আজকের দিনেই গান্ধীজী মহারাজ হরি সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা ঠিক হয়েছিল। এই উপলক্ষে কাশ্মীর রাজ্যের দেওয়ান শ্রী রামচন্দ্র কাক একটি ঔপচারিক পত্র গান্ধীজী আগমনের আগেই ওঁকে দিয়ে এসেছিলেন। আজ ৩রা আগস্টও গান্ধীজী রোজকার মতই ছিল। আগস্ট মাস হলেও কিশোরীলাল শেঠির বাড়িতে বেশ ঠান্ডা ছিল। শ্রী গান্ধী নিজের দিনচর্যা অনুযায়ী কাকভোরেই উঠে পড়েন। ওঁর নাতনি ‘মনু’ তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিল। সেও গান্ধীজীর সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়ে।
‘মনু’ গান্ধীজীর সঙ্গে শয়ন করত। প্রায় এক বছর পূর্বে নোয়াখালী সফর থেকেই সে তার সঙ্গে শয়ন করছিল। এটা ওনার সত্যের ওপর একটি গবেষণার প্রচেষ্টা । একজন অত্যন্ত পারদর্শী ও স্বচ্ছ মনের ব্যক্তিত্ব গান্ধীজীর কাছে এতে কোনো ভুল ছিল না। যদিও এই খবরটা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়। কংগ্রেসের নেতারা এই ব্যাপারে কিছুই বলতেন না এবং মৌন ছিলেন। কিন্তু দেশের বহু প্রান্তে ওঁর এই ‘সত্যের গবেষণা’ নিয়ে বিরোধী মন্তব্য ও সমালোচনা বেশ চড়া সুরেই হচ্ছিল। তাই বাংলার সফরের পরে বিহার সফরে মনু আর তাঁর সঙ্গে ছিল না।
এদিকে শ্রীনগরে এইরকম কিছুই ছিল না। গান্ধীজী ও মনুর খবর পিছনেই চাপা পড়ে থাকে। নিজের নাতনির সঙ্গে গান্ধীজী সহবাস নিয়ে সেখানে কোনো কৌতূহল ছিল না। তাই সূর্যোদয়ের সঙ্গেই গান্ধীর নিত্য প্রার্থনাও হয়ে গিয়েছিল এবং যথাযথভাবে উনি নিজের বাসস্থানের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজও শুরু করেন। দিনচর্যার সকল কাজ সম্পন্ন করে উনি মহারাজা হরি সিংয়ের প্রাসাদ ‘গুলাব ভবনে’ বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছান। যদিও এই সাক্ষাতে মহারাজা হরি সিংহের সম্মতি ছিল না কিন্তু উনি তাঁর আতিথেয়তায় কোন অভাব রাখেননি। স্বয়ং রাজা হরি সিং ও তাঁর স্ত্রী তারাদেবী সিং তাঁকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যুবরাজ করণ সিংও নিজের রাজসিক ভঙ্গিতে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মহারানী তারাদেবী নিজে তিলক ও আরতির সঙ্গে ওনাকে স্বাগত জানান (ওই ‘গুলাব ভবন’ নামক রাজপ্রাসাদে যে বৃক্ষের তলায় তাদের সাক্ষাৎকার হয়েছিল, সেখানে এই সাক্ষাতের স্মৃতি স্বরূপ এক তাম্রফলক লাগানো হয়। যদিও ওই তাম্রফলকের তারিখ ভুল লেখা হয়, মহারাজ গান্ধীর সাক্ষাৎ ৩রা আগস্ট লেখা হয় কিন্তু ফলকে তা জুন ১৯৪৭ লেখা হয়)
সেইদিন গান্ধীজীকে প্রাসাদে সাধারণভাবেই বিচরণ করতে দেখা যায় ও তাঁর মুখে কোন প্রকারের চাপের বা অশান্তির ছাপ দেখা যায়নি। খুব সাধারণ ভাবেই প্রাসাদে ঘোরাফেরা করেন। মহারাজ হরি সিংয়ের সঙ্গে উনার দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হয় কিন্তু এই গোটা আলোচনাতে উনি কাশ্মীর রাজ্যের ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোন প্রসঙ্গই তোলেন না। যদিও গান্ধীজী এই প্রকার কোন প্রস্তাব রাখতেন, ওঁর নিজের মতে তা একেবারেই উচিত হতো না। কারণ গান্ধীজী নিজেকে ভারত ও পাকিস্তান দুয়েরই পিতৃপুরুষ মনে করতেন। যদিও দুর্ভাগ্যবশতঃ উনি জানতেন না যে মুসলমানেরা তাঁকে হিন্দু নেতা হিসেবেই মনে করে এবং তাঁকে যথেষ্ট ঘৃণাও করে। তাই গান্ধীজীকে পাকিস্তানে একচুলও সম্মান দেওয়া হয় না এবং তাঁর কোন স্থান নেই।
ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরে কাশ্মীরের ভূমিকা সংক্রান্ত এবং তাঁর কি নির্ণয় নেওয়া উচিত ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে কোনো আলোচনাই গান্ধীজী করেননি। মহারাজ ও তাঁর মধ্যে কোন রাজনৈতিক আলোচনাই হয়েনি। তবে গান্ধীজী এই নিরপেক্ষ সাক্ষাতের কারণে নেহেরুর নিজের ‘কাশ্মীর এজেন্ডা’ প্রযোজ্য করতে যথেষ্ট সুবিধা হয়। ৩রা আগস্ট এই সাক্ষাৎ হয়, আর ১০ই আগস্ট মহারাজ হরি সিং নিজের বিশ্বাসপাত্র শ্রী রামচন্দ্র কাককে, যিনি নেহেরুকে জেলে পুরেছিলেন, নিজের সকল দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেন। দ্বিতীয় পরিণাম স্বরূপ নেহেরুর প্রিয় মিত্র শেখ আব্দুল্লাহকে ২১এ সেপ্টেম্বর কারামুক্ত করা হয়।
সরাসরি ভাবে দেখলে গান্ধীজীর সাক্ষাতের মূল কারণ এইটুকুই। যদি গান্ধীজী এই দুটো দাবির সঙ্গে রাজা হরি সিংকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ করতেন ও পরামর্শ দিতেন তাহলে ১৯৪৭ এর অক্টোবরের আগে আগস্ট ১৯৪৭–এই কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেত। আজকে কাশ্মীরের এই জ্বলন্ত বিষয়ের উৎপত্তি হত না দেশের সামনে। কিন্তু এমনটি হওয়ার ছিল না।
মন্ডী–হিমালয়ের কোলে একটি ছোট্ট শহর। মনু ঋষির নামে নামকরণ এই মন্ডীর। বিয়াস নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার এক সুরূপ। ১৯৪৭-এ এই সুন্দর এলাকাও একটি ছোট অঙ্গ রাজ্য ছিল। কিন্তু এই রাজ্যের রাজার মনেও ইচ্ছে ছিল যে ব্রিটিশের দাসত্বের পরে তাঁর রাজ্যও স্বাধীন থাকুক ভারতে যুক্ত না হয়ে। মন্ডীর মত ‘সিরমৌর’ রাজ্যের রাজাও একই ইচ্ছে পোষণ করতেন। যদিও এই সকল ছোট ছোট রাজ্যগুলি বুঝেছিল যে যখন অনেকগুলো বৃহৎ রাজ্যের সমষ্টিতে ভারতের গঠন হচ্ছে, তখন তাদের স্বাধীন থাকা সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যেই তারা জানতে পারেন যে কাশ্মীরের মহারাজা রাজ্যকে স্বাধীন রাখার চেষ্টা করছেন। তখন সকলে মিলে একটা পরিকল্পনা করেন যে জম্মু, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, সিমলা ইত্যাদি সকল পাহাড়ি রাজ্যগুলি সংগঠিত হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাব দেবে। সেই সংকল্পে তাঁরা গত সপ্তাহেই লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখাও করেন এবং পত্র দিয়ে নিজেদের দাবি রাখেন। যে এই সকল সংগঠিত পাহাড়ি রাজ্যগুলির এক স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য তাদের একটু সময় লাগবে, তাই এখন ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোন সন্ধিতে তাঁরা হস্তাক্ষর করতে পারবেন না এবং তাঁদের আরও কিছু সময় লাগবে।
