ঝুলনদির সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অনেক কথাই মনে আসছে। ‘শাবাশ মিঠু’ সিনেমায় আমি ওঁর চরিত্রে অভিনয় করেছি। ওঁর বোলিং, চালচলন, ক্রিকেটীয় দক্ষতা সবই আমাকে অনুকরণ করতে হয়েছে। কোনওটাই সহজ ছিল না। যাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছি, তিনিই যখন খেলা থেকে অবসর নেন, তখন মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।r
সবার আগে ওঁর অসাধারণ ক্রিকেটজীবনের কথা উল্লেখ করব। যে ভাবে ক্রিকেট খেলেছেন, তাতে আরও অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিল ওঁর। ক্রিকেট সমর্থক বা ক্রীড়াবিদ হিসেবে ওঁর জীবন যতটা না বুঝতে পেরেছি, তার থেকেও বেশি ঝুলনদিকে চিনতে পেরেছি ওঁকে চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে। পুরোপুরি ওঁকে অনুকরণ করতে পেরেছি, সেটা বলব না। যতটা পেরেছি চেষ্টা করেছি। ওঁর বল করা, ওঁর কঠোর পরিশ্রম, সব কিছুই সিনেমায় দেখানোর চেষ্টা করেছি। যে পরিশ্রম উনি এত দিন ধরে করেছেন, সেটা এই অল্প কয়েক দিনে করতে গিয়ে টের পেয়েছি, কতটা কঠিন ছিল।
‘শাবাশ মিঠু’ সিনেমায় ওঁর চরিত্রে শুটিংয়ের কথা মনে পড়লে এখনও উত্তেজনা হয়। শুটিং শেষে আমি প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলাম। সাধারণ এক জন হিসেবে ক্রিকেট শেখা এবং কারওর মতো করে ক্রিকেট খেলা বা কাউকে অনুকরণ করা, দুটোর মধ্যে অনেক তফাৎ। ওঁর আচরণ, বল করার স্টাইল, শরীরী ভাষা অনুকরণ করা খুবই কঠিন ছিল। ঝুলনদির বল করার একটা দুর্দান্ত স্টাইল রয়েছে। শুটিংয়ের আগে অনেক দিন ধরে ওঁর সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিলাম। ঝুলনদিকে দেখে মনে হয়েছিল একটা বুলডোজার। যে ভাবে বল করতে দৌড়ন, যে ভাবে বল করার আগে লাফান, আমার তো মনে হয় ব্যাটারের ওখানেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া উচিত।
বল হাত থেকে ছাড়ার আগের মুহূর্তে ওঁর যে লাফ, সেটার পিছনে কতটা শক্তি থাকে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তাই জন্যেই এত জোরে বল করতে পারেন। সেটা অনুকরণ করতে গিয়ে আমায় প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে। তার কারণ হল, উনি বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রম করে নিজেকে ওই ভাবে তৈরি করেছেন। ওঁর শরীরের গঠনও আলাদা। আমি নিজে ক্রিকেটার হলে একটা নির্দিষ্ট ধারা মেনে এগিয়ে যেতাম। আমার শরীর যে রকম, সে ভাবেই অনুশীলন করতাম। ওঁর মতো করে সব করতে গিয়ে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়েছে। উনি অনেক লম্বা। খুব জোরে দৌড়তে পারেন। বল করার পর যে ফলো থ্রু, সেটার মধ্যেও বিশেষত্ব রয়েছে। সেটা করতে গিয়ে আমার তো পায়ে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। চিকিৎসা, ফিজিয়োথেরাপি, কিছুই বাকি ছিল না যেটা আমি করিনি। ঝুলনের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে আমাকে অভিনেতা নয়, ক্রিকেটার হতে হয়েছে।
এত বাধা সত্ত্বেও চরিত্রটা উতরে দেওয়ার পিছনে প্রধান কারণ হল, আমার আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতা। অনেক দিন ধরে অভিনয় করছি। ক্যামেরার সামনে আমি সাবলীল। তাই ক্যামেরা চালু হলে কী ভাবে সব এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেটা আমার মাথার ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। পাশাপাশি নিজেকেও ক্রিকেটার হিসেবে তৈরি করে নিয়েছিলাম। এই দুটোর মেলবন্ধনেই ‘শাবাশ মিঠু’ সিনেমায় ঝুলনের বা বলা ভাল ঝর্ণা গোস্বামীর চরিত্রে অভিনয় করতে পেরেছি।
