বাঙালি সম্পর্কে বলা হয়, তারা যুদ্ধ-ভীত, পলায়নপর একটি গোষ্ঠী। তারা কেবল পালাতেই জানে, নিজের ভিটেমাটি ধরে রাখতে পারে না; হিংস্র জন্তুর মত একটি গোষ্ঠী কেড়ে নেয় তার বসত বাড়ি, তার গৃহের নারী, ধন-সম্পদ। কিন্তু বাঙালির এমন হীনমন্যতা তো ছিল না! যথেষ্ট লড়াকু ছিলো বাঙালি, বিশেষ করে বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ।
বাংলার ছড়ায় রয়েছে তারই Missing Link “আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে;/ঢাক মৃদঙ্গ ঝাঁঝর বাজে/বাজতে বাজতে চললো ঢুলী/ঢুলী যাবে সে কমলা পুলি।..” অর্থাৎ সেনাবাহিনীর আগেও ডোম চলেছে, পিছনেও ডোম-বাহিনী, ঘোড়ায় চড়েছে ডোম; তারাই আবার যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধবাদ্য নিয়ে উপস্থিত সেনাদলে, সেনাদের উৎসাহিত করতে।
বাংলায় নানান ক্ষত্রিয় সমাজ ছিলো বীরের বংশধর। তারা নানান পেশায় নিয়োজিত থাকলেও যুদ্ধের ডাক পরলে নিমেষে হাজির হয়ে যেতো রণাঙ্গনে। জাত-পাতের নামে তাদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে একটি সুবিধাবাদী, ছদ্ম-সেকুলার-চক্র বিগত দু-আড়াইশো বছর বাঙালির যোদ্ধৃত্ব রূপ মুছে দিয়ে নিজেদের আগ্রাসী রূপ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য পেয়েছে। তাতে বাঙালি ক্রমেই দুর্বল ও পলায়নপর জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এমন ইতিহাস বাঙালির তো নয়! বঙ্গদেশে শিশু-ক্রীড়ার মধ্যেও যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করা হত — “আগডুম বাগডুম” খেলা — তারই একটি নিদর্শন। বাংলার লৌকিক যুদ্ধ-নৃত্যও তারই মিসিং লিঙ্ক।
“আগডুম বাগডুম” খেলায় শিশুরা গোল হয়ে বসে একে অন্যের হাঁটু স্পর্শ করে, ছড়া কেটে যেমন খেলতো, তেমনই ছিল তাদের পরবর্তী জীবন — ভবিষ্যতের যোদ্ধৃত্ব রূপ। জীবনের সকল ক্ষেত্রে লড়াই-সংগ্রামের প্রেরণা শিশুমনে গেঁথে যেতো।
যেটুকু খেলার/আয়োজনের ছিল বাকী, বাংলার লৌকিক ক্রীড়াগুলি শেষ করে দিয়ে বাঙালি হারিয়েছে তার স্বভাব-গুণ, আর পালিয়ে এসেছে তার জমি-জিরেত থেকে। দৌড় দৌড় দৌড়…. এ জেতার দৌড় নয়……কাপুরুষোচিত দৌড়, পরাজিতের প্রাণ বাঁচানোর দৌড় আর আর্তনাদ।
কল্যাণ গৌতম