#প্রথম_পর্ব
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সংগীত-মুখরিত গগনে
তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।
“বারো মাসে তেরো পার্বন ” এহেন শব্দরাজি বা পঙক্তি কেবল বঙ্গ জীবনেরই অঙ্গ নহে বরং সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য প্রযোজ্য। এমন ধারা পাল পার্বন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী , নাগাল্যান্ড থেকে গুজরাট , বঙ্গ থেকে গোয়া সকল জাতি, জনজাতির জীবনে অন্যতম অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হয়।
আজথেকে হাজার হাজার বছর পূর্বে বৈদিক ঋষিরা উদাত্তকণ্ঠ বলে গেছেন।
“দ্বাদশ প্রধয়শ্চক্রমেকং ত্রীণি নভ্যানি ক উ তচ্চিকেত।
তস্মিন্ৎসাকং ত্রিশতা ন শঙ্কবোহর্পিতাঃ যষ্টির্ন চলাচলাসঃ।।
বর্ষ চক্রে দ্বাদশ মাস আরের ন্যায় আবর্তন করে। ইহার কেন্দ্র স্থলে গ্রীষ্ম বর্ষা শীত এই তিন ঋতু রহিয়াছে।এই তত্ত্বকে কে জানে! এই বর্ষচক্রে ৩৬০দিনর্দ্ধ, কীলকের ন্যায় স্থাপিত।ইহার ব্যতিক্রম ঘটে না।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা বাংলা বছর ও মাসের হিসাব রাখতে খুব একটা অভ্যস্ত নই। এ কারণে ছয় ঋতুর নাম অনেকের মনে থাকলেও মাসগুলোর নামের বেলায় দ্বিধা তৈরি হয়। আজকের বাংলা মাস কুইজে অবশ্য সে দ্বিধা যাচাই করা হবে না। বরং জানতে চাওয়া হবে মাসগুলোর নামের উৎস সম্পর্কে।
উপমহাদেশে পঞ্জিকা গণনা পদ্ধতি চালু হয় আনুমানিক ১৫০০ পূর্বাব্দে। তখন বারো মাসে বছরের হিসাব ধরা হয়েছিলো। মাসগুলোর নাম ছিলোঃ (১) তপঃ (২) তপস্যা (৩) মধু (৪) মাধব (৫) শুক্স (৬) শুচি (৭) নভস (৮) নভস্য (৯) ইষ (১০) উর্জ (১১) সহস ও (১২) সহস্য। পরে এদের নামে পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন নক্ষত্রের নামানুসারে প্রতিটি মাসের নামকরণ করা হয়।
কোনো চান্দ্র মাসের পূর্ণিমার দিন যে নক্ষত্র থাকে, সেই নক্ষত্রের নাম থেকে মাসের সংস্কৃত নামগুলি এসেছে। সেই বিশেষ নক্ষত্রটি চিত্রা হলে মাসটির নাম চৈত্র। আবার পূর্ণিমা বিশাখা নক্ষত্রে পড়লে সেই মাসের নাম হয় বৈশাখ।
একই ভাবে জ্যেষ্ঠা, পূর্বাষাঢ়া, শ্রবণা, পূর্ব ভাদ্রপদ, অশ্বিনী (পূর্বনাম অশ্বযুজ) কৃত্তিকা, মৃগশিরা, পুষ্যা, মঘা, পূর্বফল্গুনী নক্ষত্রের নাম থেকে বাকি মাসের নামগুলি এসেছে।
ভারতের বিভিন্ন আদি জনজাতি সম্প্রদায়ও বছরের বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন উৎসব পালন করেন। বীজ বপনের সময় এলে #এরকসিম উৎসব , বীজ বপন হয়ে গেলে #হৌরিয়াডসিম উৎসব এবং শস্য সংগ্রহের পর তাঁরা মেতে ওঠেন #সাহারায় উৎসবে।
শীতের জরা ,রুক্ষ, শুষ্ক , পাতা ঝড়া তাপসনিশ্বাসবায়ে , মুমূর্ষুরে উড়ায় দিয়ে , বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে আসে বসন্ত , আসে ফাগুন।
রঙিন ফুলের পাপড়িগুলো ফাগুন হাওয়ায় যাচ্ছে ভেসে
পথের ধারে নীল আঁধারে স্বপ্নগুলো কুড়ায় কে সে!
খোলা মাঠে বিজন ঘাটে আলোছায়ার মনমিতালি
কোকিল ডাকার অবসরে মালা গাঁথায় ব্যস্ত মালী।
আকাশপানে তাকিয়ে কেবল একটি দুটি তারা গোনা
.নদীর তীরে শ্যামল নীড়ে শ্যামের বাঁশি যায় গো শোনা।
ঘুমকাতুরে চোখের পাতায় নাচছে অলীক প্রজাপতি
এমন দিনে দিগন্তে হারিয়ে গেলে কার কী ক্ষতি?
