ভবতি ভিক্ষাং দেহি – বালক ব্রহ্মচারীর গলার আওয়াজ শুনে ব্রাহ্মণী ঘরের বাইরে এলেন। ব্রহ্মচারীর বয়স বড়জোর সাত বা আট বছর হবে। সৌম্যদর্শন তেজস্বী শিশুটির মুখ দেখে ব্রাহ্মণীর মনে অদ্ভুত আনন্দের সঞ্চার হল। কিন্তু মুহূর্তে মুখের স্মিত হাস্য মিলিয়ে গিয়ে বেদনার রেখা প্রকটিত হল। “বাছা, স্বামী অসুস্থ। ঘরে খাদ্য কিছু নাই।” বলতে বলতে অশ্রুসজল চোখে ব্রাহ্মণী কয়েকটি আমলকী ব্রহ্মচারীর ভিক্ষার ঝুলিতে দিলেন। মানুষের দারিদ্র্য জনিত এই কষ্টে হৃদয় বিদীর্ণ হল অদ্ভুত প্রতিভাধর ব্রহ্মচারীর। তাঁর কণ্ঠ থেকে স্বতঃ উৎসারিত হল অদ্ভুত এক স্তুতি – সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীর। বটুর স্তোত্রপাঠ সমাপ্ত হওয়া মাত্র দরিদ্র ব্রাহ্মণের জীর্ণ কুটীরের ছাদ ভেঙ্গে আকাশ থেকে নেমে এল সোনার আমলকীর বর্ষা।
এই প্রতিভাধর আশ্চর্য বালকের নাম শঙ্করাচার্য। সম্ভবতঃ ৭৪৩ বিক্রমাব্দের বৈশাখ শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে কেরলের কালাডি গ্রামে শিবগুরু ও বিশিষ্টাদেবীর গৃহে ভগবান্ শিবের অবতার শঙ্করাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। শ্রুতিধর এই শিশু পঞ্চম বর্ষে গুরুগৃহে গিয়ে মাত্র দুই বছরের মধ্যে সমস্ত বেদ ও বেদাঙ্গের পাঠ গ্রহণ করেন।
বেদের দুইটি অংশ – কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধদের সর্বগ্রাসী প্রভাবের অবসানের পরে মণ্ডন মিশ্র প্রমুখ মীমাংসকদের প্রবল প্রভাবে সমাজে বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ধর্ম আচার সর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়। জ্ঞান ও ভক্তি অবহেলিত হয়। ধর্ম ও মনুষ্যত্ব যান্ত্রিকতা পর্যবসিত হয়। সমাজের এই দুরবস্থায় আকুল হয়ে শঙ্করাচার্য লোককল্যাণের উদ্দেশ্যে তপস্যার বাঞ্ছা নিয়ে নর্মদার তীরে উপস্থিত হন। নর্মদার তীরে তিনি গুরু গোবিন্দপাদের নিকট দীক্ষা লাভ করেন এবং বেদের জ্ঞানকাণ্ডের সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেন। সেখানে প্রবল সাধনায় তিনি আধ্যাত্মিক জীবনের অন্তিম অনুভূতি সমাধির আনন্দ লাভ করেন।
এর পরে গুরুর আদেশে তিনি প্রমুখ দশটি উপনিষদ্, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন কৃত ব্রহ্মসূত্র এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ভাষ্য রচনা করেন। বদরিকাশ্রমে এই ভাষ্য রচনার সময়ে এক সময় চিরঞ্জীবী বেদব্যাস নিজে এসে শঙ্করাচার্যের ভাষ্য শ্রবণ করে তাকে যথাযথ বলে প্রমাণিত করেন। এর পরে বেদব্যাসের আদেশে তিনি বেদান্ত শাস্ত্রের প্রচারে ব্রতী হলেন।
এজন্য তিনি মীমাংসক শ্রেষ্ঠ মণ্ডন মিশ্রের গৃহে উপস্থিত হয়ে তাঁকে তর্কে পরাস্ত করেন। মণ্ডন শঙ্করাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। যিনি একসময়ে সন্ন্যাসের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তিনি আচার্যের কৃপায় বৈরাগ্য লাভ করে বৈদিক বিধিতে সন্ন্যাস গ্রহণ করে সুরেশ্বরাচার্য নামে অভিহিত হন এবং বেদান্ত অর্থাৎ বেদের জ্ঞানকাণ্ডের প্রচারে নিরত হন।
