চতুর্থ পর্ব
মলুটী গ্রামের প্রধান উৎসব গুলির মধ্যে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, মনসাপুজো, ধর্মরাজপুজো , দোল ও মৌলীক্ষা মায়ের মহোৎসব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও লক্ষ্মীপুজো , সরস্বতীপুজো , অন্নপূর্ণাপুজো প্রভৃতি বারোয়ারি পুজো পালিত হয় এবং তাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। শুধুমাত্র ঝারখন্ডে অবস্থান ছাড়া অন্যকোনো দিক দিয়েই বীরভূমের আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে মলুটীর কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায়না । উক্ত পুজো উৎসবগুলো মলুটী গাঁয়ে বিশাল আকার ধারণ করে।
এমনি একটি বড় উৎসব হলো মনসা পুজো। মলুটী গ্রাম জুড়ে প্রায় ছয়টি মনসা পুজো হয় । মলুটীর মনসা পুজো বাউড়ি এবং বাগদী বর্ণের পুজো। তাঁরা উদ্যোক্তা এবং সেবায়েত। কিন্তু শস্য, নাগ, বৃষ্টি, উর্বরতার দেবী মনসা সকলের দেবী। তাই সমস্ত জাতি, ভাষা ও বর্ণের মানুষ মনসা পুজো দেন। #বারি_আনা ও #ডিঙ্গে_ফেরানোর শোভাযাত্রা যোগ দেয় ।
ঢাক বাজিয়ে , দল বেঁধে মনসাপুজোর ঘট ভরে আনাকে #বারি_আনা বলা হয় । বারি_আনার সময় সবাই মিলে একসঙ্গে মনসার প্রশস্তি গায়ে, যাকে বলে #চিয়েন_গান।
মাকে আনতে চলো ভাই দীঘি সরোবর
কি আনন্দ হল মায়ের তপিনি নগর
মাকে আনতে চলো ভাই দীঘি সরোবর।
পূর্ণঘট মাথায় নিয়ে উপসী ভক্তদের শোভাযাত্রা এগিয়ে চলে মন্দিরের দিকে। ভক্তদের সামনে বাজে ঢাক , ঢোল, কাঁসর বাজে আর পিছনে দলবেঁধে আসা মেয়ে পুরুষরা গান ধরে :
তোরা দেখ্গো দাঁড়ায়ে মা মনসার বারি এল
লহরী খেলিয়ে।
কোথাও আবার পথে দুই পুজোর শোভাযাত্রা মুখোমুখি হলে ছড়া কেটে কেটে #বোল_কাটাকাটি শুরু হয়। অর্থাৎ একপক্ষের ছড়া বা বোলকে অন্যপক্ষ ছড়া বলে কাটান দেবে। যেমন : একপক্ষ গলা তুলে বলল :
থান বন্ধন , সেবা বন্ধন, বন্ধন বসুমতী
এপার ওপার ঘাট বন্ধন দেবী সরস্বতী
ওঠরে নাগিনীর বিষ গড়ুরের সহায়
নাই বিষ তো নাই, মা মনসার দয়।।
অপর পক্ষ তখন গলা তুলে প্লাটা কাটান দিয়ে উত্তর দিল :
ওরে মা মনসা দাঁড়িয়ে আছে , গলে ফুলের মালা,
শঙ্খের ভিতরে বিষ করিছেন খেলা
ওঠরে নাগিনীর বিষ গড়ুরের সহায়
নাই বিষ তো নাই, মা মনসার দয়।।
এক ধরনের কবির লড়াই প্রায়….
