‘‘এমবাপে (Kylian Mbappe) ঠিক পারবে। মেসি (Lionel Messi) যতই ম্যাজিক দেখাক, আমরাই চ্যাম্পিয়ন।’’ ফাইনালের ২৪ ঘণ্টা আগে কথাগুলো বলছেন চন্দননগর (Chandannagar) গোন্দলপাড়ার বাসিন্দা নেলিন কোলাসান। ৩৪ বছর আগে বিয়ের পর নেলিন মন্ডল হয়েছেন। সংসার করতে করতে শিখে নিয়েছেন বাংলা ভাষাটাও। আপাদমস্তক ফরাসী নেলিন মনেপ্রাণে বাঙালি বধূ হলেও ফ্রান্সের (France) জন্য এখনও তাঁর মন কাঁদে। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ফরাসীদের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। আজ ফাইনাল। তার আগে সেজে উঠেছে তাঁর বাড়ি। রাস্তায় উড়ছে ফ্রান্সের পতাকা। জ্বলছে নীল-সাদা-লাল আলো।
স্বামী উজ্জ্বল মন্ডল বলেন, ‘‘এখানে তো একসময়ে ফরাসী উপনিবেশ ছিল। তাঁর ছোঁয়া শহরের সর্বত্র। চন্দননগরে অনেক বেশি মানুষ ফ্রান্সের সমর্থক হন বিশ্বকাপের (Qatar World Cup 2022) সময়। আমরা তো বটেই।’’ সেজে উঠেছে ফরাসডাঙা (আগে চন্দননগরের নাম ছিল)। সপ্তদশ শতকে চন্দননগরেই উপনিবেশ গড়েছিল ফরাসিরা। ফরাসি কলোনির ইতিহাস, তার আভিজাত্য আজও ভোলেনি চন্দননগর। ফাইনালের আগে বনেদি কিছু পাড়ায় পা দিলেই তা মালুম হয়। ফ্রান্সের পতাকার রং নীল-সাদা-লাল তেরঙায় ছেয়ে গিয়েছে রাস্তার এধার-ওধার। রং মিলিয়ে বেলুন কিনে সাজানো হচ্ছে একাধিক পাড়া। এক ঝলক দেখলে মনে হতেই পারে, বাংলায় এ যেন এক টুকরো ফ্রান্স! তবে চন্দননগর মানে কী শুধুই ফ্রান্স।
শহর ঘুরলে অবশ্য দেখা যাবে আর্জেন্তিনার (Argentina) সমর্থকও নেহাত কিছুটা কম নয়। স্ট্র্যান্ড রোড থেকে বাগবাজার, উর্দিবাজার, জ্যোতির মোড়, মানকুন্ডু, সার্কাসমাঠ, ছবিঘর, গঞ্জের বাজারে আর্জেন্তিনার পতাকাও পতপত করে উড়ছে। শুধু পতাকা নয়। চন্দননগরের বিখ্যাত আলোকসজ্জাতেও বানানো হয়েছে আর্জেন্তিনার পতাকা থেকে মেসির গোলে শট সবকিছুকেই। এদিকে স্থানীয় মিষ্টির দোকানে বানানো হয়েছে এমবাপে মিষ্টি। এককথায়, গঙ্গাপাড়ের এই শহরে আর্জেন্তিনা-ফ্রান্সের ফুটবল ফিভার, আজ যেন অন্য জায়গার থেকে একটু বেশিই। আর্জেন্তিনার সমর্থকদের দাবি, ব্রাজিল, পর্তুগাল, মরক্কো সহ অন্যান্য দেশের সমর্থকরাও এখন ফ্রান্স হয়ে গিয়েছেন। পছন্দের দল হেরে যাওয়ায় এদের সমর্থকরা রাতারাতি চন্দননগরে বেড়ে গিয়েছে। তবে যেহেতু এটা ফরাসী উপনিবেশ ছিল, তাই ফ্রান্সের প্রতি আলাদা সেন্টিমেন্ট তো আছেই।
এখানে ফরাসী মিউজিয়াম আছে, রয়েছে দুপ্লে কলেজ, শেখানো হয় ফরাসী ভাষাও। চন্দননগরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফরাসী ছোঁয়া যেন এখনও অক্ষত। আর তাই ফরাসডাঙা আজ তাকিয়ে এমবাপের পায়ের ডজের উপর। ফরাসী পরিবার খুব একটা আর নেই এখানে। কিন্তু প্রতিবার জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় প্রচুর ফরাসীও আসেন উৎসবে সামিল হতে। ফরাসি সাহিত্যেরই ছাত্র ঋতম। তাঁর সাফ কথা, ‘‘এই শহরের সংস্কৃতি, স্কুল-কলেজ প্রায় সবই তো ফরাসি হাতে তৈরি। তাই কেন ফ্রান্সকে সমর্থন করব না! চন্দননগর মানেই এক টুকরো ফ্রান্স।’’
ক্রোয়েশিয়া]
বিশ্বকাপের লড়াইয়ে রাজনীতির রংও ম্লান এখানে। তৃণমূল কাউন্সিলরের দলে সেখানে আর্জেন্তিনার পতাকা হাতে দেখা যাচ্ছে সিপিএম নেতাকে। রাত জেগে চলেছে শহর সাজানো। চন্দননগর পুরনিগমের মেয়র পারিষদ সদস্য শুভিজৎ সাউ বলেন, ‘‘চন্দননগরের মানুষের ফ্রান্সের প্রতি একটা সফট কর্ণার রয়েছে ঠিকই। কিন্তু আর্জেন্তিনা সমর্থকও নেহাত কম নয় এথানে। প্রচুর মানুষ রবিবার আর্জেন্তিনার হয়ে গলা ফঁাটাবে। পতাকা-সিকলিতে শহর সেজেছে।’’ তবে আর্জেন্তিনার এই একটা অংশ বাদ দিলে চন্দনগরের পাদ্রিপাড়া থেকে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার— ফাইনালের আগে ফরাসি প্রেমে মাতোয়ারা চন্দননগরের সব প্রজন্ম। ফরাসি ভালবাসায় সেজে ওঠা চন্দননগর এখন অপেক্ষায় খেলা শুরুর জন্য।