মরক্কোর স্বপ্নদৌড় শেষ, ফুটবল বিশ্বের ইচ্ছাপূরণ করে কাপযুদ্ধে মেসির বিরুদ্ধে এমবাপে

মরক্কোর স্বপ্নের দৌড় থামিয়ে দিল ফ্রান্স। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ড্র করে, বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালের মতো ফুটবলের মহাশক্তিধর দেশকে একের পর এক হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিলেন আশরফ হাকিমি, হাকিম জিয়েচরা। সেই দৌড় থেমে গেল ফ্রান্সের কাছে। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মরক্কোকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠে গেল ফ্রান্স। গোল করলেন থিয়ো হের্নান্দেস এবং রান্দাল কোলো মুয়ানি। আগামী রবিবার ফাইনালে লিয়োনেল মেসির আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে খেলবে ফ্রান্স।

ফুটবল ম্যাচে নায়ক হতে গেলে যে গোল করতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। একটা দুর্দান্ত গোলের মুভ বা ডিফেন্সচেরা পাস বাড়ালে সেটাই ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। মঙ্গলবার রাতের সেমিফাইনালে লিয়োনেল মেসির ঐশ্বরিক পাস দেখা গিয়েছে, যা কাজে লাগিয়ে নিজের দ্বিতীয় এবং দলের তৃতীয় গোল করেন ইউলিয়ান আলভারেস। পেনাল্টি থেকে মেসি নিজে গোল না করলেও ম্যাচে তাঁর মাহাত্ম্য মোটেই কমত না। ম্যাচের সেরার পুরস্কারও তাঁর হাতেই উঠত। বুধবারের রাতটাকেও সে ভাবেই বর্ণনা করা চলে। দিনের শেষে স্কোরশিট দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে, সেখানে কোথাও এমবাপের নাম নেই। যেটা দেখাবে না সেটা হল, দু’টি গোলের পিছনেই এমবাপের পায়ের কাজ রয়েছে।

প্রথম গোলটা এল ম্যাচের একদম শুরুতে। দ্বিতীয় গোলটা ম্যাচের প্রায় শেষ প্রান্তে। বলাই বাহুল্য, দু’টি গোল অনায়াসে লেখা হতে পারত এমবাপের নামেই। কিন্তু স্কোরশিটে দেখাবে তাঁর কোনও সতীর্থের নাম। এই ম্যাচের আগে তাঁকে যে কড়া মার্কিংয়ে রাখা হবে, সেটা অজানা ছিল না। সেই কাজ দেওয়া হয়েছিল তাঁরই পরম বন্ধু এবং ক্লাবের সতীর্থ আশরফ হাকিমির উপর। হাকিমি পুরোপুরি বোতলবন্দি করে রাখতে পারেননি বটে, কিন্তু ম্যাচের বেশির ভাগ সময়টাই খুব একটা নড়তে দেননি। কিন্তু আসল ফুটবলার তিনিই হন, যিনি একটা সুযোগ পেলে সেটাতেই বাজিমাত করেন। এমবাপে ঠিক সেটাই করলেন। দুটো ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন, দুটোতেই গোলের চেষ্টা করেছিলেন। নিজের গোল না হলেও দলের হল, লেখা হয়ে গেল ফাইনালের ভাগ্যটাও।

বিশ্বফুটবলে বছর পাঁচেক ধরে দাপাচ্ছেন তিনি। প্যারিসের আধা-শহুরে এলাকা বন্ডিতে জন্ম এমবাপের। তবে ফ্রান্সের নয়, এমবাপে আগে পরিচিত হন ক্লাব ফুটবল খেলেই। বন্ডির ক্লাবে যুব ফুটবল খেলে উত্থান হওয়ার পর মোনাকোতে সময় কাটিয়েছেন। ইউরোপীয় ফুটবলে খুব বড় নাম না হলেও ২০১৭-র চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দুর্দান্ত খেলে মোনাকো। সেমিফাইনালে উঠে যায় তারা। সেই যাত্রাপথে যিনি সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছিলেন, তাঁর নাম এমবাপে। তখন তিনি ১৭ বছরের উঠতি ফুটবলার। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পারফরম্যান্স বলে দেয়, তিনি ভবিষ্যতের তারকা হতে চলেছেন। এমনিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বিশ্বকাপের মতোই প্রতি মরসুমে কোনও না কোনও তারকা তুলে আনে। সে বছর এনেছিল এমবাপেকে।