মাউন্টব্যাটেন এই পত্রগুলি বারবার দেখছিলেন। আসলে যত এইসব ছোট রাজ্য সমষ্টি ও রাজারা নিজেদের স্বাধীন রাখার দাবি রাখছিলেন, দেশ ছাড়ার সময় ব্রিটিশদের ততটাই অসুবিধের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই এই ছোট ছোট রাজ্যগুলি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে না চাওয়া, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পছন্দ ছিল না। তবু গণতন্ত্র এবং নিজের পদমর্যাদার তাগিদে ৩রা আগস্টের দুপুরে উনি সর্দার প্যাটেলকে একটা পত্র লেখা শুরু করেন। সর্দার প্যাটেলকে লেখা চিঠিতে (যদিও জানতেন এই পরিস্থিতির কোনো অনুকূল নির্ণয় নেওয়া আপাতত সম্ভব নয়) মাউন্টব্যাটেন এই দুই রাজ্যের, মন্ডী ও সিরমৌর রাজাদের পত্রের আগ্রহের কথা জানিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গে তাঁদের আরো কিছুদিন সময় দেওয়ার জন্য অনুগ্রহ করেন।
ড: বাবাসাহেব আম্বেদকর আজ দিল্লিতে ছিলেন। গত কিছুদিন ধরে উনি নানাবিধ কাজে খুব ব্যস্ত ছিলেন। ওঁর ‘শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন’ নামক সংগঠনের কার্যকর্তারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন কাজের পরামর্শের জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছিলেন। বহু পথ লেখা ও পড়া বাকি ছিল। কিন্তু বাবাসাহেবকে এইরূপ পরিস্থিতি বেশ উৎসাহিত করতো। যত বেশি কাজ হবে, মনোযোগের সঙ্গে কাজের গভীরে তলিয়ে যাবেন। ওঁর কাছে এইরকম নানারকমের কাজের চাপ একটা উৎসবের মতো ছিল। এইজন্য যখন গত সপ্তাহে নেহেরু ওনাকে আগামী মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, তখন উনি ইতিবাচকভাবেই উত্তরে বলেছিলেন, “আইন মন্ত্রণালয় কোন বিশেষ কাজ বাকি নেই, তাই এমন দায়িত্ব দিন যাতে অনেক বেশি কাজ করতে হয়”। নেহেরু হেসে বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই, এক বিশাল দায়িত্ব আপনাকে দেব।” আর আজ দুপুরেই বাবাসাহেব প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর চিঠি পান। এই চিঠির মাধ্যমে উনি বাবা সাহেবকে স্বতন্ত্র ভারতের প্রথম আইন মন্ত্রী নিযুক্ত করেন। বাবাসাহেবর “শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন” এর জন্য বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের মুহূর্ত ছিল।
ওদিকে দিল্লির আগস্টের স্যাঁতস্যাঁতে প্ৰবল গরমে সিরিল রেডক্লিফ সাহেবের খুবই ভোগান্তি হচ্ছিল। ব্রিটেনের এই নির্ভীক ও নিরপেক্ষ ন্যায়াধীশ মহোদয় ভারতের বিভাজনের এই যোজনাতে কাজ করার জন্য আপত্তি সত্ত্বেও রাজি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এটলি ওঁর ন্যায়পরায়ণতা ও বুদ্ধিমত্তায় অটুট বিশ্বাস রেখে একপ্রকার জিদ করেই ওনাকে এই কাজের জন্য রাজি করিয়েছিলেন। এতে চক্রান্ত শুধু এটাই ছিল যে ভারত বিভাজনের জন্য মাউন্টব্যাটেনের একজন এমন মানুষের প্রয়োজন ছিল, যার ভারতের সম্বন্ধে জ্ঞান খুব কম। আর রেডক্লিফ এর জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন।