মলুটীর মনসা পুজোয় পাঁঠা বলি হয় । বলিদান এরপর গান গাইতে গাইতে চাকা লাগানো ছোট ছোট কাঠের নৌকা গ্রামের পথে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় :
কাঞ্চন বরণী মনসা জ্বলজ্বল করে
লাল জবা , পুষ্প জবা দিব স্তরে স্তরে।
বা
সময় বিশেষে শব্দের পরিবর্তন হয়ে গিয়ে হয় :
কাঁচের ভরণে মনসা জয় জয় করে
লাল জবা , পুষ্প জবা দিব তরে তরে।
অনুমান করা হয় চাঁদ সদাগরের ডুবে যাওয়ার সপ্তডিঙা মনসার দয়ায় ফিরে পাবার অনুকরণে এই অনুষ্ঠানটি করা হয়ে থাকে । সেজন্য এই অনুষ্ঠানের নাম #ডিঙ্গে_ফেরানো।
এছাড়া মাঝেমধ্যে কাঁধে মনসা নিয়ে কোন দেবাংশী হাতের কাঁসি বাজিয়ে গান গেয়ে ঘরে ঘরে মা মনসার মাহাত্ম্য প্রচার করে যায়।
খুব অদ্ভুত ব্যাপার যে মনসা একেবারে সাধারণ মানুষের পুজো হলেও মলুটীর নানকার রাজবংশের ছয় তরফের কুলদেবীও বটে। এই তরফ কাছেই কাষ্ঠগড়া গ্রামে মনসা প্রতিষ্ঠা করেন । সেখানে এখনো পুজো হয়। এত দেবদেবীর থাকতে তাঁরা কেন দেবী মনসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাও মা মৌলীক্ষার সিদ্ধ পিঠে , তার কারণ আজও অজানা! সব থেকে বড় ব্যাপার হলো, মলুটী গাঁয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মৌলীক্ষা থাকা স্বত্তেও ছয় তরফের জমিদাররা ছেলে মেয়ের বিবাহ , পৈতে , অন্নপ্রাশন ইত্যাদি শুভ অনুষ্ঠানে আগে কাষ্ঠগড়ার মনসা থানে পাঁঠা উৎসর্গ দিয়ে পুজো দেন । এসব প্রথার কি কারণ তা জানা যায় না। কারণ যদি কখনো জানা যায় তবে হয়তো মলুটী গাঁ , নানকার রাজবংশের কিংবদন্তির ঝাঁপি খুলে যাবে।
মলুটীর দোল উৎসবও বিশাল। এসময় কাশীর সুমেরু মঠ থেকে নানকার রাজবংশের সন্ন্যাসী গুরুরা মলুটীতে এসে কিছুদিন বাস করেন।
আগের পর্বগুলোতে মলুটীর বৈষ্ণব প্রভাব নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। তবে কিনা, শ্রদ্ধেয় গোপালদাস মুখোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলার আর পাঁচটা জায়গার রাজা জমিদাররা যেমন দোল উৎসবের সূচনা করেন সেই ভাবেই মলুটী গ্রামে দোলের সূচনা হয়। কোনদিনই আলাদাভাবে বৈষ্ণব প্রভাব পড়েনি। এ বিষয়ে গবেষক সতীনাথ রায়ও প্রায় একমত পোষণ করেন।
তবে , প্রশ্ন থেকে যায় , মলুটীতে বিরাট সংখ্যক শিব মন্দিরের মধ্যে একটি রাসমঞ্চ মন্দির তৈরি হয়েছিল কেন ? এই রাসমঞ্চ এতই প্রাচীন যে ঝাড়খন্ড ঝারখন সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ প্রথমেই যে কটি মন্দির সংস্কার করার প্রয়োজন বলে মনে করেন এটি তারই একটি । পূর্ব পর্বেই বলেছি যে , এই রাসমঞ্চ বড়তরফের কেউ স্থাপন করেছিলেন, সে রাজার নাম আজও জানা যায় না । এটি সম্ভবত মলুটীর প্রথম দিকে তৈরি হওয়া মন্দির গুলির মধ্যে অন্যতম।
