আনন্দ অদৃশ্য। চোখে দেখা যায়না। অনুভব করা সম্ভব। তবে আনন্দ কেমন চোখে দেখতে লাগে তা বোঝার জন্য বুয়েনস আইরেসের রাস্তায় চোখ রাখলে বোঝা যেত। স্পষ্ট ধরা পড়ত আনন্দ সত্যি মানুষকে কীভাবে দুঃখ, যন্ত্রণা থেকে নিমেষে ভুলিয়ে দিতে পারে। বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনা (Argentina) দলকে বরণ করে নিতে রাস্তায় নেমেছিল প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। জনসমুদ্রের মাঝে যেমন প্রাণ গিয়েছে একজন ফুটবল প্রেমীর। অন্যদিকে পাঁচ বছরের এক শিশু এখন হাসপাতালে। কোমায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে মেসিদের (Leo Messi) আর হুডখোলা বাসে ঘোরানোর পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয় আর্জেন্টাইন সরকার। হেলিকপ্টারে করে সারা শহর ঘোরানো হয়। যথারীতি এই নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে কিছু জনতা। তাঁরা সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছে, তাঁদেরকে মেসি দর্শনে বঞ্চিত করার জন্য ভবিষ্যতে এই সরকারকে ফলভোগ করতে হবে।
একদিকে অর্থনৈতিক ভাবে বিধ্বস্ত এই দেশ। দশজনের মধ্যে কম করে চারজন বুভুক্ষু অবস্থায় দিন কাটান। ৩৬ বছর পরে বিশ্বকাপ জয় আর্জেন্টাইনদের যাবতীয় দুঃখ, দুর্দশার উপর যেন প্রলেপ দিয়ে গেল। সোমবার মাঝরাতে বিশ্বকাপ নিয়ে চাটার্ড ফ্লাইটে বুয়েনস আইরেসে নেমেছিলেন মেসি, ডি’মারিয়ারা (Angel Di Maria)। রাতে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের অফিসে তাঁরা রাত কাটান। ঠিক ছিল মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্বকাপ জয়ী সদস্যদের নিয়ে হুডখোলা বাসে পুরো শহর পরিক্রমা করা হবে। সময় ধরা হয়েছিল আট ঘন্টা। শেষ হবে শহরের ঐতিহাসিক স্থান ওবেলিসো সৃতিস্তম্ভে। সেইমতো বাসে করে মেসিরা কিছুদূর যাওয়ার পরে জনস্রোতের ঢেউ আছড়ে পড়ে বাসের উপর। দেখা যায় একটা ব্রিজের নিচ দিয়ে বাস যাওয়ার সময় দুই ব্যক্তি মেসিদের লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়েছেন। তারমধ্যে একজন বাসের মধ্যে পড়লেও অপরজন গিয়ে পড়েন বাইরে। বাধ্য হয়ে ফেডারেল পুলিশ ক্যাডেট স্কুলের সামনে গিয়ে বাস থামায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে মেসিদের বাস থেকে নামানো হয়। সেখান থেকে পাঁচটা হেলিকপ্টার করে মেসিদের নিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। দেশের প্রেসিডেন্ট এদিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু যেখানেই গিয়েছেন মেসিরা সেখানেই তিল ধারণের পরিস্থিতি ছিল না। রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ আর্জেন্টাইন জনতা। কিন্তু এত জনতাকে সামাল দিতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। তাই বাধ্য হয়ে হেলিকপ্টার করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু হেলিকপ্টার করে মেসিদের নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই জনতার সঙ্গে পুলিশের খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে থাকে। আর্জেন্টিনা প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র গ্যাব্রিয়েলা চিরুত্তি টুইটে জানান, “ফুটবল সমর্থকদের বাঁধনহীন উচ্ছ্বাস–আবেগকে সামাল দিতে প্রশাসনের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আসুন আমরা সকলে