শুটিং করার সময় অনেকেই আমাদের কোচিং করিয়েছেন। তবে এখানে দু’জনের কথা আলাদা করে বলতে চাই। একজন হলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ক্রিকেটটা উনি ভালই জানেন এবং প্রচুর খেলা দেখেন। কী ভাবে স্টান্স নিতে হবে বা বোলিং করতে হবে, সবই উনি হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছেন। আর এক জন হলেন সুশীলদা। ইন্ডাস্ট্রিতে ওঁকে প্রায় সবাই চেনেন। উনি নিজে ক্রিকেট কোচ এবং ঝুলনদিকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ঝুলনের বোলিং অ্যাকশন নিখুঁত করতে অনেক সাহায্য করেছেন উনি। মুম্বই গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগে বিবেকানন্দ পার্কে সুশীলদার অধীনে রোজ ভোরবেলা অনুশীলন করেছি। যে কোনও সমস্যায় উনি সাহায্য করেছেন। ব্যক্তিগত ভাবে ঝুলনদিকে অনেক আগে থেকেই চিনি। সিনেমা করার আগে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কথাও হয়েছে। ফলে সিনেমা করার আগে আলাদা করে পরিচয় করার দরকার পড়েনি।
‘শাবাশ মিঠু’ মুক্তি পাওয়ার পরে একটা বিষয় শুনতে পেয়েছি। মিতালি রাজ প্রথম বার জাতীয় দলে ঢোকার সময় ঝুলন ওঁর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিলেন, সেটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। ঝুলনদি সত্যিই ও রকম করেছিলেন কি না, আমি জানি না। তবে সিনেমা তৈরি করতে গেলে অনেক সময় নাটকীয়তার আশ্রয় নিতে হয়। প্রধান চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে কিছু অতিরঞ্জন করতে হয়। এটাও হয়তো সেই প্রচেষ্টারই একটা ফল। তবে সিনেমায় যা-ই দেখানো হোক না কেন, ঝুলন এটা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে ওকে কঠোর পরিশ্রম করে দলে আসতে হয়েছে। যোগ্য বলেই দলে ঢুকেছে। তাই মিতালির পক্ষেও কাজটা সহজ হবে না। সিনেমার ঝর্ণাই কিন্তু পরে মিতালির সবচেয়ে ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিল। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, বাস্তবেও দু’জনে একে অপরের অত্যন্ত কাছের এবং খুবই ভাল বন্ধু।
আজ ঝুলনদির অবসরের দিনে এক জন সাধারণ নারী হিসেবে ওকে কুর্নিশ করছি। ক্রিকেটার হিসেবে ওঁর যাত্রা শনিবার শেষ হচ্ছে। এ রকম এক জন ক্রিকেটারকে আমরা আর মাঠে দেখতে পাব না, এটা ভেবেই মন খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাও জানি, একটা সময় গিয়ে সবাইকেই থামতে হয়। অবসরের ব্যাপারটা ঘুরে ফিরে চলেই আসে। সবার কাছেই উনি অনুপ্রেরণা। আগামী দিনে আরও মেয়ে ওঁকে দেখে এগিয়ে আসবে।
মহিলাদের ক্রিকেটের জন্য উনি যা করেছেন, তার জন্য হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ। মেয়েদের ক্রিকেট আলাদা পরিচিতি পেয়েছে ওঁর জন্যেই। একটা ছোট গ্রাম থেকে কোথায় গিয়েছেন উনি! সবার কাছে ঝুলনদি একটা উদাহরণ। আশা করব, এই অবসর শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই হোক। ক্রিকেটের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ যেন কখনও বিচ্ছিন্ন না হয়।