এছাড়া মলুটীতে বিখ্যাত ধর্মরাজ পূজা। রাঢ় বঙ্গের অন্ত্যজ দরিদ্র শ্রেণীর সাধারণ মানুষের ঠাকুর হলেন নারায়নের লৌকিক রূপ স্বরূপনারায়ণ অর্থাৎ ধর্ম্মঠাকুর। তিনি রাঢ় বঙ্গের সাধারণ মানুষের ত্রাণ কর্তা। তাঁর নিকট লাউসেনও যা কালু ডোমও তাই। ধর্মমঙ্গল তাই হয়ত রাঢ় বঙ্গের মহাকাব্য।ধর্মমঙ্গল থেকে জানা যায় তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিস্থিতির কথা। এসব কারণেই রাঢ় বঙ্গের গাঁয়ে গাঁয়ে ধর্ম ঠাকুর নানা নামে স্বয়ং অবস্থান করেন।
উর ধর্ম্ম আমার আসরে।।
কাতর কিঙ্কর ডরে আসরে স্মরণ করে।
তেজ ধর্ম্ম বৈকুণ্ঠ নগর ।।
বিড়ম্বনা দন্ড কত দেখ নাট শুন গীত।
আপনি আসরে কর ভর।।
সুতরাং , রাঢ় অঞ্চলের একটি অংশ এবং ঝাড়খণ্ডের গাঁ মলুটীতে ধর্মঠাকুর পুজো বিখ্যাত হবে সেটাই স্বাভাবিক। মলুটী গাঁয়ে প্রায় চারিটি ধর্মরাজ পুজো হয়।
মলুটী গ্রামসমাজের বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়া সঙ্গে ধর্মরাজ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গ্রামের চাষিরা আখ মাড়াই করে গুড় তৈরীর সময় আখের রস জ্বাল দেবার উনুনের পাশে ধর্মরাজ বলে একটা পাথর পুঁতে রাখেন ।প্রথম গুড় উঠলে সেই গুড় ধর্মঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়। মৌলুটীর এক বড় সংখ্যক মানুষ বাত বেদনার উপশমের জন্য ওষুধপত্রর চেয়ে ব্যথার জায়গায় ধর্মরাজ তলার মাটির প্রলেপ দেওয়ায় অধিক বিশ্বাসী।
ধর্মরাজে কোন মূর্তি এখানে নেই বা হয়না। তাঁর প্রতীক একখণ্ড পাথ।র সাধারণভাবে রাঢ়বঙ্গের যেখানে যেখানে ধর্মরাজ পূজো হয় সেখানে ধর্মরাজের পাথরের আকার ও আকৃতি কূর্ম আকারের হয়ে থাকে। পুজোয় হাঁস-মুরগির বলি দেওয়া হয়। #ছলন হিসাবে ছোট ছোট পোড়ামাটির ঘোড়া ধর্মরাজের কাছে মানত করা হয় ।অন্য গ্রামের মত #লায়ারা ধর্মরাজ পুজো করে থাকেন।
মলুটী গাঁয়ের এক অন্যতম উৎসব হল কালীপুজো। #কোথায়_পাবো_তারে উপন্যাসে মলুটীর কালীপুজোর সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। নানাকার রাজারা ডামরা পরবর্তী পর্যায়ে আসার সময় রাজ পূজিতা দক্ষিণাকালীকেও সঙ্গে আনেন। তাঁকে #আদিকালী বলা হয়। রাজারা মন্দির গড়ে পঞ্চমুন্ডির বেদিতে আদিকালীকে প্রতিষ্ঠা করেন ।তখন মন্দিরের পাশে শ্মশান ছিল । পরবর্তীকালে রাজবংশ বিভিন্ন শরিকে ভাগ হওয়ার পর আরও সাতটি কালী প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে তাই, মলুটীতে মোট আটটি কালী পুজো হয়। শোনা যায়, আদিকালী ছাড়াও আরো আরো দু’তিনটি কালী পঞ্চমুন্ডির আসনে অধিষ্ঠিতা । এর মধ্যে বিভিন্ন কালী বিভিন্ন কারনে বিখ্যাত। সেসব অনেক ইতিহাস, অনেক কথা , অনেক কিংবদন্তি । একদিন যখন শুধুমাত্র মলুটীর কালীপুজো নিয়ে লিখব সেদিন নিয়ে লেখা যাবে।
মলুটী গ্রামে অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা মৌলীক্ষা । মলুটীতে আসার সময় রাজাদের সঙ্গে তাঁদের কুলদেবী সিংহবাহিনী ছিলনা। জঙ্গলের মধ্যে দেবী মৌলীক্ষাকে খুঁজে পাওয়ার পর মা মৌলীক্ষাকে সিংহবাহিনীজ্ঞানে পুজো করে আসছেন । দেবী মৌলীক্ষার আরো অনেক বড় ইতিহাস আছে এবং তা নিয়ে আমি আগেই একটি অন্য প্রবন্ধ #মলুটি_গাঁ_ও_দেবী_পান্ডারা_থেকে_মৌলীক্ষার_কথা-য় লিখেছি।
