গত শতকের চারের দশক। ১৯৪০ সালের ১ মার্চ, বোলপুর থেকে ট্রেন ও সড়কপথ হয়ে বাঁকুড়ায় পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ। তদানীন্তন বর্ধমান বিভাগের কমিশনার ও বাঁকুড়ার জেলাশাসক সুধীন্দ্রকুমার হালদার মশাইয়ের স্ত্রী শ্রীমতি উষা হালদারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই বাঁকুড়ার মানুষ বিশ্বকবির দর্শন পেয়েছিলেন। মার্চের ১ থেকে ৩, কবি অবস্থান করেছিলেন জেলাশাসকের জন্য নির্দিষ্ট বাংলো হিল হাউসে। বাঁকুড়ায় কবির হাত দিয়ে কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীর দারোদ্ঘাটন এবং প্রসূতিসদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে।

বাঁকুড়া শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে প্রাচীণ নগরী ছাতনা। এককালের স্বাধীন ভৌমরাজ্য সামন্তভূমের এই রাজধানী শহর বিখ্যাত তার গৌরবময় সংস্কৃতিপরম্পরার কারণে। এই নগরেই বাস করতেন বাংলাসাহিত্যের আদিমধ্যযুগের মহাকবি শ্রীমৎ বড়ু চণ্ডীদাস। বড়ু প্রণীত শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যখানি রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করেছিলেন। রসাস্বাদন করেছিলেন এই মহাগ্রন্থের। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অনুপম গীতিময় পদগুলি বিশ্বকবিকে আলোড়িত করেছিল।

বাঁকুড়া শহরে তখন সদ্য নির্মিত হয়েছে এই ভূখন্ডের মহাকবির নামে এক মনোরম প্রেক্ষাগৃহ। চণ্ডীদাস চিত্রালয়। ১৯৪০ সালের ২ মার্চ, সকাল নটায় রবীন্দ্রনাথকে সেই প্রেক্ষাগৃহে অভ্যর্থনা জানালেন বাঁকুড়ার বিশিষ্ট মানুষজন এবং নাগরিক সমাজ। স্মরণীয় সেই সকালটিতে, অভ্যর্থনা সভার মঞ্চ থেকে কবি বাঁকুড়ার মানুষের উদ্দেশে শোনালেন বড়ু চণ্ডীদাসের কথা। বড়ুর পদ, গীতিকাব্যের মাধুর্য যে এই ভূমিখন্ডের বাইরেও তার অমৃতরস বিলিয়ে চলেছে, রবীন্দ্রনাথ সে প্রসঙ্গের উল্লেখ করে আবেগে আপ্লুত হলেন। পারিপার্শ্বিক লোকজনের থেকে পাওয়া নিন্দে, অপমান আর কুৎসা যে বড়ুর জীবনকে কী অপার মহত্ব দান করেছে, রবীন্দ্রনাথ সেই বিষয়টি ভাবগভীরতায় তাঁর আলোচনায় উপস্থাপিত করেছেন।

বিশ্বকবি জানতেন, বড়ু চণ্ডীদাস বাঁকুড়ার মানুষের কাছে পরম আরাধ্য। এতদঞ্চলের জনমানসে বড়ুর কীর্তির প্রভাব পবিত্র আলোর মতো চিরঞ্জীব। তাই তো অভ্যর্থনাসভার মঞ্চ থেকে সেই সম্মানের প্রতি প্রণত থেকে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করলেন এক অনন্য সম্মানের মহাবাক্য — “তোমাদের অভিনন্দনকে আজ আমি গ্রহণ করি। আপাতত এ জমা থাক গচ্ছিত সম্পত্তির মতো। কালের বড়ো অভিনন্দন সভায় এর যাচাই হবে। তখন তোমাদের বাঁকুড়াতেই চণ্ডীদাসের পাশে কি আসন পাব? এই প্রশ্ন মনে নিয়ে বিদায় গ্রহণ করি।”

এই উচ্চারণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ জয় করে নিলেন আপামর বাঁকুড়ার হৃদয়। ১৯৪০ সালের ২ মার্চের সেই বসন্তপ্রভাতে বিশ্বকবি তাঁর মহত্ব এবং মাহাত্ম্যে একাসনে আসীন হয়ে উঠলেন আদিমধ্যযুগের মহাকবি বড়ু চণ্ডীদাসের সঙ্গে।

স্বরাজ মিত্র

কৃতজ্ঞতা : ১. বাসলী ও চণ্ডীদাস, হরিদাস চট্টোপাধ্যায়। ২. রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সমিতি স্মারক ১৯৬০, বাঁকুড়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.