রাজা রামমোহন রায় লিখেছিলেন ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার”। এখন আমাদেরও ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিচার করা দরকার । প্রসঙ্গ যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে বাম-প্রার্থী শ্রী বিকাশ ভট্টাচার্য? না সরাসরি তেমন দুরাশা পোষণ করছি না। বিকাশ বাবু দুঁদে আইনজীবী, বুদ্ধিতে তাঁকে তাল ঠোকার কারন নেই। উনি কয়েক বছর আগে কলকাতার কেন্দ্রে প্রকাশ্যে গোমাংস ভক্ষণ করেছিলেন। তখন থেকেই বিতর্কটি ঘনিয়ে উঠেছিল। সঙ্গে ছিলেন এক ভ্রষ্ট চরিত্র ক্ষমতাপ্রিয় কবি।
এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিল এক বিচিত্র কর্মা জিহাদী সংগঠন। বাংলাদেশের হিন্দু বিতাড়নে এরা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া জানাতে নিষেধ করে আর আখলাকের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কার্জন পার্কে গোমাংস খাওয়ার অনুষ্ঠান করে।
ভোটে দাঁড়াবার পর বিকাশ বাবু সম্পর্কে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বহু প্রতিবাদ হয়েছে। বিকাশ বাবুর পক্ষে দু-একজন কিছু লিখেছেন। সম্প্রতি এক মুখোপাধ্যায় পদবি ধারী বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, ভারতে বেদের যুগে গোমাংস খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। যুক্তিগুলি দেখলে আরেক ভট্টাচার্যের লেখালেখির কথা মনে পড়ে, বিকাশ বাবুর মতই তিনি বামপন্থী । অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্যের বহু রচনায় এই অভিমত পাওয়া যায়। কয়েকটি রচনার নাম: ‘বৈদিক সাহিত্যের রূপরেখা’, ‘ঋগ্বেদ সংহিতা প্রসঙ্গে’, ‘যজুর্বেদ সাহিত্যের কথা’, ‘অথর্ববেদ সংহিতার কথা’- ইত্যাদি। সাহিত্য বিচার পদ্ধতিতে সত্য নিষ্কাশন বহু ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তি ছড়ায়। সর্বোপরি মনে করিয়ে দিই, শ্রীমতি ভট্টাচার্য বিবাহ সূত্রে খৃস্টানী এতে কোন দোষ নেই – তবে ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা অপেক্ষা পাশ্চাত্য বস্তুবাদী বিচারে তাঁর আগ্রহ বেশি। তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন প্রাচীন ভারতে গোমাংস খুবই প্রচলিত ছিল, পরবর্তী কালে তা কমে গেছে। কৃষিকর্মে গবাদি পশুর ব্যবহার বাড়ে – গোহত্যা নিবারণ হয়েছে সেই সময়।
এখন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিচারে বসলে বিষয়টি দাঁড়াবে এই রকম। মুসলমানরা গোহত্যা করে, হিন্দুদের পক্ষে তা অসহ্য কষ্টের কারণ, প্রতিবাদযোগ্য মনে হয়। এই অবস্থায় সুদূর অতীতে গোমাংস ভক্ষণ হত বলে ভট্টাচার্যের প্রকাশ্য গোমাংস ভক্ষণকে সমর্থন করার অর্থ হিন্দু সমাজের ভাবাবেগে আঘাত করা। মনুসংহিতা, শতপথ ব্রাহ্মণে গোহত্যা নিষিদ্ধ হয়েছে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক কারণে গোমাংস ভক্ষণ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য মূলক আর ইচ্ছাকৃত ভাবে হিন্দু মনস্তত্ত্বে আঘাত বলতে চাই।
যদি ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাসের পক্ষে ওই মুখ্যবংশজাতের যুক্তি হয় তাহলে বলব প্রকাশ্যে কেন? কাছেই তো বহু মুসলিম রেস্তরাঁ ছিল। সেখানে গিয়ে খেলেই হত।
পাশ্চাত্য পন্ডিতরা বহু দিন ধরে প্রাচীন ভারতে গোমাংস খাওয়ার কথা বলে চলেছেন। ব্যাখ্যা-ভাশ্য-কারিকা বিচারে একথা কত দূর অভ্রান্ত তাও বিচার্য। ঋগ্বেদে ১.৩৭.৫, ১.১৫৪.২৭, ১.১৬৪.৪০, ৪.১.৬, ৫.৮৩.৮, ৭.৬৮.৮ এ গোরু ‘অঘ্ন্যা’। অঘ্ন্যা অর্থ যা অবধ্য, সম্মানের যোগ্য । যাস্কের নিরুক্তে এই ব্যাখ্যাই আছে। রমেশ চন্দ্র দত্ত এই সব অংশ ব্যাখ্যায় পাশ্চাত্য পন্ডিতদের অনুসরণ করে ভুল করেছেন। দুর্গাদাস লাহিড়ী, উমেশ্চন্দ্র বটব্যাল দেখিয়েছেন গো অর্থ রশ্মি বা ঔষধ। এসব বিভ্রান্তিকর পাঠ ও অর্থ নির্ণয়ের শেষ কথা কি বলার দরকার নেই।
১৮৮৯ নাগাদ বিশিষ্ট মুসলমান সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন লিখেছিলেন ‘গো-জীবন’। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল: ‘গো দুগ্ধই আমাদের জীবন। … মায়ের তো দুগ্ধ আছে ? আছে। কিন্তু গো-রস মায়ের উদরে না গেলে মায়ের স্তনে দুগ্ধ পাই কৈ?’ সুতরাং।
মধ্যযুগে মুসলমান শাসকরা সামনে গোরু রেখে হিন্দু রাজাদের সহজেই পরাজিত করেছে – এমন কিছু জনশ্রুতি পাওয়া যায়। এসবের লক্ষ্য কি, তা সহজবোধ্য। গো-বধের এই রাজনৈতিক ব্যবহার শত শত বৎসর ধরে হিন্দুকে মর্মাহত করেছে। আজ আধুনিক যুক্তি বোধে অনেকেই বলতে পারে, এসব পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কি হবে। পূর্ববঙ্গে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ছেড়ে উদবাস্তু হয়ে আসা কয়েক কোটি বাঙালি হিন্দু নিশ্চয় ততদূর ‘আধুনিক’(modern) ‘উত্তরাধুনিক’(post-modern) ছিলেন না – তাই তারা উঠে এসে যাদবপুর – টালিগঞ্জ – দমদম – বারাসাত অঞ্চলে কলোনিতে থাকতে বাধ্য হয়েছেন।
বিকাশ বাবুর জীবন যাপন বেদনার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছে কিনা সে বিচার করবে ভবিষ্যৎ ।