নিত্যপুজো , ভোগ , আরতি ছাড়াও আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীর সময়, চৈত্র মাসে হোমের সময় মা মৌলীক্ষার #মহাপূজা হয় । পৌষ সংক্রান্তিতে মৌলীক্ষার #মহোৎসব আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। মহাপুজার দিনগুলোতে মলুটীর মানুষজন মৌলীক্ষা মায়ের কাছে অঞ্জলি না দিয়ে জল খান না। ওই দিন সারা গাঁয়ের সবাই নিরামিষ খান।
পৌষ সংক্রান্তির মহোৎসবের দিন মালুটির কোনো বাড়িতে রান্না হয় না। দুপুরে সবাই পাতপেড়ে মা মৌলীক্ষার ভোগ খান। ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্ত সমাগম ঘটে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার মানুষ মায়ের ভোগ প্রসাদ পেয়ে থাকেন।
এহেন ধার্মিক ও আস্তিক মলুটীর ১০৮ মন্দিরের কথা আমি পর্বগুলোতে একে একে বলতে বলতে আসছি। পূর্ব পর্বগুলোতে মন্দিরের গঠন ,ধরন , ইঁট, ক্জউন সুরকি, টেরাকোটা প্যানেল নিৰ্মাণ ও ষড়ভূজ কৃষ্ণমূর্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি । আজ আরো কিছু দুর্লভ টেরাকোটা প্যানেলের কথা বলব।
মন্দিরের মুখ্য প্যানেল দরজার উপরে। প্রায় সব মুখ্য গুলোতেই রাম রাবণের যুদ্ধ দেখা যায় । কোথাও দুজনেই মাটিতে দাঁড়িয়ে একা একা যুদ্ধ করছেন, আবার কোথাও রাবণ রথে চড়ে এবং ঝুঁটিধারী রাম মালকোচা মেরে ধুতি পরে হনুমানের কাঁধে চড়ে যুদ্ধে রত। তাঁর পিছনে ভাই লক্ষণ। এই চিত্রটির ভাবনা এসেছে সম্ভবত কৃত্তিবাসী রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কাকাণ্ডের #রাম_রাবণের_প্রথম_যুদ্ধ থেকে।
রাবণ বসিয়া আছে আপনার রথে ।
দশ যোজন দেহ কৈল আড়ে পরিসর।
সংগ্রামেতে যান রাম ধনুৰ্ব্বাণ হাতে ।
দীৰ্থে ত্রিশ যোজন হইল কলেবর ॥
রাবণে মারিতে যান পুরিয়া সন্ধান।
লেজ কৈল দীর্ঘকার যোজন পঞ্চাশ।
হেনকালে জোড়হাতে বলে হনুমান ॥
হনুমানের লেজ গিয়া ঠেকিল আকাশ ।
রথে চড়ে যুঝে রাবণ শ্রম নাহি জানে।
হনুমানের লেজ দেখে” রাবণের ভয়।
ভূমিতে থাকিয়া তুমি যুঝিবে কেমনে।
বালি-রাজার মত পাছে লেজে বেন্ধে লয়।
মোর পৃষ্ঠে রঘুনাথ কর আরোহণ।
রঘুনাথ বাণ এড়ে জলন্ত আগুনি ।
আমার পৃষ্ঠেতে চড়ে মারহ রাবণ।
সব বাণ কাটে রাবণ পরম-সন্ধানী ॥
হনুমানের পৃষ্ঠেতে চড়েন রঘুবর।
শ্রীরাম ঐষিক বাণ জুড়েন ধনুকে।
ঐরাবতে বার যেন দিলা পুরন্দর।
সন্ধান পুরিয়া মারে রাবণের বুকে ॥
এই বর্ণনাটি হুবহু উঠে এসেছে মন্দিরের গায়ে। এই ফলকটিতে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় হনুমানের মুখের ভাব।
দু একটি ফলকে রাম এবং রাবণ দুজনেই রথারূঢ়। তবে কিনা রাবণমূর্তি সর্বদাই একক। সম্ভবত দশানন রাবণের অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য একটি ফলকে যতটা জায়গা লেগেছে, তাতে একই ফলকে অন্য কোনো চিত্র স্থান দেওয়া শিল্পীর পক্ষে সম্ভব হয়নি