এর পরে শঙ্করাচার্য (Shankaracharya) সমগ্র দেশ ভ্রমণ করে বিভিন্ন বেদ বহির্ভূত মতের প্রচারকদের পরাস্ত করে বৈদিক মতকে সমগ্র ভারত ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। লোকসমাজে বৈদিক মতের নিরবচ্ছিন্ন প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ভারতবর্ষের চার কোণে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে নিজের চার প্রিয় শিষ্যকে চারটি মঠের দায়িত্ব প্রদান করলেন।
এই ভাবে জ্ঞানকাণ্ডের প্রতিষ্ঠা করে শঙ্করাচার্য সমাজে সহজ ভাবে বেদান্তের ভাব প্রচারের উদ্দেশ্যে বিবেকচূড়ামণি, লঘুবাক্যবৃত্তি, অপরোক্ষানুভূতি, পঞ্চীকরণম্, উপদেশসাহস্রী প্রভৃতি বহু ছোট ছোট গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু, সমাজে সাধারণ মানুষের উদ্ধারের মার্গ ভক্তি। বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে শতাধিক স্তোত্র রচনা করেন। শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, গাণপত্য প্রভৃতি বিভিন্ন মত ও পন্থের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে তিনি পঞ্চায়তন পূজার প্রচলন করেন। এই ভাবে বৈদিক আদর্শে সমাজকে পুনর্গঠিত করে অল্পায়ু মহাপুরুষ মাত্র ৩২ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। কিন্তু, তাঁর অদ্ভুত চমৎকার কর্মকাণ্ড এযাবৎ কাল হিন্দু সমাজের রক্ষায় এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে।
ব্রহ্মচর্য্যের স্বাভাবিক নিয়মানুসারে বালক শঙ্কর সে সময় গুরুগৃহনিবাসী।ক্ষুন্নিবৃত্তির নিমিত্ত একদিন ভিক্ষায় বার হয়েছেন।উপস্থিত হলেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের গৃহে।এদিকে সেই পরিবারের অবস্থা অতি শোচনীয়। ভিক্ষা দেবার মত একমুষ্টি তণ্ডুলও গৃহে নেই।
ব্রাহ্মণীর কোমলপ্রাণ বালক শঙ্করকে দেখে আকুল হল।তিনি আপন দৈন্যদশা বর্ণনাপূর্বক বালকের হস্তে একটি আমলকী অর্পণ করলেন।শঙ্করের কুসুমকোমল হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠল।নিজের অজান্তেই অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বৈকুন্ঠনিবাসিনীর নিকট কাতর প্রার্থনা জানালেন যেন এই ব্রাহ্মণ পরিবারের দারিদ্র্য মোচন হয়।(সেই প্রার্থনাই পরবর্তীকালে পরিচিত হয় দারিদ্র্য-দু:খ নাশিনী কনকধারা স্তোত্ররূপে।)
অন্যদিক বৈকুন্ঠসম্রাজ্ঞীও বালকের এহেন স্তবে তুষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হলেন শঙ্কর সমীপে।বললেন-“হে বৎস,তোমার স্তবে আমি সন্তুষ্ট।তোমার অভিপ্রায়ও আমার অজানা নয়।কিন্তু এই দরিদ্র পরিবার পূর্বজন্মের কর্মফলে এরূপ অবস্থা ভোগ করছে।এমন কোন সুকৃতি এদের নেই যার জন্য আমি এই পরিবারের দীনতা দূর করতে পারি।”
সুচতুর বালক ভগবতীকে উত্তর করলেন-“হে মাত:! এই গৃহিণী যে আমায় নি:শর্তে একটি আমলকী দান করেছেন।শুনেছি সদ্ ব্রাহ্মণকে কিছু দান অত্যন্ত পুণ্যকর্ম,আমি কী সদ্ ব্রাহ্মণ নই মাতা!
বালকের বাক্যে অভিভূত হলেন দেবী।প্রতিশ্রুতি দিলেন অচিরেই ঐ পরিবারের সকল দু:খ দূর হবে।প্রসন্ন চিত্তে বিদায় নিলেন শঙ্কর।প্রত্যাবর্তন করলেন গুরুগৃহে।
পরদিন অতি প্রত্যূষে শয্যাত্যাগ করে ব্রাহ্মণ পরিবার দেখলেন তাঁদের গৃহের সর্বত্র অজস্র স্বর্ণ আমলকী ছড়ানো।তাঁরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে সংগ্রহ করতে লাগলেন সেই সুবর্ণ আমলকীসমূহ।সকলের নিকট বর্ণনা করতে লাগলেন তাঁদের দারিদ্র্যমোচনের আশ্চর্য কাহিনী।বালক শঙ্করের অলৌকিক শক্তির কথা দিকে দিকে প্রচারিত হতে লাগল।
লেখক- রাকেশ দাশ (Rakesh Das)