বিদায়বেলায় সতীর্থদের আবেগটাই সেরা প্রাপ্তি: ঝুলন গোস্বামী

অবসরের উৎসব থেকে যেন তাঁকে ছাড়তেই চাইছিলেন না সতীর্থরা। লর্ডসে মাঠে, ড্রেসিংরুমে ভালবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার পরে বাসের মধ্যেও চলল গান, বাজনা, তাঁর নামে জয়ধ্বনি। তার পর হোটেলে ফিরে টিম ডিনার উৎসর্গ করা হল তাঁর নামে। শেষ পর্যন্ত টিম ডিনারের মধ্যে থেকেই শনিবার ভারতীয় সময় রাত সাড়ে তিনটের সময় ‘কল ব্যাক’ করলেন ঝুলন গোস্বামী। অবসরের পরে তাঁর প্রথম একান্ত সাক্ষাৎকার। চাকদহ থেকে লর্ডস অবিশ্বাস্য এই যাত্রার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি।

প্রশ্ন: অধিনায়ক হরমনপ্রীত আপনাকে টস করতে নিয়ে গেলেন। আগে বলেছিলেন?

ঝুলন গোস্বামী: আরে, না। একদম কিছুই বলেনি। ওরা সকলে মিলে ঠিক করেছিল, আমাকে সারপ্রাইজ় দেবে। কিছু বুঝতেই দেয়নি।

প্র: তা হলে কখন হরমনপ্রীত বললেন যে, টস করতে নিয়ে যাবেন?

ঝুলন: ড্রেসিংরুমেই বলল। টস করতে যাওয়ার আগে। আমি তো শুনেই ভাগিয়ে দিচ্ছিলাম ওকে। বললাম, একদম যাব না। তুই ক্যাপ্টেন, তুই-ই যাবি একা। কিন্তু কে কথা শোনাবে! আর পুরো ড্রেসিংরুম তখন ক্যাপ্টেনের দিকে। আমি একা হয়ে গেলাম। যেতেই হল।

প্র: লর্ডসে শেষ ম্যাচ খেলতে নামছেন। ক্যাপ্টেনের অমন আবেগপূর্ণ আবদার। টসের সময় মাঠে যেতে যেতে কী মনে হচ্ছিল?

ঝুলন: মিথ্যা বলব না, গলা ধরে আসছিল। হরমন এমন ভাবে বায়না ধরছিল যে, খুব আপন মনে হচ্ছিল। এমনিতেই আমার কাছে ইন্ডিয়া ক্যাপ জীবনের সব কিছু। ভারতীয় ড্রেসিংরুম মানে আমার কাছে মন্দির। তপস্যার জায়গা। শেষ দিনে ড্রেসিরুম যে ভাবে ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় ভরিয়ে দিল, চোখের জল ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছিল।

প্র: কী মনে হচ্ছিল সতীর্থদের ভালবাসা পেয়ে?

ঝুলন: আমার কাছে শেষ দিনে সতীর্থদের এই আবেগটাই সেরা প্রাপ্তি হয়ে থাকবে। সবাইকেই একদিন সরে যেতে হয় কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্ত সঙ্গে থেকে যায় চিরকাল। লর্ডসে শেষ দিনে পাওয়া সতীর্থদের ভালবাসাটা সঙ্গে থেকে যাবে আজীবন।

প্র: চাকদহ থেকে লর্ডস— আপনার এই যাত্রা কত মানুষের কাছে প্রেরণা। ফিরে তাকিয়ে কী মনে হচ্ছে?

ঝুলন: তৃপ্তি পাচ্ছি এটা ভেবে যে, আমি এই যাত্রাটা সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। বাধাবিঘ্ন এসেছে কিন্তু আমি সে সবের সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে যেতে পেরেছি। কোনও ঝড়-ঝঞ্ঝাই আমাকে থামাতে পারেনি। যদি পরবর্তী প্রজন্মের দু’টো মেয়েও এই লড়াই থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে, নিজের লড়াইকে সার্থক মনে করব।

প্র: ভিডে ঠাসা লোকাল ট্রেনে করে আসার সময় নানা রকম কটাক্ষের মুখে পড়তে হত। সে সব কথা মনে পড়লে কী মনে হয়?