।
মাটিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার সময় রাবণের পায় নাগরা জুতো , কাপড় পরার ঢংটির মধ্যেও বেশ বৈশিষ্ট্য আছে।
রথারূঢ় রাম ও রাবণের ক্ষেত্রে তাঁদের পায়ের নিচে চাকা লাগানো পিঁড়ি দেখতে পাওয়া যায় । সেটিই তাঁদের রথের প্রতীক।
রাম – রাবণের মূর্তির ঠিক নীচেই দেখা যায় রামের বানর সেনা এবং রাবণের রাক্ষস পরস্পরের বিরুদ্ধে বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত । এই প্যানেলে মূর্তিগুলি রাম রাবণের থেকে ছোট হলেও এই বিস্তৃত প্যানেলে ক্ষেত্রবিশেষে কুড়িটির অধিক মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় ।
মলুটীর একটি মন্দিরে রাম রাবণের যুদ্ধের বদলে মহিষাসুরমর্দিনী’র অপূর্ব সুন্দর একটি মূর্তি আছে। এই মূর্তির চারটি বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত , এখানে ত্রিশূল বিদ্ধ অসুর থাকলেও মোষের ধর বা মুন্ড কিছু নেই । দ্বিতীয়ত, সিংহের মুখ এবং দেহে উড়িষ্যার প্রভাব স্পষ্ট। তৃতীয়ত, এই প্যানেলে দেবী দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতীর উপস্থিতি থাকলেও , কার্তিক গণেশ সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত । এখানেই সেই মহামায়ার ত্রিশক্তির কথা দারুন ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। আদি পরাশক্তি দেবী মহামায়া, মহাবিদ্যা এবং মহা লক্ষ্মী। চতুর্থত , অদ্ভুতভাবে অসুরের মাথায় মরুবর্বরদের টুপি আছে। মহিষের অনুপস্থিতি ও অসুরের মাথায় বৈদেশিক টুপি থাকার মাধ্যমে শিল্পী ও মন্দিরের পৃষ্ঠপোষক কি কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চেয়েছিলেন?
শোনা যায় অন্তত তিনটি মন্দিরের মুখ্য প্যানেলে এই ধরনের চিত্র বা মূর্তি ছিল । তার মধ্যে একটি ছিল কমলেকামিনী মূর্তি ।
মুখ্য প্যানেলের ঠিক উপরের দিকে ধনুকের মত বাঁকাভাবে কয়েকটি ছোট মূর্তির ফলক দেখা যায় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দশাবতার অথবা দশমহাবিদ্যার মূর্তি থাকলেও , দু এক জায়গায় লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ সমেত দেবী দুর্গাও উপস্থিত আছেন। যে কোন কারনেই হোক, দশাবতারের মধ্যে বুদ্ধ , কল্কী এবং পরশুরাম অনুপস্থিত।
সম্পূর্ণ অলঙ্কৃত মন্দিরগুলোর উপরের অংশে যে দেবতার মন্দির তার মূর্তি দেখা যায়। তবে উল্লেখযোগ্য হল গঠনগত দিক থেকে সেগুলো শিব মন্দির হলেও কোথাও কোথাও কালী, দুর্গা এবং একটিতে রামের মূর্তির ফলকও দেখা যায় ।
মলুটীগ্রামের টেরাকোটা মন্দিরের দুর্গা মূর্তি চিত্রিত টেরাকোটা প্যানেল নিয়ে যখন আলোচনা করছি তখন মলুটীর দুর্গা পুজো নিয়েও কিছু বলতে হয় ।
