এই কি শেষকৃত্যের অধিকার পশ্চিমবঙ্গে!

বডিগুলো দেখে পথ দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যায় মৃত কোনো বেওয়ারিশ লাশ মনে হল না। তার কারণ, এই ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রত্যেকটি লাশের ছবিকে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখার পরেও পেট, বুক ও মাথায় এই তিন জায়গায় কাটাছেঁড়া ও পরবর্তীতে সেলাইয়ের কোনো চিহ্ন দেখলাম না!!

https://www.facebook.com/100016692693608/posts/691558458077238/

বেওয়ারিশ লাশের সৎকার ঘিরে বিতর্ক শুরু হয় রাজ্যজুড়ে। বুধবার সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, গড়িয়ার আদি মহাশ্মশানে একজন কর্মী আঁকশি দিয়ে টেনে পচা-গলা মৃতদেহ গাড়িতে তুলছেন। সেই গাড়িটির গায়ে কলকাতা পুরসভা লেখা রয়েছে। এই সমস্ত মৃতদেহগুলি করোনা আক্রান্ত সন্দেহে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে স্থানীয়রা। বাধ্য হয়ে পুনরায় সেই দেহগুলিকে গাড়িতে করে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও এই মৃতদেহগুলি সঙ্গে করণ আর কোনও সম্পর্ক নেই বলেই স্পষ্ট জানিয়ে দেয় স্বাস্থ্যদফতর। এদিকে প্রশ্ন উঠতে থাকে বেওয়ারিশ লাশ কী করে গড়িয়া মহাশ্মশানে দাহ করার জন্য আনা হল।

এই ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই বিতর্ক শুরু হয়ে যায় রাজ্যজুড়ে। যদিও তারপরেই এবিষয়ে কলকাতা পুরসভার একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ্যে আসে। ওই বিজ্ঞপ্তি ২৯শে মে প্রকাশ করে কলকাতা পুরসভা। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পুর কর্তৃপক্ষ বেওয়ারিশ লাশ পোড়ানোর জন্য গড়িয়ার আদি মহাশ্মশানকে চিহ্নিত করেছে। এই বিজ্ঞপ্তিতে সই রয়েছে কলকাতা পুরসভার চিপ মিউনিসিপাল হেলথ অফিসর। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এতদিন পর্যন্ত বেওয়ারিশ লাশ পোড়ানোর জন্য ধাপার পরিত্যক্ত স্থানকে ব্যবহার করা হত। এখন যেহেতু ধাপায় করোনায় মৃত হিন্দুদের দেহ পোড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে বেওয়ারিশ লাশ পোড়ানোর জন্য গড়িয়া মহাশ্মশান ও নিমতলা শ্মশানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এরপরেই শুক্রবার দুপুরে এনআরএস হাসপাতালের তরফে জানানো হয়, এই লাশগুলি ছিল এনআরএস হাসপাতালের মর্গে। সবকটাই ছিল বেওয়ারিশ লাশ। ১৫ দিন ধরে লাশ গুলি হাসপাতালের মর্গে ছিল। কোনও দাবিদার না থাকায় এদিন মোট ১৪টি বডি কলকাতা পুরসভার হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এই লাশগুলির সঙ্গে কোভিড যোগ নেই। এরপরেই এনআরএস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে চিঠি দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে। চিঠিতে জানানো হয়েছে, গড়িয়া মহাশ্মশানে যে বডিগুলি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেগুলো বেওয়ারিশ লাশ ছিল। কিন্তু কোভিড পজিটিভ ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় মৃতদেহগুলি কোভিদ পজিটিভ বলে যে প্রচার চলেছে তা ফেক। এই প্রচারের নেপথ্যে যারা রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে।

অন্যদিকে, একইভাবে মৃতদেহগুলির সঙ্গে কোভিড যোগ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর, এমনটাই খবর পুলিশ সূত্রে। জানা গিয়েছে, স্বাস্থ্য দফতরের তরফে পুলিশকে অফিশিয়ালি জানানো হয়েছে ওই দেহগুলি কোনও ভাবেই করোনা আক্রান্তদের মৃতদের দেহ নয়। সেগুলি বেওয়ারিশ লাশ। গতকাল পুরসভার গাড়িতে ওই দেহগুলি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা এলাকা জল দিয়ে ধোয়া হয়। এরপরে এদিন জীবাণুমুক্ত করা হয় গোটা শ্মশান চত্বর। কিন্তু লাশ গুলো কোথায় গেল ? হারিয়ে তো যায় নি? 

