১৯৮৬-র ২৫ ফেব্রুয়ারি। রাত তিনটে। ফিলিপিনসের ম্যালকানান প্রাসাদের বাইরে তখনও লক্ষ মানুষের ভিড়। মাঝে মাঝেই স্লোগান উঠছে-‘মার্কোস তুমি প্রাসাদ ছাড়ো। জনতার হাতে ক্ষমতা তুলে দাও।’ মাঝে মাঝে জনতার ভিড় আছড়ে পড়ছে প্রাসাদের সদর দরজায়। ঠিক যেমন সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে বালুকাবেলায়। জনতার দাবিতে মুখর হয়ে উঠছে গোটা ফিলিপিনসের আকাশ বাতাস—“আর নয়, আর নয়, মার্কোস তোমর অত্যাচারের আজই শেষ দিন।”
প্রাসাদের অভ্যন্তরে তখনও জেগে সপারিষদ মার্কোস। ২০ বছরের পুরনো স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধান। ঘুম নেই পাশের ঘরেই তার স্ত্রী ইমেলদার চোখেও। তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন, তাঁর প্রিয়তম স্বামী ফার্দিনান্দ মার্কোজ টেলিফোনে কথা বলছেন, আমেরিকার রিপাবলিকান ল’-মেকার এবং মার্কিন সেনেটর পল ল্যাক্সিটের সঙ্গে-“আমার বন্ধু রেগনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনোও লক্ষণই নেই বলছেন?”
ওপার থেকে সম্ভবত ‘না’ শুনেই মার্কোস বলে উঠলেন— ‘প্রেসিডেন্ট রেগন কি আমায় পদত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন?” ল্যাক্সিটের জবাব ভেসে আসে— —“প্রেসিডেন্ট এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। —“আপনি কী বলেন সেনেটর ? আমার কি পদত্যাগ করাই শ্রেয়?
—“আমার মনে হয় সেটাই ভাল। চুপচাপ বেরিয়ে যান। সময় এসে গেছে।” ল্যাক্সিটের কন্ঠে সহানুভূতি এবং কর্তৃত্ব—দুটিই সমানভাবে বিদ্যমান।
মার্কোস ফোন কাটলেন না। কানে ফোনটা চেপে ধরেই পাথরের মত স্থবির হয়ে রইলেন।
অস্থির ল্যাক্সিট—মি. মার্কোজ, আপনি কি এখনও ফোনে রয়েছেন?
মার্কোস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—“আমি সত্যিই বড় হতাশ।”
ভিতরের ঘরে তখন নীরবে চোখের জল ফেলছেন ইমেলদা মার্কোস—সেই মহিলা যিনি জনগণের অর্থে টানা বিশবছর ধরে পৃথিবীর সমস্ত লালসা, সমস্ত সুখ, সমস্ত কামনা আর বিলাসকে কিনে রেখেছিলেন নিজের দুহাতের মুঠোয় আর স্বেচ্ছাচারিতার নগ্ন চেহারাটা নিয়ে মাঝে মাঝেই ছুটে যেতেন চার্চে। প্রাসাদের অভ্যন্তরেই। প্রভু যিশুর কাছে প্রার্থনা করতেন—“জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দাও প্রভু।”
তবে স্বৈরাচারী লোকটা তো মার্কোস। সুখের দিন সমাগত প্রায়, যে-কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে প্রাসাদের প্রধান ফটক। যে-কোনো সময় ভেসে আসবে জনতার মাঝখান থেকে নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের উল্লাস, যে-কোনোও সময়েই আছড়ে পড়তে পারে হিমশীতল মৃত্যু জেনেও তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান শুরুর নির্দেশ দিলেন। কারণ যেভাবেই হোক ভোট লুণ্ঠন বা কৌশল করেও তিনিই ভোটে জিতেছেন। অতএব তিনিই শপথ নেবেন তৃতীয়বার রাষ্ট্রপতি হিসেবে। মঞ্চে প্রধান বিচারপতি রামোন অ্যাকুইনো যখন শপথবাক্য পড়াবেন বলে প্রথম শব্দটি উচ্চারণ করলেন, তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। কোথা থেকে ছুটে এল একটা গুলি আর নিমেষে ছিটকে দিল ট্রান্সমিটারটিকে যেটি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচার করছিল তিনটি টেলিভিশন নেটওয়ার্কে।
মার্কোস তাতেও দমলেন না। ব্যালকনি থেকে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ালেন—ঘোষণা করলেন, তিনিই আবার রাষ্ট্রপতি হয়েছেন ফিলিপিনসের।