নানকার রাজবংশের দেবী হলেন সিংহবাহিনী। সেই সিংহবাহিনী হলেন মা মলুটী। এবার দেবী মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গেলে বিশাল ব্যাপার। যা হোক , যা বলছিলাম , তাই নানকার রাজবংশ দেবী সিংহবাহিনীকেই দুর্গা রূপে পুজো করা হত। কারন, সিংহবাহিনী দেবীর অপর নাম। আলাদা করে মূর্তি কিনে বা গড়ে দুর্গা পুজোর চল সম্ভবত ছিল না। সেই জন্য, ভাটিনা, সেনবাঁধা ও নাককাটিতে তাঁদের সিংহবাহিনী পুজো করার কথা জানা গেলেও দুর্গাপুজোর কথা শোনা যায় না ।ডামরায় কি হতো বলা সম্ভব নয়। তবে ডামরায় পরবর্তী পর্যায় সিংহবাহিনীর পুজোও মূর্তি গড়ে নয় , ঘটে হতো।নানকার রাজারা মলুটীতে আসার পর রাজা আনন্দচন্দ্রই প্রথম দুর্গা পুজো শুরু করেন।
রাজা আনন্দচন্দ্র মূর্তি গড়ে দুর্গাপুজো আরম্ভ করলেন এবং তার শুরুতেই ঘটনা ঘটে যাওয়ায় নানকার রাজবংশে দুর্গাপুজো নিয়ে কিছু সংস্কার গড়ে উঠলো। প্রথমত , যেহেতু এমনিতেই দেবী সিংহবাহিনী রূপে পূজিতা তাই তিনি চান না মলুটীতে মূর্তি গড়ে তাঁর পুজো হোক। দ্বিতীয়ত, পুজো বন্ধ হোক তাও তিনি চান না। তাছাড়া প্রজারাও রাজার আদেশ অমান্য করে দেবী মূর্তি নদীতে বিসর্জন দেন নি। সুতরাং, নানকার রাজারা সিদ্ধান্ত নেন যে , মলুটীতে দুর্গা পুজো থাকবে কিন্তু কখনো প্রতিমা গড়ে পুজো করা হবে না।
মলুটীতে বিভিন্ন সময় আটটি দুর্গা মন্দির গড়ে উঠলেও পুজো কিন্তু আজও নবপত্রিকার সামনে ঘট স্থাপন করেই হয়ে আসছে। বড়জোর সেখানে দুর্গার পটচিত্র থাকে। কিন্তু মূর্তি একেবারেই নয় । এরম পটের দুর্গা পুজোর চল বীরভূম, বাঁকুড়া ইত্যাদি স্থানেও আছে। সেখানেও এরম নানা কারণ, কুলদেবী ,তন্ত্রযন্ত্র সংক্রান্ত বিষয় #ঘটেপটেই পুজো হয়। সে সব কথা আমি #বীরভূমের_পটকথা_ও_দুর্গা নামক প্রবন্ধে আলোচনা করেছিলাম।। যদিও বর্তমানে মলুটীর পুজোয় রাজামলের মতো জাঁকজমক কমে এসেছে তবে যা আছে তাও কম নয়।
প্রসঙ্গত , একটি কথা বলা জরুরি, সেটি হল কোথা য় পাব তারে উপন্যাসটি মলুটীকে জনসমক্ষে নিয়ে এলেও তার মধ্যে লিখিত এমন অনেক ব্যাখ্যা বা কথাই সত্যের সঙ্গে মেলে না। যেমন , উপন্যাসে কালকূটকে বড় তরফের ভাই বলেছেন যে , মলুটী বা রাজবংশে দুর্গা পুজো নেই। কিন্তু এটা মোটেই সত্য নয়। মলুটীতে যে আটটি পুজো তার সবগুলোই মলুটীর রাজবংশের শুরু করা এবং তাঁরাই পুরুষানুক্রমে এই পুজোগুলো চালিয়ে গেছেন।
পুজোগুলো সবই রাজদের পারিবারিক পুজো। মলুটীর একমাত্র সর্বজনীন দুর্গাপুজোটি শুরু হয় আজ থেকে শতখানেক বছর আগে। গোটা গাঁয়ে ওই একটি দুর্গা মূর্তি স্থাপন করে পুজো হয়। এই পুজো চালু করেছিলেন সুখদানন্দ ব্রহ্মচারী। তিনি ইঁটে গোঁসাই নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর জীবনী আশ্চর্য গল্পের মতো হলেও সেখানে কোনো ভেজাল বা মিথ্যা নেই। সেই ইঁটে গোঁসাইয়ের কথা একদিন আলাদা করে বলব।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১) মলুটির টেরাকোটার মন্দির
২) মন্দিরময় মলুটী