ঝুলন: আমিও তো মানুষ। খারাপ লাগত। আঘাত লাগত। কিন্তু নিজেকে বলতাম, অন্যরা কী বলছে তা তো তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সহ্য করো, মুখ বুজে লড়াই চালিয়ে যাও। নিজের কাজ করে যাও। অবিচল থেকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাও, দেখবে এই লোকগুলোই উঠে দাঁড়িয়ে একদিন হাততালি দিচ্ছে।

প্র: কুড়ি বছরের উপরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যাত্রায় সেরা মুহূর্ত কোনটা?

ঝুলন: ২০১৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল অবশ্যই একটা বড় দিন। ফাইনালে পারলাম না, হেরে গেলাম। বিশ্বকাপ না জেতা একটা অপূর্ণতা। তবু বলব, ওই ফাইনাল খেলাটা ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটকে এগিয়ে দিয়েছে। কত মানুষ সেই ফাইনাল দেখেছিলেন। আমি নিশ্চিত, আমরা যেটা পারলাম না হরমনরা সেটা করে দেখাবে। সে দিন বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে দেখতে দেখতে একইরকম আনন্দ পাব হরমনদের হাতে কাপ দেখে। আর যদি সেরা মূহূর্ত বাছতে বলেন, লর্ডসে বিদায়ী দিনটাকে বাছব। কখনও ভাবিনি, লর্ডসে ক্রিকেটজীবন শেষ করব। তা-ও আবার এত ভালবাসা, এত শ্রদ্ধার মধ্যে। এই দিনটাই এক নম্বরে থাকবে।

প্র: দলের সকলের সই করা টুপি উপহার দিলেন অধিনায়ক?

ঝুলন: হ্যাঁ, দলের সকলের সই করা টুপি। ওটা দেওয়ার সময় কেমন কাণ্ড হল দেখলেন তো? হরমন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

প্র: আপনি টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন হরমনকে। কী স্নেহ ভরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, সত্যি মনে রাখার মতো দৃশ্য!

ঝুলন: আরে, হরমনকে সামলাতেই পারছিলাম না। অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছিল। আমি আদর-টাদর করে বলতে থাকলাম, ওরে পাগলি কোথাও তো যাচ্ছি না আমি। তোদের সকলের মধ্যেই তো আছি। যখনই ডাকবি, আমাকে পাবি। কিন্তু কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিল না ওকে। তার পর আমি বললাম, শোন, ম্যাচটাও তো খেলতে হবে নাকি? এ বার চুপ কর। নিজেকে শান্ত কর।

প্র: হরমনপ্রীত এই ম্যাচের আগে প্রেস কনফারেন্সেও খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন..

ঝুলন: আসলে, হরমন যখন প্রথম এসেছিল, আমি ওকে খুব গাইড করতাম। তখন সবে এসেছে। কখনও ভাল খেলত, কখনও খারাপ। যখন খারাপ দিন যেত, মনমরা হয়ে বসে থাকত। আমি চেষ্টা করতাম ওকে সাহস দেওয়ার। পঞ্জাবের মেয়ে বলে পঞ্জাবি খাবারের রেস্তরাঁতে নিয়ে যেতাম। বাইরে ঘোরাঘুরি করতে নিয়ে যেতাম যাতে মন খারাপ কাটিয়ে উঠতে পারে। শুরুর দিকে ও খুব সময় কাটাত আমার সঙ্গে। সে সব কথা ভোলেনি। আজ ও ক্যাপ্টেন। আমি বিদায় নিচ্ছি। পুরনো সে সব কথা মনে করেই হয়তো ও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। স্মৃতিও (মন্ধানা) খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। ওরা সকলেই।

প্র: আর আপনি? স্বয়ং ঝুলন গোস্বামী? তিনি কী ভাবে নিজেকে সামলাচ্ছিলেন?

ঝুলন: কঠিন ছিল, খুবই কঠিন ছিল শেষ দিনটা। হোটেলে নিজের ঘর থেকে যখন বেরচ্ছিলাম, মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, যে ইন্ডিয়া ক্যাপ আমার কাছে সব কিছু, আমার জীবন, শেষ বারের মতো আজ তা পরব। যে ইন্ডিয়া জার্সি আমার প্রাণ, তা শেষ বারের মতো গায়ে তুলব। যে ভারতীয় ড্রেসিংরুম আমার কাছে এতকাল মন্দির ছিল, সেখানে আজকের পর আর ঢুকব না। ওই সময়টায়, বুঝলেন তো…ওই সময়টায় আবেগকে বশ মানাতে পারছিলাম মা।

প্র: তার পর কী ভাবে সামলে উঠলেন?

