংবাদিক সত্তাকে কালীঘাট আর নবান্নের দরজায় বন্ধক রেখে। বঙ্গবাসী দেখছেন, স্বৈরাচার আর স্বৈরতন্ত্রের এক নতুন আইকনকে, এক নতুন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডারকে যিনি যত বেশি শুভ্র পোশাকে নিজেকে ‘পবিত্র’ করে উত্থাপন করেন, ততই রক্তাক্ত হয়ে ওঠে তাঁর হাত আর ফুলেফেঁপে ওঠে অন্দরমহল। কারণ এ রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল বছরভর সরকারি অর্থে ইলিশ উৎসব থেকে মৌরলা উৎসবের ‘মোচ্ছব’ আর পুরোপুরি বিরোধীশূন্য করে তোলা। তাই শাসক হোলির উৎসবেই মহড়া দিয়ে নেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের রক্তের হোলি খেলার। আমরা জানি, ‘৭০-এর দশকে সেই কংগ্রেসী ও নকশাল সন্ত্রাসের কালো দিনগুলো। আমরা জানি, বামফ্রন্ট জমানার অ-কম্যুনিস্ট সুলভ শাসনতন্ত্রের কালো দিনগুলোও। সেই ‘ঐতিহ্য’-র পরম্পরাকেও হারিয়ে দিয়েছে আজকের বঙ্গরাজনীতি। তাই যে অতি বামপন্থীদের হাত ধরে নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় ঘটাল আজকের শাসকদল, যে সিঙ্গুরে তৈরি কারখানার ভিত ফাটিয়ে সিঙ্গুরে কৃষক আন্দোলনের বীজ পুঁতল, সেই শাসকদলের চক্রান্তেই ধ্বংস হতে হল বামপন্থীদের। আর সেই অতি বামপন্থীদেরই কেউ কেউ রাজ্য সরকারের মঞ্চ আলো করে বসল, কেউ বা পায়ে ধরে মোটা টাকা মাইনের চাকরি বাঁচাল আবার কেউ কেউ শাসকের নামে শ্লোগান তুলে দলের মিডিয়ার দায়িত্ব পেল মোটা অঙ্কের বিনিময়ে।
শিক্ষা নয়, দীক্ষা নয়, ঐতিহ্য নয়। পরম্পরা নয়। ভদ্রতা নয়। মানসিক সুস্থতা নয়। এক চক্রান্তের রাজনীতি। এক চাপা সন্ত্রাসের পরিবেশ। এক ভয়ঙ্কর উন্মাদনা চতুর্দিকে। এ উন্মাদনা অনুপ্রেরণা জোগায় না। মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছের ভিতটাকে আলগা করে দেয়। এই উন্মাদনা মানুষকে এগিয়ে যাবার দিকে নিয়ে যায় না। দাবানলের দিকে ঠেলে দেয়। আজকের বাংলা রাজনীতি আইন মানে না। সংবিধান মানে না। মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দেয় না। ইতিহাসকে মনে রাখে না। তাই কবিকে কবিতা লেখার জন্য, শিল্পীকে ছবি আঁকার জন্য, গায়ককে গান গাইবার জন্য অনুপ্রেরণা নিতে কালীঘাটে লাইন দিতে হয়।
প্রতিদিন তিলে তিলে আমরা গোটা রাজ্যবাসী এগোচ্ছি এক অন্ধকারের দিকে। ভয়ানক, কুটিল অন্ধকার। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গনে এমন অন্ধকার আগে কখনও দেখা যায়নি। এমন ভয়াল সুনামির গর্জন আগে কখনও শোনা যায়নি। এমন বুক ফাটা হাহাকার করতে দেখা য়ায়নি সন্তানহারা মাকে, স্বামীহারা পত্নীকে, পিতৃহারা শিশুকে। এক সব হারানো দিনের নির্বাক সাক্ষী হয়ে থম মেরে আছে বাংলা। সে এক নবোত্থান, এক নব বিপ্লবের অপেক্ষায়।
রাজনীতি মানে তো রাজার নীতি নয়। রাজনীতি মানে নীতির রাজা। সেই নীতির রাজার এ অধঃপতন! আজকের বঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বীরভূমের ‘কেষ্টা ব্যাটাকে’ ঢাকের পিঠে চড়াম চড়াম করে আওয়াজ তুলতে শেখায়। জনগণকে গুড়-জল-বাতাসা-নকুলদানা পাঁচনের বাড়ি দিতে অনুপ্রেরণা জোগায়। উন্নয়নকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে লাঠি হাতে।
আর কবি শঙ্খ ঘোষকে গণ্ডমূর্খের মুখে শুনতে হয়-‘শঙ্খ? সেটা আবার ক্যা রা?’
শুনুন। এখন শুধুই শোনার সময়।
দেখুন। এখন শুধুই দেখার সময়।
বুঝুন। এখন শুধুই বোঝার সময়।
দরকারে কানে তুলো নাই গুঁজুন। পিঠে কুলো নাই বাঁধুন। মুখে মুলো নাই গুঁজুন। মাথায় রাখুন হাত। অন্তত মাথার ঘিলুটাকে প্রোটেক্ট করুন। কাজে তো লাগবেই। ইসবার ইয়া অবাকি বার। বীজের সংস্কার সাধন হবেই। সেই সংস্কারই ফিরিয়ে দেবে সংস্কৃতি। সংস্কৃত রাজনীতি। কেষ্ট, বালু, রবি, হাত কাটা, কানকাটারা সেদিনও থাকবে। তারা চেষ্টা করবে গিরগিটির মতো চামড়ার রং বদলাতে। সেদিন কিন্তু সতেজ হয়ে থাকবে মানুষের মাথার ঘিলু। সেদিন মানুষ সমস্বরে বলবেই–’তফাৎ যাও! এ রাজ্যে তোমরা অচ্ছুৎ!’