সারা ভারত জুড়ে শুরু হয় রঙের উৎসব। সারা প্রকৃতির রঙের উৎসবে মাতে। কেবল রঙ নয় এই সময় গন্ধের উৎসবও শুরু হয়। সেই প্রাচীন মদন উৎসব, কোথাও দোল উৎসব ,কোথাও হোলা উৎসব, কোথাও হোরিখেলা , কোথাও বা হোলি উৎসব পালিত হয় পরমেশ্বর পরমাত্মা পরম প্রকৃতির নামে উৎসর্গ করে। এমনি আলোয় আর শাল, পিয়াল , মহুয়ার গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে শিমুল, পলাশ , কৃষ্ণচূড়ার আগুন রঙে রাঙা হয়ে ওঠা প্রকৃতির অন্যতম এক ফাগ উৎসব হল #বাহা।
প্রকৃতিই আমাদের সনাতনী ভারতীয় সমাজে ঈশ্বর। প্রকৃতিই নানা রূপে নানা নামে এই অখন্ড ভারতে পূজিত হয়ে এসেছেন যুগ থেকে যুগান্তরে। প্রকৃতিই এই ভারতীয় সমাজকে যুগে যুগে সুন্দর , মনোরম এবং সমৃদ্ধ করেছে। তাই প্রকৃতিই মা হিসাবে পূজিতা হন ভারতের নানা জনগোষ্ঠী এবং জনজাতি সমাজে।
ফাগুন-হাওয়ায় রঙে রঙে পাগল ঝোরা লুকিয়ে ঝরেগোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের বুকের ‘পরে॥ সেইখানে মোর পরানখানি যখন পারি বহে আনি, নিলাজ-রাঙা পাগল রঙে রঙিয়ে নিতে থরে থরে॥ বাহির হলেম ব্যাকুল হাওয়ার উতল পথের চিহ্ন ধরে–ওগো তুমি রঙের পাগল, ধরব তোমায় কেমন করে। কোন্ আড়ালে লুকিয়ে রবে, তোমায় যদি না পাই তবে রক্তে আমার তোমার পায়ের রঙ লেগেছে কিসের তরে॥ |
বসন্ত আগমনে ফাল্গুনী পূূর্ণিমা
রাতে যখন ফাল্গুনের কাঞ্চন ফুল বিকশিত হয়ে রাতের তারার মতো বন আলো করে ফোটে, ডালে ডালে আমের বোল মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে ভ্রমর কে জ্যোৎস্না রাতে মধু খেতে ডাকে , দক্ষিণ হওয়া বেনু বনে সুর তোলে…যখন
স্পন্দিত নদীজল
ঝিলিমিলি করে,
জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি
বালুকার চরে।
নৌকা ডাঙায় বাঁধা,
কাণ্ডারী জাগে,
পূর্ণিমারাত্রির
মত্ততা লাগে।
তখন সাঁওতাল, মুন্ডা , হো , ওঁরাং সম্প্রদায়ের বাহা উৎসব সূচিত হয়।
বাহা মানে কি ?
বাহা মানে ফুল। বাহা উৎসব আগুন রঙা ফুলের উৎসব। বাহা উৎসব পালিত না হলে রাঢ়ে র আদিম জনজাতি কেউ পলাশ বা কোনো বুনো ফুলের সুমিষ্ট রস মুখে দেয় না। শালগাছের ফুল কোনো নারীর কবরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারন হয় না। মহুয়ার রসে কেউ মদমত্ত হয় না।কোনো বাড়িতে যদি এর ব্যতিক্রম হয় তাহলে সমাজের লায়া বা নায়কে অর্থাৎ পুরোহিত বাহা পূজা না হওয়া অবধি সে বাড়ির ছায়া স্পর্শ করেন না বা সেই গৃহের কারুর দেওয়া জলও স্পর্শ করেন না।
উক্ত সকল জনজাতি সমাজের বিশ্বাস ঈশ্বরের অনুমতি ব্যতীত প্রকৃতির নতুন ফুল, ফল ,পাতা ব্যবহার করা উচিৎ নয়। তাঁদের মতে পত্র পুষ্প দিয়ে প্রথমে ঠাকুর দেওতা , মারাংবুরু , জাহের এরা , মাড়ে কো র্তুরুই এর পূজা করা , উৎসর্গ করা উচিৎ। এই সময় বহু বৃক্ষ, লতা, গুল্মরাজি নানান ঔষধি গুনে ভরে ওঠে। এগুলি তাঁদের নিকট ঈশ্বর প্রদত্ত রোগমুক্তির ঔষধ। তাই ঠাকুর দেওতার দেওয়া ঔষধগুলি ব্যাবহারের পূর্বে তাঁকেই নিবেদন করে গাঁ ঘরের মঙ্গল কামনা করা হয়। তাই বাহা পরবের সঙ্গে এঁদের ধর্মবোধ , মঙ্গল অমঙ্গল জড়িত থাকে।
ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশী তিথি থেকে বাহা পরব পালিত হয়। বসন্তের আগমনে , দক্ষিনা পবনের শীতল ছোঁয়ায় প্রকৃতি নবরূপে সজ্জিত না হলে বাহা উৎসব হয় না। বাহা উৎসব কিন্তু একদিনের নয় বরং তিনদিনের পরব…. তিনদিনের আলাদা নাম, আলাদা নিয়ম । আলোচনা করব পরের পর্বে।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সমাজ : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে
প্রকৃতিককেন্দ্রিক লোক উৎসব : বাহা