কিন্তু সে তো কয়েক মুহূর্তের জন্যই। তারপরে সপরিবারে মার্কোসকে উঠতে হলো একটি মার্কিন হেলিকপ্টারে। কোথায় যেতে হবে নিজেও জানেন না।
এক ঘণ্টা পর হেলিকপ্টার মাটি চুল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। এখানেই কেটেছিল তার শেষ দিনগুলো। সম্পূর্ণ নির্বান্ধব, নিঃস্ব, পরামুখাপেক্ষী হয়ে যতক্ষণ না তিন বছর পর মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিল তার স্বৈরাচারীর খোলসটিকে।
১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। ভারত স্বাধীন হলো। বিভাজিত ভারত ভূখণ্ডের দিকে দিকে উড়ল তেরঙ্গা পতাকা। সেই সঙ্গে কালো পতাকাও, বিদ্রোহীদের যারা চেয়েছিলেন ভারত স্বাধীন হোক বিভাজন ছাড়াই। কিন্তু তিনি কোথাও নেই। তিনি অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী। দুদিন আগে তিনি তখন গভীর নির্জনতায় একাকী দিনযাপন করছেন বেলেঘাটার হায়দরি হাউসে। একটু আগেই একদল জনতা ঘিরে ধরেছিল হায়দরি হাউস। স্লোগান উঠেছিল গান্ধী ফিরে যাও। তুমি আশ্রয় নাও সেই এলাকায় যেখান থেকে তোমার মদতে মুসলমানরা হিন্দুদের বিতাড়িত করেছে। ইটপাটকেল পড়েছে। জানালার কাচও ভেঙেছে দু-চারটি। সঙ্গী বলতে সেই সুরাবর্দি যিনি হিন্দুদের চক্ষুশূল। গান্ধীর চোখে ঘুম নেই। নিজেই বিড়বিড় করছেন, “আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে মূল্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি, সেই স্বাধীনতা ভবিষ্যতে আরও অন্ধকারে ঢেকে যাবে। আমি হয়তো সেদিন বেঁচে থাকবো না। তবু আগামী প্রজন্ম জানুক, আমি, গান্ধীজী, জাতির জনক, এই বৃদ্ধ বয়সে কী যন্ত্রণা সহ্য করছি। গান্ধীজী ছটপট করছেন এক অকপট যন্ত্রণায়, আর কামনা করছেন, ‘মৃত্যু আসুক….. মৃত্যু আসুক। যত ভুল, যত অন্যায়, যত পাপ, সব ধুয়ে মুছে যাক। শেষ হোক এই জীবনের খেলা আর রঙ্গমঞ্চের অভিনয়। হে রাম, ক্ষমা করো আমায়।’
বিশ্বের দুটি বিখ্যাত মানুষের জীবনের দুটি খণ্ডচিত্র। মার্কোস ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই স্বৈরাচারী। আর মহাত্মা গান্ধী ছিলেন সাদা পায়রার ডানাওয়ালা এক রাজনীতিবিদ যিনি মুখে জপতেন গণতন্ত্রের মন্ত্র আর বুকের ভিতরে পোষণ করতেন স্বৈরতন্ত্রের ধ্বজা। দুজনেই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন বহুদিন আগেই।
কিন্তু স্বৈরাচারিতা মুছে যায়নি। বরং বিশ্বের বহুপ্রান্তে নতুন চেহারায়, নতুন মুখোশে আবির্ভাব ঘটছে নয়া স্বৈরাচারী রাজনীতিবিদের। তাদের একজন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
না, তিনি মার্কোসের মত বিলাসী নন। উত্তর কোরিয়ার কিম-এর মত অত্যাচারী নরপিশাচও নন। বরং তিনি দাম যতই হোক না কেন হাওয়াই চটি পরেন, দাম যতই হোক না কেন সুতির শাড়ি পরেন। খরচ যাই হোক না কেন অত্যন্ত প্রিয় ভাইদের স্বার্থে তিনি অকাতরে জনগণের অর্থ বিতরণ করেন। বিষমদ খেয়ে কেউ মরে গেলে তার পরিবার দু’ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পান এবং দুর্গাপুজোর নামে যে-কোনও পুজো সংগঠকই দশ হাজার টাকা অনুদান পান না চাইতেই পানির মতো। তিনি কন্যাশ্রী প্রকল্পে স্কুলের ছাত্রীদের বছরে ২৫ হাজার টাকা, একটা সাইকেল দেন। রূপশ্রী প্রকল্পে বিবাহযোগ্যা মেয়েদের ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। এমনকী ইমামদের দুঃখে কাতর মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত ইমামকে প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা করে ভাতা দেন। যদিও তা পুরোহিতদের দেন না। তাহলে তাকে স্বৈরাচারী বলা হবে কোন দুঃখে?
