অপর্ণা গৌতমরা হিসেব করে রাগ করেন, প্রিয়া সাহার পক্ষে দাঁড়ানো তাঁদের ফ্যাশন বিরোধী

তবরেজ আনসারিকে যখন জয় শ্রী রাম বলানোর জন্য পেটানো হচ্ছিল, তখন ঘৃণায় আমার গা রিরি করছিল। কোনও সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এটা হতে পারে না। ঠিক একইরকম ভাবে আমার অসহায় লাগে, যখন প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহীতার’ অভিযোগ আনা হয়। প্রিয়া সাহার নাম যাঁরা শোনেনি তাঁদের জানিয়ে রাখা ভালো, তিনি বাংলাদেশের একজন সংখ্যালঘু মহিলা।

বিভিন্ন ঘটনাচক্রে যিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এবং বাংলাদেশে যে হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে সেই বিষয়টি উল্লেখ করেন। ব্যস, তারপর থেকেই প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ঘোষিত ‘দেশদ্রোহী’। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, বাংলাদেশের তাবড় তাবড় মন্ত্রীরা প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে তাঁকে জেলে পোরার দাবি তুলেছে। আজ ভারতবর্ষের ৪৯ জন বুদ্ধিজীবীর প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখার এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের টেলিভিশনে বাইট দেওয়ার হিড়িক দেখে প্রিয়া সাহার উদাহরণটা মনে পড়ল।

এই অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ কিংবা অনুপম রায়ের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা প্রিয়া সাহা নিয়ে টু-শব্দটি করেননি। কারণ, সেটা ফ্যাশান নয়! তাছাড়া যদি ওঁরা প্রিয়া সাহা নিয়ে মুখ খুলতেন তাহলে ওঁদের বাংলাদেশের বাজার নষ্ট হয়ে যেত। ঢাকা গেলে পাতে ইলিশ, ফেরার সময় উপহার হিসেবে জামদানি জুটত না। হয়তো সেই জন্যেই অনুপম রায় এ-বিষয়ে নিশ্চুপ। আপনি বলতেই পারেন, প্রিয়া সাহা অন্য দেশের বিষয়। কিন্তু যে অপর্ণা সেন ইরাক-ইরান যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারেন, তিনি প্রতিবেশী বাংলাদেশের একজন হিন্দু মেয়ের উপর উৎপীড়ন নিয়ে চুপ কেন?

গত কয়েক সপ্তাহে দেশের বাইরে থাকার পর আমি যখন কলকাতা ফিরলাম, দেখলাম প্রিয়া সাহা নিয়ে কারো কোনও উচ্চবাচ্য নেই। কোনও ‘বাজার’-এ কোনও সম্পাদকীয় নেই। কলকাতা শহরের যে সব বুদ্ধিজীবীরা সিরিয়া থেকে ভেনেজুয়েলা—সব বিষয়ে খবর রাখেন, মন্তব্য করেন। তাঁরা প্রিয়া সাহা নিয়ে কিছু বলেছেন এমনটা জানতে পারলাম না। অকাদেমির সামনে কোনও প্রদীপ মিছিলও হয়নি। আসলে এরা প্রিয়া সাহার ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে যেমন ইসলামিক মৌলবাদকে আড়াল করতে চান, তেমনই পরোক্ষে হিন্দু মৌলবাদ যাতে বেড়ে ওঠে সেটাকেও প্রশ্রয় দেন। ওঁরা কি বোঝেন না, আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ওঁরা কী বললেন বা বাংলাভাষার কোনও সর্বাধিক প্রচারিত খবরের কাগজে কী ছাপা হল তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সবাই সব কিছু জানতে পারে। এবং দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ, বা সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দু এই বুদ্ধিজীবীদের দেখে এবং অপছন্দ করতে শুরু করে।

আরেকটা কথা, রূপম ইসলাম এবং অনুপম রায় ২০১৮ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৯-এর মে মাস পর্যন্ত কোথায় ঘুমিয়ে ছিলেন? পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই দেখা যাবে, গোটা দেশে গোরক্ষার নামে যত লোককে পিটিয়ে মারা হয়েছে, তারচেয়েও বেশি লোক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হানাহানিতে মারা গিয়েছে। ভুল করেও ভাববেন না, আমি একটা অন্যায়কে আরেকটা অন্যায় দিয়ে জাস্টিফাই করতে চাইছি। গোরক্ষার নামে পিটিয়ে মারাটা যত বড় অপরাধ, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য যে খুনোখুনির রাজনীতি হয়েছে তাও কম নিন্দনীয় নয়। আশ্চর্যের বিষয় সেই সময় এই তথাকথিত বঙ্গ বুদ্ধিজীবীদের একজনও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের বিরুদ্ধে টু-শব্দটি উচ্চারণ করেননি। বরং কাউকে কাউকে শাসক দলের সঙ্গে বা শাসক দলের প্রধানের সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করতে দেখা গিয়েছে। যাঁরা আজকে, মানে যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা শোরগোল তুলছেন গোটা ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু এবং দলিতদের উপর আক্রমণ হচ্ছে, তাঁরা ভুলে গিয়েছেন, যে পঞ্চায়েত ভোটের সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংঘর্ষে যে ৮০ জন মারা গিয়েছিলেন, তার ৯০% ছিলেন মুসলমান অথবা দলিত। সেই ৬০ জন মুসলমান বা দলিতের জন্য, যাঁদের রক্ত এই বঙ্গজ বুদ্ধিজীবীদের নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ঝরেছিল, তাঁদের বিষয়ে এরা সেই সময় একটিও কথা বলেননি কেন?

সুমন ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.