ঝুলন: মনকে বোঝালাম, সকলকেই তো একদিন থামতে হয়। নিজেকে বললাম, এই যে চাকদহ থেকে শুরু করে আজ তুমি লর্ডসে শেষ করতে যাচ্ছ, এই সৌভাগ্যই বা ক’জনের জীবনে জোটে? ঈশ্বর করুণাময়, অনেক কিছু তুমি পেয়েছ। নিজের প্রাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো। তখনই ঠিক করি, ভিতরে যতই কষ্ট হোক, ভাঙব না। যতই কান্না পাক, কাঁদব না। খুশি মনে খেলতে এসেছিলাম। খুশি মনে বিদায় নেব।

প্র: লর্ডসের শেষ ম্যাচ থেকে বিশেষ কিছু স্মারক সঙ্গে রাখলেন?

ঝুলন: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। দলের পক্ষ থেকে সই করা জার্সি, টুপি দিয়েছে। ম্যাচের বলটা রাখলাম। এখন তো স্টাম্প নেওয়া যায় না, তাই ওটা আর পাইনি।

প্র: একই সময়ে দু’টো অবসর। রজার ফেডেরার আর আপনার। দু’টোই লন্ডনে। ওদিকে নাদাল কাঁদছেন, কাঁদছে সবাই। এ দিকে হরমনপ্রীত কাঁদছেন, কাঁদছে সবাই। কী বলবেন?

ঝুলন: রজার ফেডেরার কিংবদন্তি। আমাদের সকলেরই প্রিয়। সত্যিই সকলের কাছে খুব দুঃখের দিন যে, আর ফেডেরারকে র‌্যাকেট হাতে দেখা যাবে না। নাদালের কান্নাটা খেলার জগতের অসাধারণ এক ছবি হয়ে থাকবে। একটা উদাহরণ। মাঠের মধ্যে যতই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকুক, চলার পথে তোমার প্রতিপক্ষের জন্যও অনুভূতি গড়ে উঠুক। অসাধারণ, অসাধারণ! মাঠে আমি যখন ব্যাট হাতে নামছিলাম, ইংল্যান্ড টিম গার্ড অব অনার দিল। আমার কাছে ভীষণ স্মরণীয় একটা মুহূর্ত। এই স্পোর্টিং স্পিরিট দেখানোর জন্যই তো খেলা এত সুন্দর।

প্র: ভবিষ্যতের ভাবনা কী? আইপিএল খেলবেন?

ঝুলন: আগে তো আইপিএলের সব কিছু ঘোষণা হোক। তার পর দেখব। এখনই ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবিনি। কয়েকটা দিন যাক। বাড়ি ফিরি। তার পর ভেবে দেখা যাবে।

প্র: ভক্তদের উদ্দেশে কী বলতে চাইবেন?

ঝুলন: বলতে চাই, আমি আপনাদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। যে ভালবাসা, স্নেহ, সমর্থন সকলের কাছ থেকে পেয়েছি, তার কোনও প্রতিদান হয় না। যাই বলি না কেন, কম পড়বে। বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছে। বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সচিব জয় শাহের কাছে কৃতজ্ঞ। সিএবি সব সময় পাশে থেকেছে, সকলকে ধন্যবাদ। মুখ্যমন্ত্রী মমতাদি টুইট করেছেন, আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। পরিবারের সমর্থন, ভালবাসা নিয়ে আর কী বলতে পারি? শুধু বলব, তোমাদের ভালবাসা, সমর্থন ছাড়া এই যাত্রা সম্পূর্ণ করা সম্ভবই হত না।

প্র: আর প্রিয় সতীর্থদের, টিমকে কী বললেন?

ঝুলন: বললাম, ক্রিকেট মাঠে আর দেখা হবে না। কিন্তু আমি তোমাদের ছেড়ে কখনও যেতে পারব না। যখনই মনে হবে, আমি মাত্র একটা ফোন কল দূরে। শুধু খেলার বিষয়ে নয়, যে কারও যে কোনও ব্যাপারে মনে হলে ফোন করতে পারো। আমি তোমাদের জন্য ছিলাম, আছি, থাকব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.