অমিত শাহ ইদানীং বারবারই দাবি করেছেন, একুশের ভোটে বাংলায় বিজেপি দু’শোর বেশি আসনে জিতবে। মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে দাঁড়িয়ে প্রবীণ বিজেপি নেতা মুকুল রায় আবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তিন অঙ্কে পৌঁছবে না তৃণমূল।
এর পাল্টা দাবিও উঠেছে, তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই প্রশান্ত কিশোর আজ সোমবার বলেছেন, “লিখে রাখুন, দুই অঙ্কের সংখ্যা পার করবে না বিজেপি।”
কিন্তু এ সবের মধ্যে কেউ খেয়াল করেছেন কি, গত পঞ্চাশ বছরে বাংলায় সমস্ত বিধানসভা নির্বাচনে যে যখনই জিতেছে, ২০০ পার করে দিয়েছে। ব্যতিক্রম ঘটেছে শুধু একবারই। তা হল ২০০১ সালে। সে বার বামেরা ২০০ পার করতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু দু’শোর খুব দূরেও ছিলেন না। বাংলায় বামফ্রন্ট সেবার জিতেছিল ১৯৯টি আসনে।
ফিরে দেখা যাক।
১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচন
এখানে জানিয়ে রাখা দরকার যে ৭২ সালে রাজ্য বিধানসভায় ২৯৪টি আসন ছিল না। তখন বিধানসভার আসন সংখ্যা ছিল ২৮০।
সে বার ৪৯.০৮ শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেস একাই ২১৬টি আসনে জিতেছিল। তুলনায় বামেদের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ছিল অনেক কম। সিপিআই পেয়েছিল ৮.৩৩ শতাংশ ভোট। সিপিএম পেয়েছিল ২৭.৪৫ শতাংশ ভোট। এই দুই বাম দল মিলে ৪৯টি আসনে জিতেছিল। বাকি আসন পেয়েছিল ছোট দলগুলি।
১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন
এই ভোট বাংলায় ছিল মাইলফলক। সে বার থেকেই রাজ্য বিধানসভায় আসন সংখ্যা বেড়ে ২৯৪ হয়। অর্থাৎ ম্যাজিক নম্বর হয়ে ওঠে ১৪৭। বাংলায় সে বছর ঝড় তুলেছিলেন বামেরা। মোট ২৩১টি আসনে জিতেছিল বামফ্রন্ট। তার মধ্যে সিপিএম একাই জিতেছিল ১৭৮টি আসনে। কংগ্রেসের সে বার ভরাডুবি অবস্থা। জনতা পার্টির সঙ্গে এই সাবেক দলের জোট ছিল। তার পরেও মাত্র ২০টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। জনতা পার্টি জিতেছিল ২৯টি আসনে।
১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচন
এই ভোটে বামফ্রন্ট শুধু জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেনি, পাঁচ বছর আগের নির্বাচনের তুলনায় ৭টি আসন বেশি পেয়েছিল। বামফ্রন্ট জিতেছিল ২৩৮টি আসনে। তার মধ্যে একা সিপিএম জিতেছিল ১৭৪টি আসন। কংগ্রেস জিতেছিল মাত্র ৪৯টি আসনে। কংগ্রেস (সোসালিস্ট) পেয়েছিল মাত্র ৪টি আসন।
৮০ সালে বিজেপির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তার ২ বছর বাদে ৮২ সালে বাংলায় বিধানসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ০.৫৮ শতাংশ ভোট।
১৯৮৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন
সেবার রেকর্ড আসনে জিতেছিল বামফ্রন্ট। বাংলায় একটানা ৩৪ বছরের বাম শাসনে এত বড় সাফল্য এর পর আর কখনও পায়নি তারা। ওই ভোটে সিপিএম একাই জিতেছিল ১৮৭টি আসন। বামফ্রন্ট জিতেছিল ২৫১টি আসনে। কংগ্রেস জিতেছিল মাত্র ৪০টি আসন।
৮৭ সালের নির্বাচনে বিজেপি বাংলায় মোট ১,৩৪, ৮৫৭টি ভোট পেয়েছিল।
১৯৯১ সালের বিধানসভা নির্বাচন
সে বছরও বিধানসভা ভোটে বিপুল সাফল্য পেয়েছিল বামফ্রন্ট। বামেরা পেয়েছিলেন ২৪৫টি আসন। সিপিএম জিতেছিল ১৮২টি আসনে। আর কংগ্রেস মাত্র ৪৩টি আসনে জিতেছিল।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, সিপিএম এবং কংগ্রেস—দু’জনেই সে বার ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তবে বামফ্রন্টের সম্মিলিত ভোট শতাংশ ছিল অনেক বেশি।