কাতারি মালিকের অর্থে তখন প্যারিস সঁ জরমঁ দাপট দেখাচ্ছে। এমবাপের মতো তরুণ প্রতিভাকে দেখার পর থেমে থাকেনি তারা। পরের বছরই বিরাট অঙ্কে লোনে তুলে নেয় এমবাপেকে। তার পরের বছর এমবাপেকে কিনেই নেয়। তত দিনে সেই ক্লাবে চলে এসেছেন নেমারও। ব্রাজিলীয় তারকা এসে চোট-আঘাতে ভুগলেও এমবাপে ক্রমশ নিজেকে চেনাতে শুরু করেছিলেন। ২০১৮-র বিশ্বকাপ তাঁকে আলাদা করে পরিচিতি দেয়। কে ভুলবে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে তাঁর দু’টি গোল। পরের চার বছরে অনেকটাই পরিণত হয়েছেন এমবাপে। যে কারণে আগামী রবিবার ফাইনাল খেলতে নামার আগে তাঁর নামের পাশে পাঁচটি গোল রয়েছে।

রবিবার অবশ্য শুধু এমবাপে নয়, নজর সবচেয়ে বেশি থাকবে আর একজনের দিকে। বলাই বাহুল্য, তাঁর নাম লিয়োনেল মেসি। মেসি বনাম এমবাপের দ্বৈরথ এ বারের বিশ্বকাপ ফাইনালের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠতে চলেছে। ঘটনাচক্রে, বছর দেড়েক আগে নিজের প্রাণের শহর বার্সেলোনা ছেড়ে প্যারিসে ঘাঁটি গেড়েছেন মেসি। ফলে এখন প্যারিসে সসম্মানে বিরাজমান মেসি, নেমার দু’জনেই। তার মধ্যে থেকেও এমবাপে কেন আলাদা, কেন তিনি ফ্রান্স বা প্যারিসের প্রাণ, সেটা বোঝা যায় কয়েক মাস আগের ঘটনা মনে করালেই। গত মরসুম সবে শেষ হয়েছে। পিএসজি ছেড়ে এমবাপে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেবেন, এটা একেবারে নিশ্চিত। যখন সব পাকা, তখন আসরে নামলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়ের মাকরঁ। নিজে এমবাপেকে অনুরোধ করলেন প্যারিসে থেকে যাওয়ার জন্য। কোনও ফুটবলারকে দেশের ক্লাবে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করছেন খোদ রাষ্ট্রপ্রধান, এটা আগে কখনও ঘটেছে বলে মনে পড়ছে না অনেকেরই। মাকরঁর অনুরোধ ফেলতে পারেননি এমবাপে। তবে তিনি ফতোয়া জারি করে দেন, ক্লাবে সবচেয়ে বেশি বেতন হবে তাঁরই। এবং মেসি, নেমারকে ছাপিয়ে তাঁকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পিএসজি অবলীলায় সব ‘আব্দার’ মেনে নেয়।

এ বারই এমবাপের আসল পরীক্ষা। বিশ্বকাপে তিনি ফ্রান্সের জার্সিতে খেলছেন। মেসি নামবেন আর্জেন্টিনার জার্সিতে। ক্লাবে যে ভাবে মেসি, নেমারের ছত্রছায়া থেকে নিজেকে আলাদা করে চেনাতে মরিয়া এমবাপে, সেটা দেশের হয়ে কি দেখা যাবে? মেসি ব্যক্তিগত প্রতিভায় কার্যত একার হাতে দলকে টেনে তুলেছেন ফাইনালে। এমবাপে পাঁচটি গোল করলেও একার হাতে দলকে টেনে তুলেছেন, এটা বলা অনুচিত। কোনও ম্যাচে অলিভিয়ের জিহু, কোনও ম্যাচে আঁতোয়া গ্রিজম্যান তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন। এমবাপেকে কড়া মার্কিংয়ে রাখা হলে বাকি দু’জন চেষ্টা করেছেন দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেওয়ার।