রেডক্লিফ সাহেব এই কাজের জটিলতার বিষয়ে অবগত ছিলেন উনি নিজের ক্ষমতায় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে প্রচেষ্টাও করেছিলেন। ওঁর বাংলো বাড়ির তিনটি বড় বড় ঘর বিভিন্ন কাগজপত্র আর নকশায় ভরে উঠেছিল। আজ ৩রা আগস্ট এর দিন উনার বেশিরভাগ কাজই প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। পাঞ্জাবের কিছু বিবাদিত এলাকার বিভাজন বাকি ছিল। ওঁর অন্তিম নির্ণয় নেওয়ার অপেক্ষা ছিলো। ইতিমধ্যেই উনি মেজর শর্টের একটা পত্র পেলেন। মেজর শর্ট একটা সৈনিক মানসিকতার, পাক্কা ব্রিটিশ ছিলেন। উনি রেডক্লিফ সাহেবকে ভারতের সাধারণ মানুষের রায় ও প্রতিক্রিয়া জানাতে এই পত্রটি লিখেছিলেন। সেই পত্রে উনি খুব স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন যে “ভারতের জনগণ বিশ্বাস করেন যে মাউন্টব্যাটেন যেমনটি চাইবেন, রেডক্লিফ সেইরকমই নির্ণয় নেবেন, কোনরকম বিরোধ ছাড়াই।” রেডক্লিফ এই পত্রটি নিয়ে বেশ চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। পত্রের এই অংশটি যথেষ্ট সত্য কারণ রেডক্লিফের উপর মাউন্টব্যাটেনের গভীর প্রভাব অবশ্যই ছিল।
৩রা আগস্ট বেলা চারটের সময় জহরলাল নেহেরু নিবাস ১৭ ইয়র্ক হাউস থেকে একটি প্রেসনোট জারি করা হলো। যেহেতু রাজনৈতিক পরিবেশ বেশ গরম ছিল, তাই নিত্য কোন না কোন প্রেসনোট বা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করা হতো। কিন্তু আজকের এই প্রেসনোটটি দেশ ও জনগণের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই পোস্টের মাধ্যমে নেহেরু নিজের মন্ত্রিসভার সহযোগীদের নাম জানান যা স্বাধীন ভারতের প্রথম মন্ত্রিসভা ছিল। তাই এই প্রশ্নটির গুরুত্ব ছিল। এই প্রেস নোটে নেহেরু নিজের সহযোগীদের নাম ক্রমানুসারে দিয়েছিলেন। যা এইপ্রকার ছিল –
– সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল
– মৌলানা আবুল কালাম আজাদ
– ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ
– ডঃ জন মাথাই
– জগজীবন রাম
– সর্দার বলদেব সিং
– সি এইচ ভাভা
– রাজকুমারি অমৃত কৌর
– ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর
– ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী
– নরহরি বিষ্ণু গাডগিল
এই ১২ জন সদস্যের মধ্যে রাজকুমারী অমৃত কৌর একমাত্র মহিলা ছিলেন, যেখানে বাবাসাহেব আম্বেদকর ছিলেন ‘শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন’ পার্টির, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী হিন্দু মহাসভার এবং সর্দার বলদেব সিং পন্থিক পার্টির প্রতিনিধিরূপে মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন।
ওদিকে সুদূর পশ্চিমে রাম মনোহর লোহিয়ার একটা প্রেসনোট খবরের কাগজের কার্যালয়ে পৌঁছে গেছিল। যা লক্ষাধিক গোয়া নিবাসীদের হতাশ করেছিল। তিনি এই প্রেসনোটের মাধ্যমে সূচনা দিয়েছিলেন যে, “গোয়ার স্বাধীনতা, ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই গোয়ার জনগণ নিজের স্বাধীনতার যুদ্ধ চালিয়ে যান…।”
