মাত্র এক মাস আগেও মহিলাদের সিনিয়র টেনিসে একটা ম্যাচও খেলেননি। ব্যস্ত ছিলেন নিজের পড়াশুনা নিয়ে। বিশেষ করে অঙ্ক এবং অর্থনীতি তাঁর ভয়ের অন্যতম একটা কারণ। এক মাস পর তিনিই উইম্বলডনের চতুর্থ রাউন্ডে উঠে চমকে দিয়েছেন গোটা বিশ্বকে। বিশ্বের প্রাচীনতম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে তাদের নতুন প্রতিভাকে, যাঁর নাম এমা রাডুকানু। ওপেন-যুগে ব্রিটিশ মহিলা খেলোয়াড় হিসেবে সব থেকে কম বয়সে শেষ ষোলোয় উঠেছেন তিনি।
উইম্বলডন দ্বিতীয় সপ্তাহে পা দেওয়ার আগেই ছিটকে গিয়েছেন বাকি ব্রিটিশ খেলোয়াড়রা। তৃতীয় রাউন্ডে বিদায় নিয়েছেন দেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় অ্যান্ডি মারে। রজার ফেডেরারের কাছে হেরেছেন ক্যামেরন নরি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে টিকে রয়েছেন রাডুকানু, যাঁর নাম কিছুদিন আগে পর্যন্তও গোটা বিশ্ব তো দূর, ইংল্যান্ডেরও বেশি লোক জানতেন না।
কানাডার টরন্টোয় ২০০২ সালে জন্ম রাডুকানুর। বাবা রোমানিয়ার, মা চিনের। তাঁর বয়স যখন দুই, তখন লন্ডনে চলে আসে পরিবার। ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার, নাচ, বাস্কেটবল, স্কি, গলফ, মোটোক্রস — এমন কোনও খেলা নেই যা তিনি ছোটবেলায় খেলেননি। কিন্তু শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলেন টেনিসই তাঁর সব থেকে পছন্দের। তবে রয়েছে পিতৃভূমির প্রতি টানও। তাই তো সময় পেলেই রোমানিয়ার বুখারেস্ট শহরে থাকা ঠাকুমার কাছে এখনও আদর খেতে চলে যান।
রোমানিয়ার খাবারও তাঁর খুব পছন্দের। টেনিসে তাঁর আদর্শ খেলোয়াড়ের প্রসঙ্গ এলে শুধু রোমানিয়া নয়, মায়ের দেশ চিনকেও উপরের দিকে রাখেন এই তরুণী। চিনের লি না যেমন তাঁর খুব কাছের, তেমনই আবার রোমানিয়ার সিমোনা হালেপকেও অনুসরণ করেন রাডুকানু।
পাঁচ বছর থেকেই টেনিসে হাতেখড়ি। লন্ডনের ব্রমলি টেনিস অ্যাকাডেমিতে শেখা শুরু করেন। বাবা-মা তাঁকে ভর্তি করে দেন ব্রমলির নিউস্টেড উড স্কুলে। পড়াশুনার পাশাপাশি পুরোদমে চলতে থাকে টেনিসও। উইম্বলডনে নামার মাসদুয়েক আগেই ‘এ’ পর্যায়ের পরীক্ষা দিয়ে এসেছেন। এখনও তার ফলাফল বেরোয়নি।
টেনিসের পাশাপাশি প্রথম থেকেই পড়াশোনাতেও খুব ভাল রাডুকানু। অঙ্ক ও অর্থনীতিকে ভয় পেলেও বরাবর ভাল ফল করেছেন তিনি। আর সেটাই তাঁকে প্রথম থেকে টেনিসেও সাহায্য করেছে বলে মনে করেন রাডুকানু। তিনি বলেন, ‘‘আমি স্কুলে ভাল ফল করতে চেয়েছি সব সময়। বাবা মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করেছি। টেনিস অনুশীলনের পর পড়াশুনা নিয়েই থাকতাম আমি। সব সময়ই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসি। পড়াশোনায় ভাল হওয়ায় আমার টেনিসের রণকৌশলগত দিক থেকে আমার অনেক সুবিধে হয়েছে।’’ এই তরুণী এই দুটো বিষয়ে এতটাই পারদর্শী যে স্কুলের দিদিমণিরা পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে সাহায্য চাইতেন।
টেনিস কোর্টে নাম অচেনা হলে কী হবে, বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় রাডুকানুর সাফল্য রীতিমতো ঈর্ষণীয়। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় তিন বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। গত বছর বিলি জিন কিং কাপের ব্রিটেন মহিলা দলের সদস্য হয়ে স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে যান। ‘ব্যাটল অফ ব্রিটস’ টেনিস প্রতিযোগিতার দলেও ছিলেন রাডুকানু।
মাস খানেক আগে নটিংহ্যাম ওপেনে ওয়াইল্ড কার্ড হিসেবে খেলার সুযোগ পান। প্রথম রাউন্ডে হ্যারিয়েট ডার্টের কাছে হেরে গেলেও কিছুদিন পরে একই জায়গায় অন্য একটি প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিলেন। সেই দেখেই তাঁকে ওয়াইল্ড কার্ড হিসেবে উইম্বলডনে খেলার সুযোগ দেন আয়োজকরা।
এই অষ্টাদশী ভারতেও খেলে গিয়েছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতে পা রেখেছিলেন এই ব্রিটিশ তরুণী। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬। সে বার পুণেতে আইটিএফ উইমেন্স ওয়ার্ল্ড টেনিস ট্যুরে অংশ নিতে এসেছিলেন। চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন। সে বার তাঁর ভারত ভ্রমণের সেই বৃত্তান্ত টুইটার ঘাঁটলেই দেখা যায়।
