হ্যাঁমধুই বটে! ময়দানের টান যে কী অমোঘ টান তা বাঙালি জাতিকে নতুন করে বলে দিতে হয় না। মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গল, ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড থেকে বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদ, লিভারপুল, বাঙালির উত্তেজনার রেশ মেলে প্রতিটি জায়গায়। এটাই পরিচয় আমাদের। এক কালে ময়দানের বাতাসের গন্ধেই বাঙালির প্রাণ জুড়াতো।
বাঙালির কাছে ফুটবল মানে শুধু খেলা নয়। একটা আবেগ, একটা উন্মাদনা। তাই ডার্বি ম্যাচগুলোর সময় ব্যস্ত তিলোত্তমার চেহারাটাই যেন বদলে যায়। কর্মব্যস্ত নগর জীবন ভিড় করে পাড়ার ক্লাবে, টিভির সামনে। তারপর একসঙ্গে চিৎকার ‘গোললল’। প্রিয় দলের ডার্বি জয় যেমন কয়েকদিন পাড়ার চায়ের দোকানে বুক ফুলিয়ে আড্ডা দেবার রসদ তেমনই পছন্দের দল হেরে গেলে মুখ দেখানো মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফুটবল ঘিরে এহেন আবেগ, উন্মাদনা এই বঙ্গভূমি ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে!
বাঙালির ফুটবল উন্মাদনার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এর সূচনা হয়েছিল ১৩৬ বছর আগে। পরাধীন ভারতে। শুরুটা করেছিলেন নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী নামের এক বাঙালি ছাত্র, ১৮৭৮ সালে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে এসেছেন একাধিক শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। তাঁদেরই মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্যার দুখীরাম মজুমদার। বাংলার ময়দানের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনিই। নিজেকে তো বটেই, সারাজীবন মন প্রাণ ঢেলে গড়েপিটে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন তাবড় তাবড় খেলোয়াড়দের। বড়ো ফুটবলার না হয়েও যে বড়ো কোচ হওয়া যায়, সেকথাই প্রমাণ করেছিলেন দুখীরামবাবু। নিজের গোলের সংখ্যা বেশি বাড়াননি ঠিকই তবে গোল দেওয়ার মতো অসংখ্য পা তৈরি করেছেন তিনি।
ফুটবলের ময়দানে বড়ো মাপের কোচ ছিলেন দুখীরাম। তাঁর কোচিং-এ ভারতীয় ফুটবলে জায়গা পাকা করেছে অসংখ্য মনিমুক্ত – ইস্টবেঙ্গলের সূর্য চক্রবর্তী, মোহনবাগানের করুণা ভট্টাচার্য ছাড়াও সামাদ, বলাই চ্যাটার্জি, কার্তিক বসু, রিচে মিত্তিরের মতো অসংখ্য ফুটবলার। কমল ভট্টাচার্যের ক্রিকেটার হওয়ার পিছনেও ওনার বিরাট অবদান। এই কারণেই পেয়েছিলেন ‘স্যার’ উপাধি। ওঁর নামে এরিয়ান ক্লাবে কোচিং সেন্টারও রয়েছে – ‘স্যার দুখীরাম কোচিং সেন্টার’। উনি নিজেও এরিয়ান ক্লাব প্রতিষ্ঠাতাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে একদিন ফুটবলই ছিল ভারতীয়দের অন্যতম হাতিয়ার। ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার এর থেকে সহজ উপায় সেকালে আর ছিল না। ময়দানে ইংরেজদের পায়ে লাথি মারার শাস্তি স্বরূপ জেল খাটতে হতো না বাঙালিদের। তাই বুট পায়ে ময়দানে ইংরেজদেরকে ছেড়ে কথা বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না, খালি পায়ে হলেও জর কদমে লেগে থাকাটাই ছিল দস্তুর। দুখীরামও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
এহেন দুখীরাম মজুমদার একদিন জানতে পারেন, তাঁর ভাইপো ছোনে মজুমদার নাকি ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে পা বাঁচিয়ে খেলেছেন পায়ে জুতো ছিল না বলে। ব্যাস! ভাইপোকে শাস্তি দিতে স্কিপিংয়ের দড়ি দিয়ে পোস্টের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধলেন। ছোনে মজুমদার তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। বোঝার কথাও না। ঘটলো সম্পূর্ণ পৃথক একটি ঘটনা।
এহেন দুখীরাম মজুমদার একদিন জানতে পারেন, তাঁর ভাইপো ছোনে মজুমদার নাকি ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে পা বাঁচিয়ে খেলেছেন পায়ে জুতো ছিল না বলে। ব্যাস! ভাইপোকে শাস্তি দিতে স্কিপিংয়ের দড়ি দিয়ে পোস্টের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধলেন। ছোনে মজুমদার তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। বোঝার কথাও না। ঘটলো সম্পূর্ণ পৃথক একটি ঘটনা। স্যার দুখীরাম কেটস-এর বদলে ধুতি গুটিয়ে পায়ে স্পাইক বুট পরলেন, আর তারপর যে ভাবে বাঁশি বাজিয়ে খেলা শুরু হয়, সেই ভাবে বাঁশি বাজিয়ে স্পাইক বুট দিয়ে ভাইপোর পায়ে টানা লাথাতে থাকলেন। টানা ৪৫ মিনিট লাথি মেরে হাফ টাইমের বাঁশি বাজালেন। এমনকি এখানেই শেষ নয়, কড়া হুমকি দিলেন ‘ভবিষ্যতে পা বাঁচিয়ে খেললে ফুল টাইম লাথি খেতে হবে ছোনেকে’।
আরও শোনা যায়, ছোনে মজুমদার অসাধারণ ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু এক পায়ের। বাঁ পা-টা ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু কাকা দুখীরাম মজুমদারের এটা মোটেও পছন্দ ছিল না। তাই ইট মেরে ভাইপোর বাঁ-পায়ে গুরুতর আঘাত করেছিলেন। তারপর টানতে টানতে ভাইপোকে মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবল খেলতে। এইভাবে ভাইপোর সচল বাঁ-পা কে অচল করে দিয়ে, অচল ডান পা কে সচল করে তুলেছিলেন দুখীরাম।
আরও পড়ুন: ফুটবলের সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলের গোলরক্ষক হলেন শিলিগুড়ির রাজা
পরবর্তীকালে উত্তরসূরি হিসাবে ‘স্যার দুখীরাম কোচিং সেন্টার’-এর দেখভাল করতেন ছোনে মজুমদারই। প্যান্ট, শার্টের সঙ্গে কাঁধে শাল রাখতেন তিনি। একসময় এই সেন্টার ছিল বাংলার ফুটবলের ভিত তৈরির আস্তানা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যস্ত হয়েছে সেই ঐতিহ্য। আগের মতো রমরমা নেই স্যার দুখীরাম কোচিং সেন্টারের। কিন্তু সেই কোচিং সেন্টারের নেপথ্যে রয়ে গেছে অসংখ্য গল্পগাথা।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঙালি এখন দেশিয় ফুটবলের মায়া কাটিয়ে বিদেশি ফুটবলের উত্তেজনায় সামিল হয়। তাতে অবশ্য দোষের কিছুই নেই। খেলার আবেগটুকু টিকে থাকলেও তো কম কিছু নয়! তবে বছর শুরুর ডার্বি ম্যাচের উত্তেজনার মতো যদি বাংলার ফুটবলের ইতিহাস নিয়ে বাঙালির খানিক উৎসাহ থাকে, তবে হয়তো কালের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া দুখীরাম মজুমদারদের নাম আবারও চর্চায় ফিরে আসতে পারবে!