পর্ব_১
হেমন্তিকা এসো এসো হিমেল শীতল বন-তলে শুভ্র পূজারিণী বেশে কুন্দ-করবী-মালা গলে।। প্রভাত শিশির নীরে নাহি' এসো বলাকার তরণী বাহি' সারস মরাল সাথে গাহি' চরণ রাখি' শতদলে।। ভরা নদীর কূলে কূলে চাহিছে সচকিতা চখি — মানস-সরোবর হ'তে-অলক -লক্ষ্মী এলো কি? আমন ধানের ক্ষেতে জাগে হিল্লোল তব অনুরাগে, তব চরণের রঙ লাগে কুমুদে রাঙা কমলে।। কার্তিক মাস,হিম হিম ধূসর হেমন্তিকার আগমনী। ঋতু হেমন্ত, হাওয়ার বদল টের পাওয়া যায়। সে এসে গিয়েছে। কুয়াশায় আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটু দূরে। একটা আলো দেখালে হয়তো তার সুবিধে হবে আসতে। যদিও সে এসে গিয়েছে বলে উত্তর দিক থেকে একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।ওই হাওয়ায় আকাশপ্রদীপগুলোর অসুবিধে হচ্ছে খুবই! কিন্তু তারা সেটা গায়ে মাখছে না। বাঁশের ডগায় নিশ্চিন্তে বসে, কাচ বা কাপড়ের ঘেরাটোপে আকাশ প্রদীপ। মাঠে মাঠে সোনার বরণ ফসল রূপকথার গল্প বলে। উল্লাসে তারা মেতে ওঠে। শিউলীরা খেঁজুর রসের জন্য গাছ কামানোর তোড়জোড় শুরু করেন। কচুর পাতায়, ঘাসের ডগায় একটি একটি শিশির বিন্দু সকালের মিষ্টি রোদের ছোঁয়ায় মানিকের ন্যায় টল টল করে ওঠে। ধানের ক্ষেতে হেমন্তিকা লক্ষ্মীর গলায় শিশির জালির মায়াবী মালা ঝোলে। সন্ধ্যা নামে, আঁধার হয় মাদার গাছের তলা....অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের ক’রে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে…..
হেমন্তিকা সন্ধ্যার অন্ধকারে বঙ্গের গৃহে গৃহে তোড়জোড় সূচিত হয় আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর। তুলসী তলায় বঙ্গ হিন্দু নারী গন তাঁদের চিরন্তন গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করেন। মঙ্গল শঙ্খ ধ্বনিত হয় গৃহে গৃহে।
হেমন্তিকার প্রভাতে কি হয়? আবছা কুয়াশার মাঝে সূর্য ওঠেন, লাল সিঁদুর গোলার মত, রাত জাগা ...
তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া/ বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক'/ ওগো দুখজাগানিয়া ..
প্রভাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে দরদি গলার বিলম্বিত আলাপে আর খঞ্জনির গঞ্জরনে গ্রাম বাংলা জাগরিত হয়।
প্রভাত সময় কালে,শচীর আঙিনার মাঝে,কার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে।। এক গোরার নবীন বেশ,মোড়াইয়া চাঁচর কেশ।। সোনার অঙ্গ ধূলাতে লুটায় রে।গোরার সোনার অঙ্গধূলাতে লুটায় রে। প্রভাত সময় কালে শচীর আঙিনার মাঝেকার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে। কাক জাগার আগের ভোরেই টহল জাগে গ্রাম বাংলার। তারপর হয় কাক ভোর ,কাক জাগে, পক্ষী জাগে। কৃষক বলদ হাল নিয়ে মাঠের দিকে যাবার প্রস্তুতি নেন। গরু গুলো হাম্বা রব ছাড়ে। ডাবায় জাবনার জোগাড় করেন গ্রাম্য গৃহস্থ। কেউ কেউ ডাক পাড়ে " সেই কবে টহল দিয়েছে, এখনো ঘুম দিয়ে উঠতে পাল্লি নাকো!" রাই জাগো গো জাগো শ্যামের মনমোহিনী বিনোদিনী রাই জেগে দেখো আর তো নিশি নাইগো জয় রাঁধে জাগো শ্যামের মনমোহিনী বিনোদিনী রাই টহলের গানে ঘুম ভাঙে ব্রজ ভূমি রাঢ় বাংলার.....