উইম্বলডনে প্রথম পর্বে ভিটালিয়া ডায়াচেঙ্কো (৭-৬, ৬-০), পরের ম্যাচে ২০১৯-এর ফরাসি ওপেন রানার্স-আপ মারকেটা ভন্দ্রৌসোভা (৬-২, ৬-৪) এবং তৃতীয় ম্যাচে বিশ্বের ৪৫ নম্বর সোরানা সিরস্টিকে (৬-৩, ৭-৫) হারিয়ে চতুর্থ পর্বে রাডুকানু। শেষ ষোলোয় তিনি মুখোমুখি হবেন আজলা টমালানোভিচের। একটিও সেট না হারানো রাডুকানু উইম্বলডনের পর ৩৩৮ নম্বর থেকে অবশ্যই ২০০-র মধ্যে উঠে আসবেন।
এ বার উইম্বলডন শুরু হওয়ার আগে গারবাইন মুগুরুজা ও ভন্দ্রৌসোভার সঙ্গে অনুশীলন করেছেন রাডুকানু। ভন্দ্রৌসোভাকে হারিয়ে দিয়েছেন। আর মুগুরুজার সঙ্গে অনুশীলন করে অনেক কিছুই শিখতে পেরেছেন বলে দাবি তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘আমি ভাগ্যবান যে ওর সঙ্গে অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছি। এটা না পেলে আমি বুঝতে পারতাম না সর্বোচ্চ মানের টেনিস কীরকম হয়। আমি বুঝতে পেরেছি কী ভাবে আমার অনুশীলন করা প্রয়োজন।’’
ওপেন যুগে কনিষ্ঠতম ব্রিটিশ মহিলা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে উইম্বলডনের চতুর্থ পর্বে পৌঁছে গেলেন রাডুকানু।
ওপেন যুগে কনিষ্ঠতম ব্রিটিশ মহিলা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে উইম্বলডনের চতুর্থ পর্বে পৌঁছে গেলেন রাডুকানু।
ছবি: রয়টার্স
ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে সুযোগ আসে উইম্বলডন খেলার। আসার আগে মনে হয়েছিল প্রথম কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেলতে আসছেন। তাও আবার থাকতে হবে জৈব সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে। উত্তেজনায় বোধ হয় একটু বেশিই জামাকাপড় নিয়ে ফেলেছিলেন। রাডুকানু বলেন, “আসার আগে জামাকাপড় নেওয়ার সময় মা-বাবা বলে, ‘অনেক বেশি জামাকাপড় নিচ্ছ মনে হচ্ছে না?’’
রাডুকানু যে বছর জন্মেছিলেন, সেই ২০০২ সালে এলিনা বাল্টাচা নামক এক ব্রিটিশ তরুণী মাত্র ১৮ বছর বয়সে উইম্বলডনের তৃতীয় পর্বে পৌঁছে রেকর্ড গড়েছিলেন। ১৮ বছরের রাডুকানু সেই রেকর্ড আগেই ভেঙে দিয়েছিলেন। এ বার ওপেন যুগে কনিষ্ঠতম ব্রিটিশ মহিলা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে উইম্বলডনের চতুর্থ পর্বে পৌঁছে গেলেন তিনি। ভাঙলেন ৪২ বছরের পুরনো রেকর্ড।
তবে এই সাফল্য পাওয়ার জন্য একটা সময় অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। আর্থিক কষ্ট ছাড়াও ছিল চোট-আঘাতে জর্জরিত হওয়া। গত বছরের বেশিটাই চোটেই কাটিয়ে দিয়েছেন। একে তো করোনার উপদ্রব। তার মধ্যে আবার চোট। মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তবে প্রিয় র্যাকেটকে ছেড়ে থাকতে পারেননি। সেই কঠিন সময় রাডুকানুকে ভরসা জুগিয়ে গিয়েছেন তাঁর প্রশিক্ষক। সেই ১৫ বছর বয়স থেকে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন নাইজেল সিরাস। যিনি একটা সময় আমান্দা কোয়েৎজার, ড্যানিয়েলা হাঞ্চুকোভা, অ্যানা ইভানোভিচের মতো খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
টেনিস র্যাকেট খেলা যেমন নজর কেড়েছে, তেমনই নজরে এসেছে ব্যক্তি রাডুকানুও। প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় জেমস ব্লেক টুইট করে লেখেন, ‘এমা রাডুকানুর খেলা দেখলাম। মাত্র ১৮ বছর বয়সে দারুণ খেলছে ও। তবে সব চেয়ে ভাল লাগল ম্যাচের শেষ নিজের যাবতীয় জঞ্জাল নিজেই পরিষ্কার করে দিল ও। খুব ভাল। এই স্বভাব বদলে ফেল না।’
স্বভাব যে বদলাবেন না, সেটা রাডুকানুর কথাতেই স্পষ্ট। উইম্বলডনে রাজকীয় অভিষেক ঘটিয়েও তাই বলেন, “বাবা-মা’র লড়াইয়ের জন্য এই জায়গায় আসতে পেরেছি। আমি জানি ওরা খুব খুশি হয়েছে। তবে আমি শুধু একজন ভাল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে জীবন শেষ করতে চাই না। আমার লক্ষ্য আরও ভাল মনের মানুষ হওয়া। আমার মা সেই শিক্ষা ছোটবেলা থেকে দিয়ে এসেছে। সততা ও নিয়মানুবর্তিতাকে সম্বল করে এগিয়ে যেতে চাই।”
ব্রিটেনের মহিলা টেনিসে একের পর এক টেনিস খেলোয়াড় উঠেও হারিয়ে গিয়েছেন। এখন দেখার রাডুকানুর হাত ধরে ফের কোনও নতুন প্রতিভার উদয় হয় কি না।