আজ যখন গোটা ভারতবর্ষে লোকসভার ভোটপর্ব মধ্য গগনে, তখন চতুর্দিকে তাকালে মনে হচ্ছে গেরুয়া আঁধির এক অত্যাশ্চর্য মায়াবী আলোয় ভাসছে ভারতবর্ষ। সে আলো ২০১৪-র চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল, অনেক বেশি উচ্ছল। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং, বোধহয় বলাই ভালো পশ্চিমবঙ্গে এবারের গ্রীষ্মে কালবোশেখি নয়, চলছে গেরুয়া ঝড়। কোচবিহার থেকে ডায়মন্ডহারবার। আর সেই গেরুয়া ঝড়ে সম্পূর্ণ অবিন্যস্ত বাকি সব রঙ-সবুজ, লাল কিংবা তেরঙা। এবং সর্বত্র। বিশেষ করে যেখানে সশরীরে হাজির এযাবৎকালের ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। প্রত্যেক জনসভায় এই চড়া গ্রীষ্মেও জনপ্লাবন খোলা মাঠে। না, এখন আর মানুষ হেলিকপ্টার দেখতে ভিড় জমায় না। তাই হেলিকপ্টার নামিয়েও খালি ফাঁকা ময়দান থেকে ফিরে যেতে হয় তৃণমূল প্রার্থী তথা তারকা দেবকে। আর রাণাঘাটে, জগদ্দলে, শিলিগুড়িতে কোচবিহারে বিজেপির জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে ভিড় জমান লক্ষ লক্ষ মানুষ। না এজন্য কোনও গোয়েবলসকে দরকার হয় না। জনতার চোখ আর গণমাধ্যমের ক্যামেরার চোখই চিনিয়ে দেয়, চ্যালেঞ্জমুখী তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় একই অঞ্চলের সভায় ভিড় কতটা আর জনতার হাততালি ও সমবেত কণ্ঠের স্লোগান কার সভাকে উজ্জ্বল করে তোলে বেশি— মমতার নাকি মোদীর! পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এ এক নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। একদিকে যখন ভোটের দিনগুলিতে শাসকদলের আস্ফালনের তিরে বিদ্ধ হচ্ছে সাধারণ ভোটাররা, তখন বিজেপির পতাকা হাতে নিয়ে জনগণ কোনও নেতৃত্ব ছাড়াই প্রতিবাদে আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের প্রশাসনেও সরকার-বিমুখ জনগণ এভাবে ভোটের দিন সঙ্ঘবদ্ধভাবে বিরোধিতায় পথে নামেনি। সাহস করেনি শাসক দলের সামনে লাঠি তুলে বলতে—এক পা এগোও, তোমায় বুঝিয়ে দেব বাংলার মাটি সত্যিই মা মাটি মানুষের। শুধু তোমাদের দিদির স্লোগানের নয়। এবার মরা গাঙ্গে বান এসেছে। হাল ধরেছেন মোদী। গেরুয়া ঝড়ে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ এবার নতুন ইতিহাস রচনার পথে শাসকদল মানেই গায়ের জোর। সেই গায়ের জোরেই ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে বিজেপির পতাকা, হোর্ডিং। জায়গায় জায়গায়। প্রার্থীদেরও আক্রমণ করা হচ্ছে। মুছে দেওয়া হচ্ছে দেওয়াল লিখন। কিন্তু জনতা এবার যেন ফিনিক্স পাখি হয়ে উঠেছে রাতারাতি। ধ্বংসের আবহাওয়া পুনর্জন্ম নিয়ে জেগে উঠছে জনতা। দিগবিদিক মাতাল করে আওয়াজ উঠছে— ভারতমাতা কী জয়, মোদীজী জিন্দাবাদ।
অর্থাৎ এক এক দফার ভোট শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গে স্পষ্টতইছড়িয়ে পড়ছে। একটি দুরন্ত বার্তা—‘অ্যাডভানটেজ বিজেপি। অর্থাৎ সপ্তদশ নির্বাচনের হাওয়া পুরোপুরি বিজেপি অনুকূলে জোরদার হচ্ছে প্রতিদিন। সমীক্ষক সংস্থাগুলি গত দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর এবার ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে যেসব সমীক্ষাগুলি জনগণের দরবারে পেশ করেছেন, তাতেও দেখা গেছে। বিজেপির পক্ষে ইতিবাচক ফলাফলের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এখন তো সমীক্ষকরা বলতে শুরু করেছেন বিজেপি একক ভাবে শুধু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই পাবে না, এবার আসনসংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে যা এযাবৎকালে গেরুয়া রাজনীতিতে নজিরবিহীন।