হ্যাঁ টহলের গান নামেই এই প্রভাতী গান রাঢ় বঙ্গের গ্রাম থেকে গ্রামন্তরে সু প্রচলিত ও পরিচিত। টহল এই শব্দের আভিধানিক অর্থ হল - পায়চারি ,পর্যটন, ঘুরে ঘুরে পাহারা দেওয়া ।ইত্যাদি। আবার টহল শব্দের অন্য মানে হল সেবা করা। তাই তো বৈষ্ণব ভক্তমাল গ্রন্থে বলা হয়েছে - " ভক্তগনের টহল করি।" কার্তিক মাসের সূচনা থেকে সংক্রান্তি অথবা অগ্রহায়ণ মাসের নবান্ন উৎসবের দিন অবধি প্রতি ভোরে বৈষ্ণব ভক্তকুল রাধা কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ বিষয়ক ছোট ছোট পদাবলী গান করেন গ্রামের রাস্তায় রাস্তায়। একেই টহলের গান বলে। আর এই গানেই ঘুম ভাঙে হেমন্তিকার.... রাই জাগো রাই জাগো শুক-সারি বলে কত নিদ্রা যাও গ রাধে ..... অথবা তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে, দিল চায়, মন চায়, প্রাণ চায় তারে।। এইসব শতাব্দী প্রাচীন গান বৈষ্ণব ধর্মালম্বী মহান্তগন পুরুষানুক্রমে গেয়ে থাকেন।বিনিময় নবান্ন উৎসবের দিন তাঁরা গৃহস্থের ঘরে ঘরে ঘুরে চাল, ডাল, আলু, কলা, টাকা বা সিধে তোলেন। তাঁদের মাথায় পাগড়ি। তাঁদের কপালে তিলক । বগলে একটা লাঠি, আর খঞ্জনি বাজিয়ে ভোরবেলায় প্রভাত সংগীত পরিবেশন করেন। সঙ্গে হ্যারিকেনের আলো বা কুপি বা লন্ঠন নিয়ে এক জন থাকেন। অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে জীর্ণ ফাটল-ধরা— এক কোণে তারি অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী। আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর, আছে এক ল্যাজ-কাটা ভক্ত কুকুর। আর আছে একতারা, বক্ষেতে ধ’রে গুন্ গুন্ গান গায় গুঞ্জন-স্বরে। অনেক গাঁয়ে আবার খোল খঞ্জনি বাজিয়ে , হারমোনিয়াম সহযোগে একটু বেলার দিকে এনারা গাইতে আসেন। বাড়ি বাড়ি গান করেন। বারোয়ারিতলায় প্রাচীন দেবমন্ডপে এই গানের সাময়িক বিরতি হয়। সাধারণত টহলের গানগুলি হয় এক একলির হয়।নাতি দীর্ঘ সব পদ। অনেক পদে রয়েছে কিছু ভনিতা। সুর বড় প্রাচীন। ধীর লয়ে গানগুলির গাওয়া হয়।খঞ্জনি টি বাজানোর জন্য ছাড় থাকে। ওহে দয়াল গৌর হে দয়া করে।রাধা বলে প্রাণ.... কর মােরে পার। অনুপম ঘনশ্যাম, আমার হৃদয়মাঝে. ....পড়েছি অকূল পাথারে. ....তাই ডাকি বার বার।। উদয় হবে। একবার নাচোতাে নিকুঞ্জ বনে..... গান গুলির মধ্যে কেবল ঈশ্বরকে আরাধনাই থাকে না , থাকে প্রার্থনা। যেন গেরস্থের গৃহে শোক রোগ, অমঙ্গল প্রবেশ না করে। শোননি গো শচী মাতা,গৌর আইল প্রেম দাতা।। ঘরে ঘরে হরির নাম বিলায় রে।গোরা ঘরে ঘরেহরির নাম বিলায় রে। প্রভাত সময় কালেশচীর আঙিনার মাঝেকার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে। কেতুগ্রামের রাইখ্যা গ্রামে এখনো এই টহুলেরা আছেন। যুগের পরিবর্তন হয়েছে সঙ্গে জীবিকারও, তাও বেশ কিছু মানুষ এই প্রাচীন পেশাকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন। “প্রদোষ সময়ে শ্রীবাস অঙ্গনে সঙ্গপণে গোরামণি, শ্রীহরি কীর্তনে নাচে নানা রঙ্গে উঠিল মঙ্গলধ্বনি।” স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেবের অমোঘ প্রভাবে শুধু পদাবলী কীর্তন ও হরিনাম সংকীর্তন যেমন সুপ্রচলিত হয় তার সঙ্গে তা আপামর বঙ্গ জীবনের ধর্ম সংস্কৃতি চর্চায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। টহলের গান তার ব্যতিক্রম হয় নি। আচণ্ডালে দিল প্রেম আলিঙ্গন জাতিবিচার তার না ছিল কখন তবে কিনা প্রাক চৈতন্য যুগেও যেমন বৈষ্ণব ছিলেন ( রামায়েত) , পৌরাণিক বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার এবং প্রসার রুক্ষ রাঢ় বঙ্গের বুকে হয়েছিল।