আমার মাথা নত করে দাও…

প্রথমত, ৭ই পৌষ ১২৯৮ বঙ্গাব্দ (২১ ডিসেম্বর, ১৮৯১) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্ম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সাল থেকে পৌষমেলা চালু হয়। প্রতিবছর ৭ই পৌষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে তিন দিনের জন্য মেলা বসে। ২০১৭ সালে পৌষমেলার বিষয়ে গ্রিন ট্রাইব্যুনালে মামলা রুজু হয়। সেই স্থানে পরিবেশবিধি মেনে পৌষমেলা প্ৰাঙ্গন ব্যবহারের কথা বলা হয়। গ্রিন বেনচের রায় অনুয়ায়ী, ১৯ অগস্ট ২০২০ সালের মধ্যে কাজ সস্পম্ন করে পরিবেশ বিশয়ক আদালতকে রিপোর্ট জমা করতে বলা হয়। সেইমতো বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী পৌষমেলা প্রাঙ্গনের চার পাশে বেড়া বা ফেন্সিং দেয়ানোর কাজ শুরু করান। এরপর শাসক দলের বিধায়ক-সহ তাঁর অনুগামীরা এই ফেন্সিং দেওয়াকে কেন্দ্র করে এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং পৌষমেলার ঐতিহ্যমিশ্রিত মূল তোরণটি ভেঙে দেয়। তবে এই প্রথমবার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়া বা ফেন্সিং দেয়ার কাজ হয়নি। ইতিপূর্বে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা ছাড়াও ছাত্র ও আবাসিকদের কথা ভেবে প্রাক্তন উপাচার্য সুজিত বসু, রজতকান্ত রায় এবং সুশান্ত দাশগুপ্তের সময় বিভিন্ন জায়গায় ফেন্সিং দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছিল। ইতিপূর্ব বিশ্ববিদ্যালয় জমি রক্ষার্থে ও নিরাপত্তার স্বার্থে ডাকবাংলো মাঠ, স্টেডিয়াম মাঠ, টাউন ক্লাব মাঠ, নিচু পট্টি হাইস্কুল মাঠ ইত্যাদি স্থানে ফেন্সিং দেওয়ার কাজ করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালির চিন্তনে-মননে, শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ান। এহুড়িও রবীন্দ্রনাথের চেতনা, তাঁর আদর্শ বাঙালির মনন ও চিন্তনশীলতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

রাজ্যের এমন ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফেন্সিং দেওয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিধায়কের নেতৃত্ব যে তাণ্ডবলীলা চালানো হুল, তার নিন্দা করার জন্য বাংলা অভিধানের কোন শব্দই যথেষ্ট নয়।

আমরা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য মারফৎ জানতে পারলাম যে, ফেন্সিং দেয়ার বিষয়টি তিনি নাকি জেনেছেন মহামান্য রাজ্যপালের কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর চিরনিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। সেজন্য মহামহিম রাজ্যপাল অতন্দ্রপ্রহরীর মতো পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছেন। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কেবলমাত্র শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পর তিনি সাহিত্যের অনবদ্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি প্রাপ্তাও। এহেন ডিলিট প্রাপ্তা, ‘রবীন্দ্রভক্ত’ মুখ্যমন্ত্রী এই ঘটনার নিন্দা করা তো দুরস্থ, উল্টে প্রেস কনফারেন্সে কিচিরমিচির করেছেন এবং তাঁর বিধায়কের নেতৃত্বে যে তাণ্ডবলীলা চলেছে, তাকে প্রকারান্তরে নটরাজের নৃত্যের সঙ্গে তুলনাও করেছেন। শুধু তাই নয়, জেলা পুলিশও নীরব ভূমিকা পালন করেছে।

পাশাপাশি উপাচার্যের দেহরক্ষীদের তুলে নেয়া হয় হয়েছে। এমনকী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষর প্রতি বিষোদ্গার করতে দলকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি-ই। অবশেষে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর তরফে বিষয়টি দেখভালের জন্য মাথায় অক্সিজেন কম যাওয়া অনুব্রত মণ্ডলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আমরা জানি, ইতিপূর্বে কলকাতায় বিদ্যাসাগর মূর্তি ভাঙার তদন্তভার স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি, মাসখানেকের মধ্যেই সেই তদন্তরে রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার একবছর অন্তিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত সে সংক্রান্ত কোন রিপোর্টই জমা পড়েনি।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদ্বজ্জন মহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠাহু। কোনও কোনও বুদ্ধিজীবী ফেন্সিং ভাঙার বিরয়টি রবীন্দ্র-বিরোধী আখ্যা দিয়ে, এই তাণ্ডবলীলার নিন্দা করেছেন। সেক্ষেত্ে রবীন্দ্রনাথের কথায় বলা হয়, ‘মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরেই দিও পরিচয়।’