হিসেবের গভীরে পৌঁছনোর আগে মাথায় রাখতে হবে, ২০১৪ সালে এ রাজ্যে চলছিল তৃণমূল কংগ্রেসের হাওয়া নয়, সাইক্লোন। সেই পরিস্থিতিতেও কিন্তু বিজেপি রাজ্যের ২১টি আসনে গড়ে প্রায় ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সেই কেন্দ্রগুলি ছিল : দার্জিলিং, আসানসোল, আলিপুরদুয়ার, কৃষ্ণনগর, কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ, বারাসাত, দমদম, শ্রীরামপুর, ব্যারাকপুর, হাওড়া, বালুরঘাট, বাঁকুড়া, মালদা দক্ষিণ, বনগাঁ, বীরভূম, বসিরহাট, রায়গঞ্জ, বর্ধমান, দুর্গাপুর, রানাঘাট ও জলপাইগুড়ি। দার্জিলিংঙে ৪৩.৪ শতাংশ আর আসানসোলে ৩৭.১ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিল বিজেপি। উল্লেখযোগ্য ফল হয়েছিল আলিপুরদুয়ারে (২৭.৯ শতাংশ), কৃষ্ণনগরে (২৬.২ শতাংশ), কলকাতা উত্তরে (২৬.১ শতাংশ), কলকাতা দক্ষিণ (২৫.৭ শতাংশ), বারাসাতে (২৩.৬ শতাংশ)। ভোট হয়েছিল মূলত রাজ্য পুলিশের তত্ত্বাবধানে। ভোট লুট হয়েছিল অবাধে। এমনকী বিধাননগরের মতো অতি সচেতন অঞ্চলেও বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মারধোর করা হয়েছিল।
এবার রাজ্য পুলিশ কম। আধা সেনা বেশি। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, অন্যান্য সব আসনের মতোই এই আসনগুলিতে বিজেপির ভোট বাড়বে বেশ কয়েক শতাংশ। কারণ রাজ্য জুড়ে মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী তথা শাসকদল বিরোধী ঝড়ের প্রাবল্য প্রমাণ করে দেয় রানাঘাটে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় উপস্থিত জনতার ড্রোন-ফটোগ্রাফ।
শুনলে অবাক লাগলেও এবার ভোটের ‘অ্যাডভানটেজ বিজেপি’র অন্যতম ফ্যাক্টর হলো সংখ্যালঘু ভোট। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে হিন্দু ভোটের সংখ্যা মোট ভোটারের ৭১.৩৫ হলো ২৭.৩৫ শতাংশ। অন্যান্য ভোট রয়েছে। ১.৩০ শতাংশ। ৩০ শতাংশের বেশি মুসলমান ভোট রয়েছে এমন লোকসভা কেন্দ্র এ রাজ্যে মোট ১৩টি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমান ভোটার বহরমপুরে ৬৪ শতাংশ, জঙ্গীপুরে ৬০ শতাংশ, মুর্শিদাবাদে ৫৯ শতাংশ, রায়গঞ্জে ৫৬ শতাংশ, বসিরহাটে ৪৪ শতাংশ, মালদা উত্তরে ৫০ শতাংশ, মালদা দক্ষিণে ৫৩.৪৬ শতাংশ। এছাড়া বীরভূম, যাদবপুর, মথুরাপুর, কৃষ্ণনগর, ডায়মন্ডহারবার এবং জয়নগর কেন্দ্রে ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশ মুসলমান ভোটার রয়েছে। এতদিন বেশি মুসলমান ভোট পেত কংগ্রেস ও তৃণমূল। তারপর বামদলগুলি। এবার এইসব বিরোধী দলগুলিই এককভাবে লড়ছে। অর্থাৎ মুসলমান। ভোট তিন ভাগ হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মুসলমানরা এখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন। সেই আশঙ্কা থেকেই একাংশ সরাসরি ভোট দেবে বিজেপিকে। তার ওপর আছে ত্বহা সিদ্দিকির মতো ইমামদের চোখ খুলে দেওয়া বক্তৃতা যে মমতা সরকার মুসলমানদের জন্য কোনো উন্নয়নই করেনি। তার প্রভাব পড়বে।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে ১৯টি কেন্দ্রে জয় পরাজয় নির্ধারণ হয়েছিল মাত্র ১০ থেকে ১১ শতাংশ ভোটের মার্জিনে। এবারে কি হবে? ২০১৪ সালে বামেদের ভোট শতাংশ ছিল ২০-র নীচে। কংগ্রেস মুসলমান ভোট নিয়েও পেয়েছিল মোট ৬ শতাংশ ভোট। এবার ভোটে বামেদের ভোট আরও কমবে এবং তা পড়বেতৃণমূল বিরোধী ভোট হিসেবে বিজেপির। ভোট ৬ শতাংশ রয়ে গেল, তাহলেও একথা জোর গলায় বলা যায় ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোটারের একটা বড়ো অংশ যারা তৃণমূলের সমর্থক হিসেবেই পরিচিত ছিল এবার তারা শিবির বদল করবেই। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর মুসলমান তোষণের রাজনীতি। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গটা বাংলাদেশ হয়ে যাবে না তো? হিন্দুরা তাই এবারে সমস্বরে আওয়াজ তুলেছেন—মোদীকে চাই। কারণ মোদীই হতে পারেন হিন্দুদের রক্ষাকর্তা। যতই মেকি বিপ্লবী আর বুদ্ধিজীবীরা ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আউড়ে মোদী বিরোধী স্লোগান তুলুন না কেন, এবার হিন্দুভোট অনেক বেশি ইতিবাচক হারেই বিজেপিকে সমর্থন জোগাবে। ২০১৪-য় ১৯টি আসনে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়েছিল ১০ থেকে ১১ শতাংশ ভোটের মার্জিনে। এই আসনগুলিতে তৃণমূল যদি ১০ শতাংশ ভোট কম পায় তাহলে ১৭টি আসনে তৃণমূলের হার নিশ্চিত। সেই সঙ্গে রয়েছে ১১টি আসন যেখানে বিজেপি ১০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল হুগলি (১৬.৬শতাংশ), কোচবিহার (১৬.৫শতাংশ), ডায়মন্ডহারবার (১৬.১ শতাংশ), মালদা উত্তর (১৫.৫ শতাংশ), বোলপুর (১৫.৩ শতাংশ), মেদিনীপুর (১৪.৫ শতাংশ), বিষ্ণুপুর (১৪.৪ শতাংশ), বর্ধমান পূর্ব (১৩.১ শতাংশ), যাদবপুর (১২.৪ শতাংশ), আরামবাগ (১১. ৮ শতাংশ), উলুবেড়িয়া (১১.৬ শতাংশ)। এর প্রতিটি আসনেই বিজেপির ভোট বাড়বে।
_ ০৭ মতো আসনে বিজেপির জয় প্রায় নিশ্চিতই। বিজেপির ভোট বাড়া মানেই তৃণমূলের ভোট কমা। তাছাড়া রাজ্য জুড়ে চতুর্মুখী লড়াইয়ে ক্ষতি বেশি হবে তৃণমূলেরই। কারণ বামপন্থী দলগুলি এবং কংগ্রেস থেকে ছিটকে আসা সব ভোটই এবার পড়বে বিজেপিতে। তৃণমূল থাকবে। ব্রাত্য। কারণ— ১। মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যাচার, ২। মুখ্যমন্ত্রীর অগণতান্ত্রিক কেন্দ্র বিরোধিতা, ৩। কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে রাজ্যের প্রকল্প বলে চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া, ৪। জনগণের অর্থ ব্যক্তিগত তহবিলের মতো ক্লাব, পুজো, ইমাম ভাতা, বিষ মদে মৃত্যুর ক্ষতিপূরণে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া। ৫।মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারে বিদেশি নাগরিকের বসবাস, ৬। মুখ্যমন্ত্রীর ভাই ও ভাইপোদের দুর্নীতি ও আর্থিকরমরমা, ৭।ভঙ্গুর দলীয় সংগঠন ও অন্তর্দ্বন্দ্ব, ৮ | সারদা ও নারদা কাণ্ডে শীর্ষস্থানীয় তৃণমূল নেতা ও সরকারি আমলাদের যোগাযোগ, ৯ | প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ, ১০। তৃণমূল ক্যাডারবাহিনীর অত্যাচার। এর সঙ্গে অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে থাকছে—বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি, সহনশীল ও বাস্তবমুখী নেতৃত্ব এবং রাজ্যের মানুষের জাগ্রত বোধশক্তি যে অকারণে কেন্দ্র বিরোধিতা মানে নিজের রাজ্যের ক্ষতিসাধন করা। তাই রাজ্যের শাসকদল রাজ্যকে যত বেশি বিরোধীমুক্ত করতে চাইবে, ততবেশি শক্তিশালী হবে বিজেপি জনসমর্থনের জোয়ারে। তার প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত বিজেপি তথা মোদীজীর পক্ষে প্রচারের ঢল। উলঙ্গ রাজা’র রাজনীতির ধরাচূড়া ছিড়ে ফেলছে মানুষ প্রতিদিন। এখন দরকার শুধু হিন্দু সচেতনতা, কারণ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন সিদ্ধান্ত নেবে ২০২১-এর পর পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘুদের রাজ্য হয়ে উঠবে কিনা। নাকি বিশ্ববাংলা লোগোর কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গ অনেক বড়ো চক্রান্তের শিকার হয়ে বাংলাদেশের একাংশের সঙ্গে মিশে গিয়ে নয়া দেশ গড়ে উঠবে কিনা। আর সেই দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সখ। মেটাবেন কিনা। হিন্দু সচেতনতা, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের সঠিক ভোট ভাবনাই ঠিক করে দেবে এবারের ফলাফল। গেরুয়া ঝড়কে আরও প্রবল করে তুলতে হবে। সাইক্লোন নয়। এ রাজ্যে গেরুয়া ঝড় হয়ে উঠুকটর্নেডো। একটা নতুন ইতিহাস রচিত হোক পশ্চিমবঙ্গে। নয়া উন্নয়ন, নয়া প্রশাসন, নয়া বিচারধারার ইতিহাস।
সনাতন রায়
2019-05-09