তাই তন্ত্রের রাঢ় কৃষ্ণ কথায় রসসিক্ত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে বাঁকুড়ার শুশুনিয়ার লিপি তার উল্লেখ্য দৃষ্টান্ত। বাঁকুড়া তথা সমগ্র বাংলার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে চন্দ্রবর্মা ও তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী পুষ্করণার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে কলিঙ্গরাজ মহামেঘবান খারবেল মগধের সীমা পর্যন্ত জয় করেন। খারবেলের মৃত্যুর পরের তৎকালীন বাংলার ইতিহাস নীরব। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বাংলার ইতিহাস নিয়ে লেখা রামপ্রাণ গুপ্ত তাঁর ‘প্রাচীন রাজমালা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে এই যবনিকা উত্তোলিত হয়। এই সময়ে রাজপুতনার মরুপ্রদেশের পুষ্করণা নগরের অধিপতি চন্দ্রবর্মা সপ্তসিন্ধুর মুখ বহ্লীকপ্রদেশ হইতে বঙ্গদেশ পর্যন্ত সমগ্র আর্যাবর্ত জয় করিয়াছিলেন’। চন্দ্রবর্মার খোঁজ মেলে শুশুনিয়া পাহাড়ের উত্তর ঢালে পাথরের গায়ে খোদিত এক লিপিমালাতেও। লিপিটি খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে খোদিত। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিসেন রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’-তে চন্দ্রবর্মার উল্লেখ দেখে ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, সমুদ্রগুপ্ত যে ন’জন রাজাকে পরাস্ত করে তাঁদের রাজ্য অধিকার করেছিলেন, চন্দ্রবর্মা তাঁদের এক জন। চন্দ্রবর্মার রাজত্বকালের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত একটি শিলালিপিতে। প্রাচীন মালবদেশের দশপুর-মন্দসৌর লিপিসূত্র অনুসারে, জয়বর্মার পুত্র সিংহবর্মা। সিংহবর্মার দুই পুত্র—বড়, চন্দ্রবর্মা ও ছোট, নরবর্মা। নরবর্মা ৪৬১ বিক্রমাব্দ অর্থাৎ ৪০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সুতরাং, চন্দ্রবর্মা তার পূর্ববর্তী। কিন্তু মন্দসৌর লিপিতে চন্দ্রবর্মার কোনও বংশধরের উল্লেখ পাওয়া যায় না।দিল্লির মেহরৌলি লিপিতে রাজা চন্দ্রর উল্লেখ মেলে। এই লিপি অনুসারে, রাজা চন্দ্রবর্মা বিষ্ণুপদগিরিতে বিষ্ণুর ধ্বজা স্থাপন করেছিলেন। ভারতে গয়াক্ষেত্রে ও রাজস্থানের পুষ্করে বিষ্ণুপদগিরি আছে। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘এই বিষ্ণুপদগিরি পুষ্করে হওয়াই অধিক সম্ভব’। চন্দ্রবর্মা তাঁর জন্মভূমির প্রতি টানবশত বাঁকুড়ায় অপর পুষ্করণা নগরীর পত্তন বা নামকরণ করেছিলেন। এই লিপি থেকে আরও জানা যায়, চন্দ্রবর্মা পূর্বে বঙ্গদেশ ছাড়া, পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতের কাছে বহ্লিকদেশ জয় করেছিলেন। শুশুনিয়া লিপি রাজা চন্দ্রবর্মার বঙ্গবিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথুরে প্রমাণ। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তি ও শুশুনিয়া লিপির চন্দ্রবর্মা এবং দিল্লির স্তম্ভলিপির চন্দ্র যে অভিন্ন, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নাই।’’শুশুনিয়া লিপির দু’টি অংশ। উপরের অংশে থাকা বৃত্ত বা চক্র থেকে কতগুলি রেখা বেরিয়ে এসেছে। এই রেখাগুলিও একটি বড় বৃত্ত বা চক্র দিয়ে ঘেরা। এই বৃত্তের সমান্তরালে থাকা আর একটি বৃত্ত থেকে চোদ্দোটি অগ্নিশিখা বেরিয়েছে। প্রতি অগ্নিশিখার পরে দু’টি অর্ধবৃত্ত খোদিত। লিপি বিবর্তনের প্রেক্ষিতে বলা যায়, শুশুনিয়ার লিপিটি ভাবলিপি। এমন লিপিতে কোনও বস্তু বা ভাবকে বোঝাতে পুরো ছবি না এঁকে সামান্য কিছু রেখা বা ‘মোটিফ’ ব্যবহার করা হত। পণ্ডিতেরা উক্ত ভাবলিপিকে ‘বিষ্ণুচক্র’ বলেছেন। এই বিষ্ণুচক্রের নীচে ও পাশে তিনটি ছত্রে খোদিত লিপি রয়েছে। এটি শুশুনিয়া লিপির দ্বিতীয় অংশ। সংস্কৃতে উৎকীর্ণ লিপির অক্ষর ব্রাহ্মি। পাঠ—‘পুষ্করণাধিপতে মহারাজ শ্রীসিঙ্ঘবর্মণঃ পুত্রস্য/ মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মণ কৃতিঃ/ চক্রস্বামিন দাসাগ্রেণাতি সৃষ্টঃ’ (পুষ্করণার অধিপতি মহারাজ শ্রীসিংহবর্মার পুত্র মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মার কীর্তি। চক্রস্বামী অর্থাৎ বিষ্ণুর অগ্রদাসের দ্বারা সৃষ্ট।) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এটি ‘দ্য ওল্ডেস্ট ব্রাহ্মি ইনস্ক্রিপশন ইন বেঙ্গল।’ এই প্রসঙ্গে তাঁর ছাত্র অধ্যাপক সুখময় চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘লিপি ব্রাহ্ম, নামান্তর গুপ্তলিপি। প, ম, হ, র প্রভৃতি কয়েকটি অক্ষর প্রায় আধুনিক বাংলা অক্ষরের মতো’। শুশুনিয়া লিপির গুরুত্ব আরও দু’টি কারণে। প্রথমত, রাজা চন্দ্রবর্মা স্বয়ং বিষ্ণুভক্ত হওয়ায় প্রজারাও রাজআনুগত্যের কারণে বিষ্ণু উপাসকে পরিণত হন। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের শুরুতে রাঢ়মণ্ডলে এই বিষ্ণুভজনা রাঢ়দেশ তথা সমগ্র বঙ্গে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, বিষ্ণুসেবার জন্য ভূ-দানের সাক্ষ্য দেয় শুশুনিয়া শিলালিপি। শুশুনিয়ায় চন্দ্রবর্মা খোদিত বিষ্ণুচক্র-র একটু নীচে বাঁ দিকে শঙ্খ আকৃতির মতো আরও একটি লিপি রয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবদেবীর পুজোয় শঙ্খমুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ওই লিপি তান্ত্রিক-শঙ্খলিপি। এখনও পাঠোদ্ধার হয়নি। অনুমান, চন্দ্রবর্মার আগে শুশুনিয়া পাহাড়ে বৌদ্ধ শ্রমণেরা থাকতেন। মহাযান বৌদ্ধমতের সঙ্গে তান্ত্রিক যোগ ছিল। তাই শঙ্খমুদ্রার আকারে লিখিত এই লিপিটি বৌদ্ধ শ্রমণদের সাধন-সঙ্কেতও হতে পারে।যাক, এসব ছাড়াও পাল ও সেন যুগে প্রচুর বিষ্ণু ভাস্কর্য মিলেছে রাঢ় বঙ্গের গ্রামে গ্রামে। ২০১৬ সালে কাটোয়া সন্নিকটে অজয় নদীর গর্ভ হতে চারিটি বিষ্ণু বিগ্রহ প্রাপ্ত হয়। তাই , কোনও সন্দেহ নেই যে প্রাক চৈতন্যযুগে রাঢ় অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের বিপুল প্রভাব সম্পর্কে। পৌরাণিক বৈষ্ণব ধর্মালম্বীদের একটি উল্লেখযোগ্য গার্হস্থ্য ব্রত ছিল , চতুর্মাস ব্রত। চতুর্মাসেষু কর্তব্যং কৃষ্ণভক্তি বিবৃদ্ধয়ে ॥ শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন ও কার্তিক। শ্রীভগবান বিষ্ণু ক্ষীর সাগরে শ্বেতদ্বীপে অনন্ত শয্যায় নিদ্রিত হন। বলা হয় শয়নী একাদশী (জগন্নাথ রথযাত্রার পর আষাঢ়ী শুক্লা একাদশী) তিথিতে ভগবান শয়ন গ্রহণ করেন। পার্শ্ব একাদশী (ভাদ্র শুক্লা একাদশী)তে পার্শ্ব পরিবর্তন করেন, এবং উত্থান একাদশী (কার্তিক শুক্লা একাদশী)তে উত্থিত হন।বছরের এই চারি মাস প্রাকৃতিক কারণে মানুষের দেহ ও মনে রজো ও তমোগুণী প্রভাব অধিক দেখা যায়। অঘটন বেশী ঘটে। তাই কায়মনোবাক্যে সংযত থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনও কোনও বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।ব্রতের নিয়ম গুলি হল: ১. হরিনাম জপ করতে হবে। ২. প্রতিদিন গীতা-ভাগবত শ্রবণ বা পাঠ করতে হবে। ৩. তর্ক, গালগল্প এড়িয়ে চলতে হবে। ৪. প্রত্যূষে স্নান সারতে হবে। ৫. শ্রাবণে শাক, ভাদ্রে দই, আশ্বিনে দুধ এবং কার্তিকে মাষকলাই ডাল খাওয়া চলবে না। এই সময়ে এই দ্রব্যগুলি রোগ সৃষ্টি করে। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে-শ্রাবণে বর্জয়েৎ শাকং দধি ভাদ্রপদে তথা। দুগ্ধম্ আশ্বযুজে মাসি কার্তিকে চামিষং ত্যজেৎ ॥বিশেষতঃ, কার্তিক মাসে বেগুন, বরবটি, শিম আহার নিষিদ্ধ।৬. শ্রীহরি অর্চন কিংবা শ্রীহরিভক্তিমূলক অন্য কোনও সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। এই চাতুর্মাস্য ব্রতের ব্রতকারীরা কেউ শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী পর্যন্ত, কেউ আষাঢ় মাসের গুরু পূর্ণিমা থেকে কার্তিক মাসের হৈমন্তী রাস পূর্ণিমা পর্যন্ত, আবার কেউ কর্কট সংক্রান্তি থেকে মকর সংক্রান্তি পর্যন্ত- এইভাবে পালন করে থাকেন। মোটামুটি যে দিন শুরু করবেন তার চার মাস পরে সমাপন করবেন।এই ব্রত ফলে মন সুন্দর হয়, শরীর ও প্রাণ সুন্দর হয়। বলা হয়, চার মাস বিষ্ণু শায়িত থাকেন। মানুষ এই ব্রত করলে বিষ্ণুর সুখনিদ্রা হয়। বিষ্ণুর পাদপদ্ম সেবায় রতা লক্ষ্মীদেবী তখন ব্রতকারীদের প্রতি প্রসন্না হন। তখন লক্ষ্মীর তুষ্ট দৃষ্টিপাতের ফলে ব্রতকারী লক্ষ্মীমন্ত হয়। এবং চ কুর্বতো মাসাং শ্চতুরো যান্তি বৈ সুখম্। অন্যথা প্রভবেদ্ দুঃখম্ অনাবৃষ্টিশ্চ জায়তে ॥ “এভাবে চারি মাস ব্রত পালন করলে সুখে যাপন হবে। নতুবা দুঃখের প্রভাব বৃদ্ধি হবে, অনাবৃষ্টি ও অন্যান্য দুর্বিপাক লেগে থাকবে।”নারায়নের নিদ্রা ভঙ্গ হয় কার্তিক মাসের শুক্লা একাদশীতে।এইদিন তিনি নিদ্রা ওঠেন। তাই এটি উত্থান একাদশী নামে পরিচিত। মানুষের বিশ্বাস এই কার্তিক মাসের প্রত্যুষে হরি কথা শুনেই হরির নিদ্রা ভঙ্গ হয়। পরবর্তীকালে এই হরির কথার সঙ্গে গৌরহরির গাঁথা যুক্ত হয়ে টহলের গান তৈরি হয়েছে। তোমাদের ষোলো আনা দাওনা.... আরে, দশে ছয় যোগ করে ষোলো আনা দাও না দশে ছয় যোগ করে , দশ গৃহ ছয় রিপু। দশে ছয় যোগ করে ষোলো আনা দাও না.... জয় নিতাই গৌর , হরি বোল হরি বোল, হরে কৃষ্ণ......... #ক্রমশঃ #দুর্গেশনন্দিনীতথ্যঃ ১. বাংলার মুখ ২. বাংলার ব্রতকথা ৩. শুশুনিয়া লিপি ও চন্দ্রবর্মা ৪. জয়ঢাক