লেখাটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর প্রতি। তার পক্ষে এই লেখা পড়া সম্ভব হবে না, কিন্তু এমন অনেকেই পড়বেন যাঁরা নরন্দ্রে দামোদাসদাস মোদীকে বা তার ঘনিষ্ঠজনকে এই লেখার বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন। লেখাটি আসলে তাদের জন্য, তাদের কাছেই আমার অনুরোধ।
তিনটি বিষয়ে যাবার আগে আজকের সময়ের প্রেক্ষাপট একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। এখন ২০১৯-এর জুন মাস। ঠিক এর আগের মাসে ২৩ মে ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি ও তার জোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে। কিন্তু এটুকু বললে কিছুই বোঝা যাবে না। কারণ এবারের মুখ্য স্লোগান যা টিভি, বেতার, সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদপত্র সর্বত্র প্রচারিত হয়েছে তা ছিল—‘ফির একবার, মোদী সরকার। অর্থাৎ এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন একদিকে নরেন্দ্র মোদী ও অন্য দিকে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য বিরোধী দল। নির্বাচনে ঘোষণা হয়েছিল ১০ মার্চ। নির্বাচন শুরু হয় ১১ এপ্রিল এবং সাত দফায় শেষ হয় ১৯ মে।নরেন্দ্র মোদী নির্বাচন প্রচার শুরু করেন ২৮ মার্চ। শেষ করেন ১৭ মে এবং এই ৫১ দিনে ২৫টি প্রদেশে ১৪৪টি সভায় ভাষণ দেন। নরেন্দ্র মোদীর কাছে পশ্চিমবঙ্গ ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গে ১৭টি সভায় ভাষণ দেন যা উত্তরপ্রদেশ ছাড়া অন্যান্য সব রাজ্যের চেয়ে বেশি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষও নরেন্দ্র মোদীকে উপযুক্ত সম্মান জানিয়েছেন। বিগত লোকসভায় মাত্র ২টি আসন থেকে ১৮টি। আসনে ভারতীয় জনতা পার্টি জয়লাভ করেছে। সুতরাং এই দেওয়া-নেওয়ার শুভ চর্চায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অনেক আশানরেন্দ্র মোদীর কাছে। সেরকম তিনটি আশার কথাই একবার বলা যাক।
আশার কথা বলার আগে আরও একটু কথা বলা দরকার। সেটা হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের। অন্য সব প্রদেশের থেকে একটি বিষয়ে একেবারে আলাদা। অন্যান্য প্রদেশের সরকার পরিবর্তনে সেই প্রদেশের ভালো বা মন্দ হতে পারে, রাজ্যের মানুষ তা দেখে পরে আবার নতুন সরকার নির্বাচন করতে পারেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম নয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কয়েকটি ভুল পদক্ষেপ রাজ্যকে ভারতের বাইরে ঠেলে দিতে পারে, যদি ভারতেও থাকে সেই পশ্চিমবঙ্গ কার্যত হবে পশ্চিম বাংলাদেশ। এই প্রসঙ্গে মনে করানো যেতে পারে যে, আজকের ভারতের দুটি প্রদেশ স্বাধীনতার সময়েই ধমীয় ভিত্তিতে বিভাজিত হয়— পঞ্জাব ও বাংলা। স্বাধীনতার সময়ই ধর্মীয় জনবিনিময়ের ফলে ভারতীয় পঞ্জাবে মুসলমান-জনসংখ্যা অতি সামান্য। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই বিপরীত। ধর্মীয় জনবিনিময় তো হয়ইনি, বরং জওহরলাল নেহরুর ঘৃণ্য চক্রান্তে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমানদের গরিষ্ঠ অংশ পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছে এবং বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর বামফ্রন্ট সরকারের আনুকূল্যে ও পরে তৃণমূল সরকারের মদতে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় জনভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। অবস্থাটা এখন এমন যে, পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় অস্তিত্ব, ভূখণ্ড ও সংস্কৃতি—দুটিই বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে সময়ের সুতোয়। সুতরাং নরেন্দ্র মোদীকে যা করতে হবে তা এখনই করতে হবে, নইলে পরে আর কিছুই করা যাবে না।
প্রথম বিষয়টি হলো নাগরিকত্ব বিল। নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে ধন্যবাদ যে ২০১৫-র ৭ সেপ্টেম্বর পাসপোর্ট আইন ও ফরেনার্স আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত ধর্মীয় অত্যাচারের ফলে চলে আসা সব হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান শিখ জৈন ও পারসি জনসাধারণকে ভারতে আইনি বসবাসের অনুমতি প্রদান করেছে। এরপর ১৯ জুলাই ২০১৬-তে লোকসভায় পেশ হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৬। এতে বলা হয় যে যাঁদের পাসপোর্ট আইন ও ফরেনার্স আইন সংশোধন করে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে তারা বেআইনি অভিবাসী নন এবং তারা ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য হলেন। লোকসভায় আলোচনার পর বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়, সেখানে বছর দেড়েক এই কমিটির সামনে বিভিন্ন সংগঠন তাদের বক্তব্য রাখে। উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক সংগঠন এই কমিটির সামনে বক্তব্য রাখলেও, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই লেখকের নেতৃত্বে মাত্র একটি দলই বক্তব্য রেখেছিল। এই কমিটি সামান্য সংশোধন করে ও বিলটি ৮ জানুয়ারি ২০১৯-এ লোকসভায় পাশ হয়। কিন্তু যেহেতু বিজেপি ও সহযোগীদের রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না সেটি রাজ্যসভায় পেশ করা হয়নি। এরপর