হিন্দুদের আচারব্রতে আছে বারো মাসে অজস্র ব্রতের মাহাত্ম্য কথা। তারই একটি হল, অক্ষয় তৃতীয়া ব্রত, যা পালিত হয় বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে। এই ব্রতে আছে এক কিপ্টে বামুন ও তার স্ত্রীর অক্ষয় পুণ্যলাভের গল্প। যে গল্পে,
এক ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত পথিক কিপ্টে বামুনের বাড়িতে এসে জল ও খাবার চাওয়ায় কিপ্টে বামুন তাকে আচ্ছা করে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। কিপ্টের বউ বাড়িতে ছিল না, তাড়িয়ে দেওয়ার মুহূর্তে সে হাজির হল সেখানে। অপমানিত হয়ে বেচারা পথিক চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু কিপ্টের বউ ধর্মপরায়না, সে অনুনয় বিনয় করে কিপ্টের অপমানের জন্য ক্ষমা চেয়ে পথিককে দাওয়ায় বসতে দিল, জল দিল, খাবার খেতে দিল। তার আতিথ্যে তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করে পথিক চলে গেল। তখন কিপ্টেকে খুব বকাবকি করলো বউ। জানালো, অক্ষয় তৃতীয়ার মাহত্ম্যের কথা। এদিন কারও অন্নজলের প্রার্থনা ফেরাতে নেই। ফেরালে পাপ, আর পূর্ণ করলে হয় অক্ষয় পুণ্য।
অক্ষয় তৃতীয়ায় হিন্দু ব্রতের মধ্যে এই যে দানসেবায় পুণ্যলাভের ধারণা, এই ধারণারই সমর্থন পাওয়া যায় জৈনদের ধর্মীয়গ্রন্থ ‘আদিপুরাণ’-এর একটি গল্পে।
জৈনদের প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভদেব। তিনিই ‘প্রথম’ ছিলেন বলে তাঁকে আদিনাথও বলা হয়। তীর্থঙ্করেরা হলেন ধর্মের শিক্ষক বা পথ প্রদর্শক। রাজপরিবারের জন্ম না-হলে তীর্থঙ্কর হওয়া যায় না। তাই ঋষভদেবও জন্ম নিয়েছিলেন রাজ পরিবারে, অযোধ্যায় রাজা নাভি আর রানি মরুদেবীর ঘরে। দিনটা ছিল চৈত্র মাসের কৃষ্ণা নবমী তিথি।
ঋষভদেব যখন রাজা হলেন, তখন প্রবল পরাক্রমে তিনি পৃথিবী জয় করেছিলেন। সেই পরাক্রমে তিনি স্বর্গের দেবতাদেরও প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। পৌরাণিক হিন্দু দেবদেবীদের অনেকেই স্বনামে জৈনধর্মের উপাসনায় স্বমহিমায় স্থান পেয়েছিলেন। এঁদেরই একজন স্বর্গের অধিপতি ইন্দ্র। তিনি ছিলেন ঋষভদেবের পরম মিত্র। একদিন তিনি ঋষভদেবকে আমন্ত্রণ জানালেন স্বর্গে, তাঁর সভায়। আয়োজন করলেন নৃত্যগীতের।
সেদিন অপূর্ব সাজে সেজে উঠেছিল ইন্দ্রের সভা। সভায় সিংহাসনে বিরাজ করছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র, তাঁর ডানদিকের আসনে ছিলেন অতিথি-সখা ঋষভদেব। আর সভার আসনসকল পূর্ণ করে বিরাজ করছিলেন স্বর্গের দেবতারা। প্রথমে গন্ধর্ব-কিন্নরেরা শোনালেন অপূর্ব সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতে মুগ্ধ হলেন সকলে। তারপর সেখানে নাচ দেখাতে এলেন স্বর্গের অপ্সরা নীলাঞ্জনা। সমস্ত অপ্সরাদের থেকে সুন্দরীতমা তিনি। তাঁর রূপে বিদ্যুতের ছটা, সেই ছটায় যেন দশদিক আলোকিত। সেই রূপের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না।