মিলে শান্তিতে এমন আনন্দের মুহূর্ত উদযাপন করি। সেই সঙ্গে খেলোয়াড়দের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাই।” বাসে মেসি, ডি’মারিয়াদের নিয়ে শহর পরিক্রমা করতে না পারায় টুইট করে জনতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থার প্রেসিডেন্ট ক্লদিও তাপিয়া। সেই সঙ্গে তিনি প্রশাসনের ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলে লেখেন–“যেসব নিরাপত্তা সংস্থা আমাদের ব্যারিকেড করে নিয়ে যাচ্ছিল তারা আসলে যাবতীয় গন্ডগোলের মূল কারণ। তারাই আমাদের ঠিকমতো এগোতে দিচ্ছে না। আমি সব চ্যাম্পিয়ন ফুটবলারদের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।” সন্ধ্যার দিকে ওবেলিসো সৃতিস্তম্ভে ততক্ষণে লাখ লাখ জনতার ঢল নেমে গিয়েছে। সেই সময় পুলিশের সঙ্গে জনতার ফের ঝামেলা বাঁধে। বাধ্য হয়ে হেলিকপ্টার করে মেসিরা ফিরে আসেন আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থার অফিসে।
স্বভাবতই আর্জেন্টাইনরা ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ২৫ বছরের দিয়েগো বেনাভিদেজ নামে এক আর্জেন্টাইন ভক্ত আক্ষেপের সুরে বলেন, “প্রশাসন আমাদের কাছ থেকে বিশ্বকাপ কেড়ে নিল। সরকারের উচিত ছিল পুরো ব্যাপারটা সঠিকভাবে সংগঠিত করা। যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ এই উৎসব ভালভাবে উদযাপন করতে পারে। সকাল থেকে দলটাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অথচ মেসিদের দেখতেই পেলাম না।” তবে এই সাফল্য বর্তমান দেশের প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজের সরকারকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়ে গেল। বছরের পর বছর অর্থনৈতিক মন্দায় ধুঁকছে দেশ। মুদ্রাস্ফীতির হার পৌঁছেছে সর্বোচ্চ স্তরে। মেসিদের এই সাফল্য তাই অনেকটা অক্সিজেন দিয়ে গেল আলবার্তো সরকারকে। এক আর্জেন্টাইনকে বলতে শোনা গিয়েছে, “আজ দেখুন পুরো দেশের জনতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। ফুটে উঠেছে ঐক্য, সুখের বাতাবরণ।” শুধু মেসি, আলভারেজদের নিয়ে আবেগে ভাসেনি আর্জেন্টাইনরা, সঙ্গে দেখা গিয়েছে দিয়েগো মারাদোনার ছবিও। কিছু মানুষ ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করার কারিগরকেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। অনেকের হাতে দেখা গিয়েছে মারাদোনার ছবি সহ প্ল্যাকার্ডে লেখা–‘এটি দিয়েগোর জন্য। যিনি স্বর্গ থেকে দেখছেন।’ এদিকে বাসে করে যাওয়ার সময় সমর্থকদের উদ্দেশে আর্জেন্টিনার ‘টাকা’ পেসো উড়িয়ে দেন ফুটবলার পাপু গোমেজ। স্বভাবতই পেসো পেয়ে আনন্দে আরও ফেটে পড়ে জনতা। তবে আনন্দের তাল কিছুটা হলেও কেটে দিল বিশৃঙ্খলতা।
এত কিছুর পর মেসি যখন বাড়ি ফিরতে যাবেন, সেখানেও বিপত্তি। রোজারিওতে বিশেষ বিমানে নামার পর সেখান থেকে মাত্র ৩০ কিলমিটার দূরে নিজের বাড়ি ফিরতেও মেসিকে নিতে হল হেলিকপ্টার। কারণ রাস্তায় এত মানুষ ছিলেন, যে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া সম্ভবই হত না। তাই ভক্তদের হতাশ করে ‘ঈশ্বর’ চললেন আকাশপথেই। কিন্তু তাতেও নিষ্কৃতি নেই। বাড়ি ফিরে মেসি দেখলেন, তাঁর বাড়ির দখল প্রায় চলে গিয়েছে সমর্থকদের হাতে। শ’য়ে শ’য়ে ফুটবলভক্ত বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। বহু কষ্টে মেসি নিজের বাড়িয়ে ঢুকে উদ্ধার হন।