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় বিধায়ক-সহ বিভিন্ন বিরোধী দলও অভিযোগ দায়ের করেছেন। এই বিষয়ে জনস্বার্থ মামলাও হয়েছে। কিন্তু, এই ঘটনা আমাদের মাথা নত করে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় বলা হয়, আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।

বোলপুর আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর কেউ কেউ মনে করছেন, রবীন্দ্রনাথকে তিনি প্রোমোট করছেন। কখনওবা মনে করা হচ্ছে, শান্তিনিকেতনের গরিমা ক্ষুণ্ণ করতেই তিনি বিশ্ববঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার স্বপ্ন দেখছেন। রবীন্দ্রনাথ একজন মানুষ নন, তিনি একটা প্রতিষ্ঠান। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্তের প্রতিবাদে তিনি ‘নাইট’ উপাধি পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সভ্যতার সংকট লিখতে পারেন। তাঁর প্রতি আমাদের এটাই প্রতিবাদের ভাষা। আর এখানেই বাঙালির আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। এই কারণেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ অবিভক্ত বাংলায় আপামর জনসাধারণকে রাখীবন্ধনের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের বিশ্বভারতী তথা ভারত ও বিশ্ববাসীর গরিমা আজ আক্রান্ত। আজ আক্রান্ত বাঙালি, আজ আক্রান্ত ভারতবাসী। বিশ্ব নাগরিক হিসাব এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমাদের সবাইকে সামিল হতে হব। না হলে এই আঘাত একদিন আমাদের সকলের ওপরে নেমে আসবে।

আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে যে, বিশ্বভারতী নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পদ এমনকী, স্ত্রী মৃণালিনীদেবীর অলংকার পর্যন্ত বিক্রি করছিলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ বিশ্বভারতীর নির্মাণে মুক্ত হস্তে দান করেছিলেন, তা যেন আমরা ভুলে না যাই। আজ যাঁর বাঙালি-অবাঙালি, বাংলা, হিন্দিভাষী, গুজরাতিভাষী সঙ্গে অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের বিভেদ করানোর চেষ্টা করেন, তখন তাঁরা ভুলে যান, হিন্দি ভবন-সহ বিভিন্ন বিদেশী ভাষা শিক্ষা তথা চিনা, জাপানি ভাষা শিক্ষার কেন্দ্রস্থল হয়েছে শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন রচনাই করেননি, আমাদের ভাষা আন্দোলন উৎসারিত করেছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথেরই রচনা। জাপান যাত্রী থেকে চীনির মারণ ব্যবসা, সভ্যতার সংকট, জাতীয়তাবাদ সমস্ত প্রবন্ধে তিনি শুধু ভারতের নাগরিকই নন, তিনি বিশ্ব নাগরিক। ভারতের বেদ উপনিষদ ও ভারতীয় মূল্যবোধ থেকে তিনি যে ধর্মের জন্ম দিয়েছেন তা হল, মানবধর্ম। তিনি বলেছেন, জলের ধর্ম যেমন জলোত্ত, আগুনের ধৰ্ম তেমনই আগুনত্ব, আর মানুবর ধর্ম মনুষ্যত্ব।

আমি দেখলাম ১৭ অগস্ট ২০২০-এ এক উন্মত্ত দানবের উল্লাসে তাঁর মানবধৰ্ম পদদলিত হল। আমাদের মনে পড়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের বহু স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ পাক হানাদাররা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, ঠিক একই চিত্র। আমাদের মনে পড়ে, প্রায় হাজার বছর আগে কীভাবে ১১৯৩ সালে, হানাদার ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজির নেতৃত্বে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নালন্দাকে ধ্বংস করেছিল।

পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের কথায় আসি, যারা দস্যুবৃত্তি করেছে, মানবের পথ আগলে আছে, মানবের ইতিহাসে তারা সম্মানের যোগ্য নয়। এ আশা দুরাশা নয়, বিনাশের শক্তি মানুষের ইতিহাসের শেষ কথা হতে পারে না।

সব ঘটনা পর্যালোচনা করে রবীন্দ্রনাথের বঙ্গমাতা কবিতার রেশ টেনে বলতে হয়, পশ্চিম বাংলায় দাঁড়িয়ে আবার কি নতুন করে বলতে হবে, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননি, রেখেছ বাঙালি করে-মানুষ করোনি’!

ডঃ পঙ্কজকুমার রায়

লেখক: অধ্যক্ষ, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.