লোকসভার মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ও বিলটিরও মৃত্যু ঘটে। কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলা হয়নি তা হলো, এই বিলটির সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পশ্চিবঙ্গের কাছে। কারণ বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ৮০ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু এই বিলটি তৈরির সময় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সংগঠনগুলির (বিজেপির উদ্বাস্তু সংগঠন সহ) সঙ্গে আলোচনা করেনি। বর্তমান নাগরিকত্ব বিলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা এই যে, এই বিলে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের আবেদনপত্রে তাদের উপর বাংলাদেশে ধর্মীয় অত্যাচারের কোনো বিবৃতি চাওয়া হয়নি। এটি এজন্য ভীষণ প্রয়োজনীয় যে এর ফলে আমরা ১ কোটি মানুষের তাদের উপর ইসলামি অত্যাচারের আইনি বিবৃতি পাব যা আগামীদিনের ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে। এই ১ কোটি দলিল আমরা আন্তর্জাতিক স্তরে পেশ করতে পারব। এই বিষয়টি জানানো সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর কোনো জবাব দেয়নি। এখন নতুন সরকারের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে প্রথম দায়িত্ব হলো নাগরিকত্ব বিলটি সংশোধন করে আবার লোকসভায় পেশ করা। ২০২০ সালে রাজ্যসভায় বিজেপিও সহযোগীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসে যাবে। এই নিবন্ধের পাঠকদের কাছে অনুরোধ আবার বিলটি পেশের আগে আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করা হোক ও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা হোক।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো— এন আর সি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নবীকরণ। এটি নাগরিকত্ব বিলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়ার পরই অর্থাৎ ২০২০-র শেষ দিকেই এই কাজটি শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রেও আমাদের দাবি যে, এজন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনা করুক। কারণ নাগরিকত্ব বিল আইন হয়ে যাওয়ায় অসমের মতো এনআরসি-র আর প্রয়োজনীয়তা নেই। অর্থাৎ অসমের মতন পশ্চিমবঙ্গের সব নাগরিককে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। আমাদের এনআরসি-র প্রয়োজন হলো বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা ও পরে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। সেজন্য একমাত্র পশ্চিমবঙ্গবাসী মুসলমানদের কাছেই তাদের এখানে বসবাসের প্রমাণপত্র চাওয়া উচিত। যেহেতু আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা, সেহেতু অন্য ধর্মের মানুষদের কাছে কোনো প্রমাণপত্র চাওয়া অহেতুক এবং এতে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। এর ফলে কেবলমাত্র ৩০ শতাংশ মানুষকেই প্রমাণপত্র দিতে হবে, এতে যেমন অর্থ বাঁচবে, বাঁচবে সময়। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনেই লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রতিটি ভাষণে এনআরসি-র কথা সোচ্চারে বলেছেন, সুতরাং তাদের কাছে আবেদন বিষয়টি তারা বিবেচনা করুন।
তৃতীয় বিষয়টি হলো—তিস্তার নদী জলের চুক্তি। তিস্তা জল নিয়ে চুক্তিটি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকারের তৈরি। সেই চুক্তি নিয়েই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হাজির হন ঢাকায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিরোধিতা করেন এবং চুক্তিটি এখনো স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। এই চুক্তির ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকার কংগ্রেস ও বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গের কোনো মতামতের অপেক্ষা করেনি। ইসলামি মৌলবাদের পালে হাওয়া দেওয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে যেমন জনপ্রিয় আবার তিস্তা চুক্তিতে বাধা দেওয়ায় অনেকটাই অপ্রিয়। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত তিস্তার বর্তমান জলসম্পদের উপর সমীক্ষা করে, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য বিশেষজ্ঞ ও তিস্তার জলের ব্যবহারকারীদের নিয়ে আলোচনা করে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া। না হলে বর্তমান তিস্তা চুক্তি পশ্চিমবঙ্গ ও বিজেপির জন্য অভিশাপ বয়ে আনতে পারে।
এই তিনটি বিষয়ের একটি সাধারণ কথা— পশ্চিমবঙ্গের বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নেবার আগে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করুন। আমাদের মনে রাখা উচিত যে ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন নেহরু-লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মতামতের কোনো গুরুত্ব দেননি জওহরলাল নেহরু। আজকের পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশ সমস্যার শুরু সেই নেহরু-লিয়াকত চুক্তি থেকেই। সুতরাংপশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনা করেই সব সিদ্ধান্ত নেবে।
মোহিত রায়
2019-06-07