২০১৪-র হৃদয়ভঙ্গের পর এ বার দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া মেসি। সেমিফাইনালেই বলে দিয়েছেন, রবিবার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জার্সিতে শেষ ম্যাচ খেলতে নামবেন। কোনও ফুটবলার পরের ম্যাচের আগেই এই ধরনের কথা বললে সহজেই অনুমেয়, কতটা তাগিদ সে দিন তাঁর মধ্যে কাজ করবে। এমবাপের কাছে এখনও সুযোগ রয়েছে অন্তত তিনটি বিশ্বকাপে খেলার। ফলে এ বার না পেলে আর যে হবে না, তার কোনও মানে নেই। তা ছাড়া, বিশ্বকাপের স্বাদ তো ১৮ বছর বয়সে নেওয়া হয়েই গিয়েছে। বরং রবিবার হয়তো দেখা যেতে চলেছে বিশ্বফুটবলে মেসি-রোনাল্ডোহীন যুগের অবসানে নতুন তারকার উদয়ের লড়াই। এমবাপের হাতে শেষ পর্যন্ত কাপ উঠলে, আগামী অন্তত ১০ বছর যে তিনিই রাজত্ব করবেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমবাপে নিজেও জানেন সেটা। অপেক্ষা শুধু আর তিন দিনের।

বুধবারের ম্যাচে পাঁচ মিনিটেই গোল করে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। এ বারের বিশ্বকাপে এই ম্যাচের আগে পর্যন্ত বিপক্ষের কোনও ফুটবলার মরক্কোর জালে বল জড়াতে পারেননি। সেই নজির ভেঙে গেল বুধবার রাতেই। ভেঙে দিলেন থিয়ো হের্নান্দেস। গ্রিজম্যান একটু সামনে এগিয়ে বল পাস বাড়ান সামনে থাকা এমবাপেকে। এমবাপে দু’বার গোলের উদ্দেশে শট মারলেও তা আটকে যায়। শেষ বার এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে তা চলে যায় বাঁ দিকে থাকা থিয়োর দিকে। মরক্কোর ডিফেন্ডাররা তত ক্ষণে এক দিকে সরে এসেছেন। উল্টো দিকে থাকা থিয়ো কিছুটা লাফিয়ে বাঁ পায়ের সাইড ভলিতে বল জালে জড়ান। ১৯৫৮ সালের পর বিশ্বকাপের কোনও সেমিফাইনালে দ্রুততম গোল এটি।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগে গোল করেন কোলো মুয়ানি। এ বারেও সেই এমবাপের প্রচেষ্টা থেকেই গোল এল। বক্সের মাঝখান থেকে বল পেয়েছিলেন চুয়ামেনি। তিনি পাস দেন এমবাপেকে। দু’-তিন জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে পায়ের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে গোল করার চেষ্টা করেছিলেন এমবাপে। বল মরক্কোর এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে সোজা চলে যায় ডান দিকে দাঁড়ানো কোলো মুয়ানির কাছে। অনায়াসে বল জালে জড়ান তিনি।

প্রথমার্ধে একটু নিষ্প্রভ ছিলেন এমবাপে। প্রথম গোলের পর খুব বেশি চোখে পড়েনি তাঁকে। দ্বিতীয়ার্ধে অনেকটাই সপ্রতিভ তিনি। বার বার বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণে উঠলেন। প্রতিপক্ষের ট্যাকলে বক্সের মধ্যে গোড়ালি চেপে ধরে শুয়ে গড়াগড়ি খেলেন। জিহু উঠে যাওয়ার পর জায়গা বদল করে চলে এলেন মাঝে। তার পরে গোলও করালেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.