বিভাজনের এই ভীষণ মর্মান্তিক ঘটনা ও দুঃখের থেকে অনেক দূরে মহারাষ্ট্রের আলন্দি নামক স্থানে কংগ্রেসে কার্যরত কমিউনিস্ট কার্যকর্তাদের আজ দ্বিতীয় ও অন্তিম বৈঠক ছিল। গতকাল থেকেই বামপন্থী কার্যকর্তাদের চিন্তাভাবনা আরম্ভ হয়। অবশেষে এটা ঠিক করা হলো যে কংগ্রেসের ভেতরে সাম্যবাদী বিচারধারার ও কৃষক-শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলার জন্য একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী গঠন করা হোক। শংকররাও মোড়ে, কেশব রাও জেধে, ভাউ সাহেব রাও, তুলসীদাস চেটি ইত্যাদি নেতারা এই অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীর সাময়িক নেতৃত্ব দেবেন। অর্থাৎ মহারাষ্ট্রে এক নতুন সাম্যবাদী দলের উৎপত্তি হতে চলেছিল।
শ্রীনগরে গান্ধীজী প্রবাসের আজ অন্তিম দিন ছিলো। আগামীকাল উনি জম্মুর জন্য রওনা দেবেন। তাই তাঁর জন্যে বেগম আকবর জহা এক বিশাল আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই উপলক্ষে উনি গান্ধীজীকে রাত্রি ভোজনের জন্য নিমন্ত্রণ করেন। যেহেতু শেখ আব্দুল্লাহর উপর গান্ধীর অত্যধিক স্নেহ ছিল, তাই এই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের কোন প্রশ্নই ছিল না। যদিও শেখ আব্দুল্লাহ কারাবাসে ছিলেন কিন্তু ওঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বেগম আকবর জহার তত্ত্বাবধানে গান্ধীজী আপ্যায়নের সুব্যবস্থা বেশ রাজকীয় ভাবেই করা হয়েছিল। ন্যাশনাল কনফারেন্সের কার্যকর্তারা ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এমনকি বেগম নিজেও তাঁর কন্যা খালিদাকে নিয়ে শ্রী গান্ধীকে স্বাগত জানানোর জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। শ্রী গান্ধী যখন শেখ আব্দুল্লাহ পরিবারের এইরকম রাজকীয় ঠাটবাট দেখলেন, তিনি একটু বিরক্তই হয়েছিলেন। এইরকম একটা ব্যবস্থা ওঁর কল্পনাতীত ছিল। উনি ভাবেননি যে ওঁর এইরকম একটা রাজকীয় ভঙ্গিতে আতিথেয়তা হবে। উনি বেগমের কাছে নিজের হালকা বিরক্তিও প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তবুও উনি পার্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন।
৩রা আগস্টের সেই কাল রাত একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছিল। লাহোর থেকে, পাঠানকোট থেকে, বাংলা থেকে লাখে লাখে সম্পন্ন সব পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে খণ্ডিত ভারতের দিকে একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন। তাঁদের নিজেদের প্রাণের ভয় ছিল। সারা জীবনের উপার্জন, সকল চল-অচল পৈত্রিক সম্পত্তি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ছেড়ে আসার মর্মান্তিক ব্যথা ছিল। ভারতে শরণার্থী হবার দুশ্চিন্তা ছিল। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত স্ত্রী-সন্তানদের কষ্ট সহ্য করার দুঃখ-বেদনা ছিল। কিন্তু অন্যদিকে দিল্লিতে রাজনীতি নিজের মতই গতিশীল ছিল।
সরকারিভাবে ভারতের বিভাজনের আর কেবলমাত্র বারোটি রাত বাকি ছিল…।