১৯১৮ সালের গ্রীষ্মের ছুটির পর কলকাতা ও ঝরিয়া প্রবাসী বেশ কিছু গুজরাটী ছেলে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
শান্তিনিকেতন তার বাঙালিত্বের ক্ষুদ্র সীমা ভেঙে বাইরের ছাত্রদের আহ্বান জানাতে পেরেছে। এই ঘটনা কবির মনে খুব নাড়া দিল।
পূজোর ছুটির কিছুদিন আগে তিনি এ্যানড্রুজ ও রথীন্দ্রনাথকে ডেকে বললেন- ‘শান্তিনিকেতনকে ভারতীয়দের শিক্ষাকেন্দ্র করে তুলতে হবে। এখানে ভারতের নানা প্রদেশের ছাত্র আসবে এবং যথার্থ ভারতীয় শিক্ষা তারা গ্রহণ করবে। বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্ররা নিজ নিজ আচার ব্যবহার পালন করতে পারবে। ছোটবেলা থেকে একসাথে বাস করে ছাত্ররা একটি জাতীয় আদর্শ চর্চা করতে পারবে। বোলপুরের বিদ্যালয় প্রাদেশিক থাকবে না- সাম্প্রদায়িক হবে না।’
বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। অর্থ কি ভাবে যোগাড় করা যায় সে বিষয়ে তিনি এ্যানড্রুজ সাহেবের সাথে আলোচনা করেন। এ্যানড্রুজ সাহেব তাঁর কিছু পরিচিত ব্যক্তিকে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছার কথা জানান।
১৯১৮ সালের ৪ই অক্টোবর বিদ্যালয়ে পূজোর ছুটি পড়ল। কবি ৯ তারিখে রথীন্দ্রনাথ ও এ্যানড্রুজকে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন। এ্যানড্রুজ সাহেবের আহ্বানে পরদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কলকাতার কিছু গুজরাটী ব্যবসায়ী কবির সাথে দেখা করতে এলেন। গুজরাটী ব্যবসায়ীরা কবির মুখে তাঁর নব ভাব ধারায় এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছের কথা শুনে কবিকে অর্থ সাহায্যের বিষয়ে আশ্বস্ত করলেন।
কবি সেই বছরেই পৌষমেলার সূচনার পরের দিন,(১৩২৫ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ) শান্তিনিকেতনের শিশু বিভাগের ঘরগুলির পেছনের মাঠে নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করে বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন।
ভিত্তির জন্য যে গর্তটি কাটা হয়েছিল, বৈদিক মন্ত্রপাঠাদির পরে কবি তার ভেতরে আতপ চাল, জল, কুশ, ফুল প্রভৃতি নিক্ষেপ করলেন। বিভিন্ন দেশের নরনারীরা যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, সকলেই বিশ্বমানবের প্রতিনিধি স্বরূপ গর্তে মাটি দিলেন।
এরপর ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর, (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ) রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানের সভাপতি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন । উপস্থিত ছিলেন ডাক্তার নীলরতন সরকার, ডাক্তার শিশিরকুমার মৈত্র ও আচার্য সিল্ভ্যাঁ লেভি প্রমুখ বিশিষ্ট পণ্ডিতবর্গ।
সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ যে দীর্ঘ ভাষণ দেন সেখানে গুজরাটী সমাজের অবদান সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন। সেই প্রসঙ্গে ভাষণে তিনি বললেন-
‘আজ আমাদের আশ্রমে প্ৰায় ত্ৰিশ জন গুজরাটের ছেলে এসে বসেছে। সেই ছেলেদের অভিভাবকেরা আমার আশ্রমের পরম হিতৈষী। তারা আমাদের সর্বপ্রকারে যত আনুকুল্য করেছেন, এমন আনুকূল্য ভারতের আর কোথাও পাই নি।
অনেক দিন আমি বাঙালির ছেলেকে এই আশ্রমে মানুষ করেছি- কিন্তু বাংলাদেশে আমার সহায় নেই। সেও আমার বিধাতার দয়া।
যেখানে দাবি বেশি সেখান থেকে যা পাওয়া যায় সে তো খাজনা পাওয়া । যে খাজনা পায় সে যদি-বা রাজাও হয় তবু সে হতভাগ্য, কেননা সে তার নীচের লোকের কাছ থেকেই ভিক্ষা পায়।
যে দান পায় সে উপর থেকে পায়, সে প্রেমের দান, জবরদস্তির আদায়-ওয়াশিল নয় ।
বাংলাদেশের বাহির থেকে আমার আশ্রম যে আনুকূল্য পেয়েছে, সেই তো আশীৰ্বাদ- সে পবিত্র। সেই আনুকূল্যে এই আশ্রম সমস্ত বিশ্বের সামগ্ৰী হয়েছে ।
আজ তাই আত্মাভিমান বিসর্জন করে বাংলাদেশাভিমান বর্জন করে বাইরে আশ্রমজননীর জন্য ভিক্ষা করতে বাহির হয়েছি।’
- রবীন্দ্র রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড)- সুলভ বিশ্বভারতী
ঋণ স্বীকার- ছবি- বিশ্বভারতী
রবীন্দ্র জীবনী- প্রভাত মুখোপাধ্যায়
পুণ্যস্মৃতি- সীতা দেবী