দেবতাদের প্রণাম জানিয়ে সেই অনিন্দ্যসুন্দরী নীলাঞ্জনা শুরু করলেন নাচ। সবে মাত্র তিনি নৃত্যের উপস্থাপনাটুকু শুরু করেছেন, হঠাত নাচের মাঝেই তিনি স্থির হয়ে গেলেন। যেন একেবারে স্পন্দনহীন। সমস্ত তালবাদ্য থেমে গেল তাঁকে স্থির দেখে। আর তক্ষুনি তিনি বিলীন হলেন পঞ্চভুতে। ঘটনাটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। সভার নীরবতার মাঝে দেবরাজ শুধু জানালেন, নীলাঞ্জনা মারা গিয়েছে। পরমায়ু তার সামান্যই বাকি ছিল, সেও নৃত্যের মাঝে শেষ হল, নর্তকীর জীবনে নাকি এ এক পরম সৌভাগ্য।
ঋষভদেব ভাবতে লাগলেন, অপ্সরা নীলাঞ্জনা, তার অপূর্ব দেহকান্তি, অসাধারণ সৌন্দর্য, স্বর্গের সুখ সমস্তই তাহলে ক্ষণস্থায়ী! সমস্তই নশ্বর! তাহলে এই যে তাঁর বিপুল পরাক্রম, অতুল সম্পদ, পৃথিবী জোড়া রাজপাট এসবও তো নশ্বর। সেই নশ্বরের পিছনে চিরকাল ছুটে লাভ কি! এই ভাবনা থেকেই তাঁর মনে বৈরাগ্য এলো, জীবনের মানে খুঁজতে নশ্বরতা পেরিয়ে অবিনাশীকে খুঁজতে তিনি পুত্রদের মধ্যে রাজ্যপাট বিলিয়ে দিয়ে সংসার ত্যাগ করার সংকল্প নিলেন। সেই সংকল্পের পথে বেরিয়ে এসে এক চৈত্রের কৃষ্ণা নবমীর দিন তিনি সন্ন্যাস নিলেন।
সন্ন্যাস নিয়ে ঋষভদেব দীর্ঘ এগারো মাস তের দিন তপস্যায় নিমগ্ন হলেন এক নির্জন তপোবনে। এই সময় তিনি গ্রহণ করলেন না কোন আহার। একদিন তপস্যা ভঙ্গ হল, তিনি খুঁজে পেলেন ধর্মের পথ। দিনটা ছিল বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়ার দিন। এদিনই তিনি উপবাসভঙ্গের জন্য পা রাখলেন জনপদের পথে। কিন্তু তিনি দিগম্বর সন্ন্যাসী, তাই অভুক্ত শরীরেও কারো কাছে আহার প্রার্থনা করলেন না। তখনও সাধারণ মানুষ জানতেন না, দিগম্বর সন্ন্যাসীর সৎকার কীভাবে করতে হয়। তাই জনপদে এসে আহার প্রার্থনা করলেন না বলে, কেউ তাঁকে খাবার দিতেও এগিয়ে এলো না। ফলে সেই অভুক্ত শরীরেই ঋষভদেব অনেক জনপদ ঘুরে পথ চলতে চলতে এসে পৌঁছলেন হস্তিনানগরে। সেখানকার রাজা ছিলেন শ্রেয়স। কেবল তিনিই জানতেন দিগম্বর সন্ন্যাসীর সৎকারের উপায়। ঋষভদেব তাঁর নগরের পথে পা রাখতেই তিনি যেন পেলেন কোন এক দিব্য নির্দেশ। সভা ছেড়ে ছুটে এলেন পথে। বরণ করে নিয়ে গেলেন সন্ন্যাসীকে। পান করতে দিলেন আখের রস। শ্রেয়সের দেওয়া এই পানীয় খেয়েই এদিন ভঙ্গ হয়েছিল ঋষভদেবের দীর্ঘ উপবাস।
সেই থেকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটি জৈনধর্মের মানুষের কাছে ধর্মপথে পানীয়-আহার দানে পুণ্য অর্জনের দিন। এই যে অক্ষয় তৃতীয়ায় দান ও সেবার মধ্য দিয়ে মনুষ্যধর্ম পালনের শিক্ষা, এর মাধ্যমেই হিন্দু ও জৈনধর্ম এদিন মিলেমিশে এক হয়ে যায়।