আমরা কথ্য ভাষায় ‘লাশ পোড়ানো’ বলি, কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় এটা ‘অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া’। এটা আবার কী? অন্ত+ইষ্টি=অন্ত্যেষ্টি। ইষ্টি মানে যজ্ঞ। অন্ত্যেষ্টি হলো জীবনের শেষ যজ্ঞ।
আমরা জানি, আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ ছিল যজ্ঞপ্রধান। জীবনের শুরু ‘গর্ভাধান’ থেকে জীবনের শেষ ‘দেহত্যাগ’ সবই হতো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। জীবৎকালে প্রতিদিনই পঞ্চমহাযজ্ঞ করতে হতো (এখনও করার বিধান)। এছাড়া অগ্নিহোত্র যজ্ঞের মতো বিবিধ যজ্ঞে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ‘হবি’ (বর্তমানে পূজায় অর্ঘ্য নিবেদনের মতো) উৎসর্গ করা হতো। এ হলো ঈশ্বরের দেয়া জীবন ও দেহ দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির উপাদানসমূহ ভোগ করার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতাপূর্বক তাঁর উপাসনা করা। তাই অন্ত্যেষ্টি তথা জীবনের শেষ যজ্ঞে ঈশ্বরপ্রদত্ত এই দেহখানি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই ‘হবি’ বা অর্ঘ্যরূপে উৎসর্গ করা হয়। এটা সত্যিই চমৎকার একটা ব্যাপার!


প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী বিশ্বচরাচর তথা আমাদের দেহও পাঁচটি ভূত বা উপাদান দ্বারা তৈরি। একে ‘পঞ্চভূত’ বলে। এগুলো হলো- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস), ব্যোম (আকাশ বা শূন্যস্থান)। যারা বলেন ‘মাটির দেহ’ বা দেহ শুধু মাটি দিয়ে তৈরি, তাই একে মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া উচিৎ, তারা অবশ্যই ভুল বলেন। বাস্তবে দেহ এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। শবদাহ করার মাধ্যমে দেহকে এই ৫টি উপাদানেই মিশিয়ে দেয়া হয় প্রত্যক্ষভাবে। দাহ শেষে অবশিষ্টাংশ জলে বিসর্জন দেয়া হয়। এজন্য শ্মশান সর্বদাই জলাশয়ের পাশে হয়ে থাকে।
অপরদিকে সমাধি বা কবর দিলে দেহ পঞ্চভূতে লীন হয় বটে, তবে পরোক্ষ ও ধাপে ধাপে। কারণ দেহ মাটির সাথে মেশে পঁচন প্রক্রিয়ায়। কোটি কোটি অনুজীব, পোকা-মাকড়ের খাবারে পরিণত হয় দেহ। এভাবে পঁচে গলে মাটিতে মেশানোই বরং দাহ করার চেয়ে বেশি অমানবিক মনে হয়।
একটা মজার তথ্য দিই। অনেক সময় আমরা বলি, লোকটা তো মরে ভূত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সে প্রকৃতিতে (পঞ্চভূতে) লীন হয়েছে -এটাই বুঝতে হবে।
 মৃত্যু হয় দেহের; আত্মার নয়। অবিনাশী আত্মা অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। এটা জগদীশ্বর পরমাত্মার অংশ। (‘বিদ্রোহী’ কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে কি?) জড় প্রকৃতির পঞ্চভূতে গড়া দেহ ফিরে যায় পঞ্চভূতে, আর জীবাত্মা ফিরে যায় পরমাত্মাতে। (মৃত্যুর পরে অবশ্যই আর কখনোই আপনি পুরনো দেহে ফিরে আসবেন না, বা কোন প্রকার শাস্তি/আজাব ভোগ করবেন না। শবদাহ করার পরে/মাটিতে মিশে যাওয়ার পরে নিশ্চয়ই লীন হওয়া দেহকে শাস্তি/আজাব যৌক্তিকভাবে সম্ভব নয়।)
মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শোকের কোন ব্যাপার নয়। তীর্থস্থান বেনারস বা কাশীতে মৃত্যুও একটা উৎসবের ব্যাপার।
“জাতস্য হি ধ্রুবর্মৃত্যো ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ”-গীতা।
যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরেছে তার জন্মও নিশ্চিত।

অতএব, দেহান্তরের নিছক সাধারণ ঘটনায় শোক কেন? বরং জরাজীর্ণ রোগশোকে আক্রান্ত দেহ ছেড়ে জীবাত্মার নতুন সুস্থ-সুন্দর দেহে জীবন আরম্ভের প্রাক্কালে মৃতকে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানানোই উচিত।

তবে , উক্ত মৃতদেহ গুলির তো শেষকৃত্যের  অধিকার ছিল?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.