তবে এই নির্বাচনে একটি বড় মাইলফলক ছিল। রাম মন্দির আন্দোলনের সরাসরি প্রভাব দেখা গিয়েছিল বাংলার ভোটে। ৮৭ সালে যে বিজেপি মাত্র ০.৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তাদের ভোট শতাংশ সে বার এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১১.৩৪ শতাংশ। মোট ৩৫,১৩,১২১টি ভোট পেয়েছিল বিজেপি।
৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন
গত পঞ্চাশ বছরে কংগ্রেস এই ভোটেই সব থেকে বেশি আসন জিতেছিল। তারা পেয়েছিল ৮২টি আসন। বামেরা জিতেছিলেন ২০৩টি আসনে।
বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৬.৪৫ শতাংশ ভোট।
২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচন
সেবার বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস জোট হয়েছিল। তাতেও বামেদের খুব বেশি দুর্বল করা যায়নি। বামফ্রন্ট ১৯৯টি আসন পেয়েছিল। তৃণমূল পেয়েছিল ৬০টি আসন। কংগ্রেস জিতেছিল ২৬টি আসনে।
কেন্দ্রে তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার। তবুও কোনও আসন জিততে পারেনি বিজেপি।
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন
সে বার বাংলায় শিল্পায়নের স্লোগান তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিরুদ্ধে কোনও জোট বা মহাজোট ছিল না। তার সুযোগ নিয়ে বামেরা ২৩৫টি আসনে জিতেছিল। কংগ্রেস জিতেছিল ২১টি আসনে। আর তৃণমূল মাত্র ৩০টি আসনে জিতেছিল।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন
চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের পতন ঘটাতে সে ছিল পালাবদলের নির্বাচন। তৃণমূল ও কংগ্রেসের মহাজোট হয়েছিল সেবার। এই দুই দল মিলে ২২৭টি আসনে জিতেছিল। এর মধ্যে তৃণমূল ১৮৫ এবং কংগ্রেস ৪২ আসন পেয়েছিল। কংগ্রেসের থেকেও কম আসন পেয়েছিল সিপিএম। তারা জিতেছিল মাত্র ৪০টি আসনে।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন
বাংলায় এই নির্বাচনও ছিল রাজনৈতিক ভাবে মাইলস্টোন। রাজ্য রাজনীতিতে চিরাচরিত দুই প্রতিপক্ষ বাম ও কংগ্রেস এই ভোটে জোট করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও একা ২০০ আসন পেরিয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল জিতেছিল ২১১টি আসনে। কংগ্রেস ৪৪টি ও বামেরা ৩৩টি আসনে জিতেছিলেন।
ষোল সালের ভোটে ৩টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। তাদের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ছিল ১০.১৬।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন
ভোটের নির্ঘণ্ট এখনও ঘোষণা হয়নি। তা ঘোষণা হতেও দু’মাস কম করে বাকি। তবে পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, এ বার বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে জবরদস্ত লড়াই হতে চলেছে। লোকসভা ভোটে এই দুই দলই কমবেশি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অনেকের মতে, ভোট শতাংশের ফারাক বিধানসভা নির্বাচনে থাকবে খুবই কম। কিন্তু ওই কম ভোট শতাংশের ব্যবধানেই আসন সংখ্যার ব্যবধান হবে অনেক বেশি।
দেখা যাক, পঞ্চাশ বছরের ট্র্যাডিশন এবারও বজায় থাকে, নাকি এবার মিথ ভেঙে দেওয়ার ভোট হবে একুশে।