খুব ন্যায্য প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটাও এককথায় ন্যায্য। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গান্ধীর মতই মূর্তিমান এক স্বৈরাচারী যিনি গত সাত বছরে তার লুকিয়ে থাকা স্বৈরাচারী চরিত্রটিকে আর চেপে রাখতে না পেরে প্রকাশ্যে এনে ফেলেছেন এবং ধরেই নিয়েছেন, মানুষ এখনও তাকে ঘরের মেয়ে সততার প্রতিমূর্তি হিসেবেই পুজো করেন।
তাঁর স্বৈরাচারিতার লক্ষণগুলি কী কী?
আসুন এবার একটু মনোবিদদের সাহায্য নেওয়া যাক। মনোবিদরা বলছেন, একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি হলো, একনায়ক বা নায়িকা ব্যাক্তিত্ববান হন, আত্মবিশ্বাসী হন, স্বাধীনচেতা হন। আর তিনি খুব ভালোভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে জানেন। সেই সঙ্গে রয়েছে যে দুটি প্রধান লক্ষণ তা হলো ঃ তিনি প্রতিশোধপরায়ণ ও সর্বদাই যে-কোনও কাছের মানুষকেও দূরে ঠেলে ফেলতে পারেন। ফলে প্রকৃত অর্থে তার কোনো বন্ধু থাকে না। যাঁরা তাঁকে ঘিরে থাকেন তারা সুখের দিনের পায়রা। বিপদের দিনে ডানা ঝাপটে উড়ে পালান।
এবার ওই বৈশিষ্ট্যগুলি মিলিয়ে নিন পশ্চিমবঙ্গের দিদি তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি ব্যক্তিত্ববান। সেই ১৯৮৪ সালে বামপন্থী ব্যাক্তিত্ব সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে জীবনে প্রথমবার সংসদ সদস্য হওয়ার আগে থেকেই রাজ্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল তার নাম—একাধারে লড়াকু যুবনেত্রী, অন্যদিকে ঘরের মেয়ের ইমেজ নিয়ে। তারপরের ৪২ বছরের মধ্যে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তিনি তার ব্যক্তিত্বকে গড়ে তুলেছেন নিজের মতো করে। আত্মবিশ্বাসী তো বটেই। ভুল করলে, অন্যায় করলেও আত্মবিশ্বাস হারান না। স্বাধীনচেতা বরাবরই। কালীঘাটের বস্তি থেকে উঠে আসা মেয়েটা স্বাধীনচিত্ত নিয়েই যেমন কাজ করেছেন দুধের ডিপোয়, তেমনি আবার হয়েছেন ভারতের রেলমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। মানুষের সঙ্গে মেলামেশাটা তার সহজাত। পিছনে উদ্দেশ্য অবশ্যই রাজনীতি। একবার এক দৈনিকের বিখ্যাত সম্পাদক বলেছিলেন, নেতাজীর পর মমতার মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে জন্মাননি। একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও এই মতামতকে উপেক্ষা করা যাবে না। এ পর্যন্ত মোটামুটি সব ঠিকঠাকই আছে। সমস্যা হলো পরবর্তী বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়েই যেখানে মনোবিদরা বলছেন, স্বৈরাচারীরা হন প্রতিশোধপরায়ণ এবং যে-কোন মানুষকে যে কোনো সময় ঠেলে সরিয়ে দিতে পারেন। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মতো স্বৈরাচারিতার এই লক্ষণগুলিও মমতার মধ্যে কী প্রবলভাবে বিদ্যমান তা গত ৭/৮ বৎসরের নানা ঘটনাবলীতে স্পষ্টতই পরিস্ফুট।
১৯১১ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে তার দল পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিল। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের রাজত্বের অবসান হয়েছিল। নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, বদলা নয়, বদল চাই। কিন্তু আদপে হয়েছে কি? গোটা রাজ্য জ্বলেছে, জ্বলছে আজও প্রতিহিংসার আগুনে। মাঝে মাঝে মুখে স্বীকারও করে নিচ্ছেন যে প্রতিশোধের আগুনে তার বুক জ্বলে যায়। তাই ঘর জ্বলেছে বামপন্থীদের। ঘরছাড়া, পাড়াছাড়া হয়েছেন শত শত বামকর্মী। বামকর্মীদের সন্তানদের স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঘরের মেয়ে বৌদের। পরিণতি কী হয়েছে তা লেখার অপেক্ষা রাখে না। আজও হচ্ছে। বিজেপি কর্মীদের ওপর। কঠোর স্বৈরাচারীর মতোই তারই গোপন নির্দেশে বিরোধী শক্তিকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সর্বত্র। বিরোধী রাজনৈতিক শিবির মুখ খুললেই বিপদ। গ্রামে গ্রামে শুরু হয়ে যাবে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে রাজনৈতিক আক্রমণ। যেখানে সেখানে যখন তখন।
আর ঘনিষ্ঠজনদের ঠেলে ফেলার নজির তো অফুরন্ত। তারই একনিষ্ঠ সহকর্মী মদন মিত্র, তাপস পালরা চিটফান্ড কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে জেলে গিয়েছিলেন। তাঁদের দিদি একবারও খোঁজ নেননি। কুণাল ঘোষের কলম ধরে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আবার নিজেই তাকে জেলে ভরেছেন। আর যাঁর কৃপায় তিনি নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় ঘটিয়েছেন, সিঙ্গুরে তেভাগা আন্দোলন গড়েছেন, সেই মাওবাদী নেতা কিষেনজীকে গুলি করে হত্যা করে সরিয়ে দিতে তার হাত এতটুকুও কাঁপেনি। এবং সবচেয়ে যন্ত্রণার যা তা হলো কিষেনজীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করেছিলেন কিষেনজীরই ঘনিষ্ঠ নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোকে যিনি আজও প্রতিমূহূর্তে প্রস্তুত থাকেন রাজ্য পুলিসের বুলেট বুক পেতে নেবার জন্য। কারণ একমাত্র তিনিই কিষেনজী হত্যার নেপথ্য কাহিনির সাক্ষী। সাক্ষীর বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। অন্তত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিক্সনারিতে।
ফলত, তিনি যতই মনে করুন না কেন, বাংলার তিনি রাজরাজেশ্বরী, তিনি যতই মনে করুন না কেন, বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফলের সুগান গেয়ে তিনি নিজেকে বঙ্গমাতার বঙ্গজননীর আসনে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন, আসলে তিনি প্রতিদিন কিছু হারিয়েছেন। প্রতিদিন মানুষের মনের আনাচকানাচ থেকে তিনি সরে যাচ্ছেন। একজন অতিলোভী, অতিরিক্ত প্রত্যাশাবাদী রাজনীতিবিদ যিনি নিজের যোগ্যতা এবং প্রতিভা সম্বন্ধে নিজেই সম্যকভাবে অবহিত নন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব ও মানবিক আচরণ শাস্ত্রের অধ্যাপক জেমস ফ্যালেন বলেছেন—“Power, Fear and Anxiety”: সব সময় স্বৈরাচারীদের ঘিরে থাকে। “They see themselves as very special deserving admiration. They are vindictive and posses personality disorder 1”। অধ্যাপক ফ্যালেন আরও বলছেন—এঁরা (স্বৈরাচারীরা) যা নন, তাই হতে চান। সমস্যা সেখানেই নিজেদের অযোগ্যতা নিয়ে এঁরা Inferiority complex-এ ভোগেন। তাই সরকারের পূর্ণ অধিকার নিজের হাতেই রাখতে চান।
পাঠকবর্গের কাছে অনুরোধ—একটু মিলিয়ে নিন। দেখবেন, অধ্যাপক ফ্যালেনের প্রতিটি পর্যবেক্ষণ কী অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসিকতা ও আচরণের সঙ্গে। তিনি যে Inferiority Complex-এ ভোগেন, তার প্রমাণের অভাব নেই। নিজেকে পণ্ডিত মনে করলেও তিনি যে সাধারণ ইতিহাস সম্পর্কেই অজ্ঞ তার প্রমাণ তিনি বারে বারে রেখেছেন। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারেন—১৯৪৬ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান্ধীজীকে লেবুর রস খাইয়ে অনশন ভাঙিয়েছিলেন। অজ্ঞতা এতটাই যে জানেন না ১৯৪১-এই দেহান্তরিত হয়েছিলেন বিশ্বকবি। সেদিনটা ছিল বাংলামতে ২২শে শ্রাবণ। তাই প্রকাশ্য জনসভায় সাওঁতাল বিপ্লবের নায়ক সিধো কানহকে স্মরণ করতে গিয়ে ডহর বাবুর পরিবারকেও খোঁজেন। জানেন না—ডহর মানে বাগান। অথচ তিনি নাকি ‘জঙ্গলমহলের মা’। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি অতি আত্মবিশ্বাসে ভোগেন। একবারও বুঝতে পারেন না ২০১১ সালে তিনি নেতিবাচক ভোটে জিতেছিলেন। ইতিবাচক ভোটে নয়। কারণ মানুষের সামনে আর কোনও রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার চেয়ারে বসে যখন বুঝলেন, ব্যাপারটা বীজগণিতের ফর্মুলা নয়, তখন থেকেই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সন্দিহান হয়ে পড়লেন। এক ভয়াবহ উদ্বেগ থেকেই তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশ্নের মুখে জবাব দিতে না পেরে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে মঞ্চ ছাড়লেন। কামদুনীতে দুই গ্রাম্য প্রতিবাদী মহিলাকে মাওবাদী বলে প্রকাশ্যে অপমান করলেন। মেদিনীপুরে এক অতি সাধারণ গ্রামীণ যুবকের প্রশ্নের জবাব দিতে না পরে তাকে মাওবাদী বলে জেলে ভরলেন। যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে জেলে ভরলেন সামান্য একটি কার্টুন আঁকার জন্য। সবটাই নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের অভাব অথবা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকে প্রসূত উদ্বেগের ফল। ফলে সুযোগ পেলেই তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং ব্যক্তিত্বের অপমান করেন নিজেই। Personality disorder-এর চরম উদাহরণ চিটফান্ড কাণ্ডে অভিযুক্ত কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে বাঁচানোর নামে নিজেকে বাঁচানোর হাস্যকর ধরনা। যে জনগণ এত ঘটনা সত্ত্বেও মনে করতেন, মমতা অন্তত সৎ, তারাও বুঝে গেল এই ধরনা ধরনা খেলার মানে। মহাত্মা গান্ধীরও এই একই Personality Disorder ছিল। বহু সময়ে শুধু নিজেকে জাহির করার জন্য অযৌক্তিক এবং দুবির্নীত স্বভাবের পরিচয় তুলে ধরতেন কথায় কথায় ধরনা এবং অনশন করে। তার ফলাফল হয়েছিল, স্বাধীনতার প্রথম মুহূর্তে তাকে মূল অনুষ্ঠান মঞ্চের থেকে সরে যেতে হয়েছিল। আসলে একই রাজনৈতিক খেলা সব সময় Game Changer হতে পারে না—এটা গান্ধীজীও ভুলে গিয়েছিলেন। আর নিজেকে গান্ধীর সমকক্ষ বা তার চেয়েও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই ভুলই করে চলেছেন। বুঝতেই পারছেন না—রাজনীতির খেলাটা হচ্ছে অন্যত্র, তার নেপথ্যে। খেলছেন তার সঙ্গীরাই যাঁরা তাঁকে সামনে রেখে দুর্নীতির রেকর্ড ভাঙছেন প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে এবং গড়ে তুলছেন একটি ফ্রাঙ্কোস্টাইন বাহিনী যারা উদ্যত ছুরি নিয়ে একদিন মুখোমুখি হবে তার এবং সেদিন তিনি বড়জোর বলতে সময় পাবেন—ব্রুটাস, তুমিও। হ্যাঁ ব্রুটাসই—সবাই। তার চারপাশে ঘিরে থাকা রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, পুলিশকর্তা, প্রশাসনিক কর্তা মায় পরিবারের মানুষগুলোও সেদিন চরম প্রতিরোধের মুখে পড়বেন, সেদিন তাঁদের ‘ব্রুটাস’ চরিত্রগুলি জনগণ প্রকাশ্যে দেখতে পাবেন। আর দেখতে পাবেন—শেক্সপিয়ারের ট্রাজিক হিরোর মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও মানুষ কীভাবে রাতারাতি স্মৃতির মণিকোঠা থেকে মুছে ফেলছেন। (পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য)
সুজাত রায়