প্ৰথম পর্ব
কাল সকালে উঠব মোরা
যাব নদীর কূলে_
শিব গড়িয়ে করব পুজো,
আনব কুসুম তুলে।
মোরা ভোরের বেলা গাঁথব মালা,
দুলব সে দোলায়,
বাজিয়ে বাঁশি গান গাহিব
বকুলের তলায়।
না ভাই, কাল সকালে মায়ের কাছে
নিয়ে যাব ধ'রে,
মা বলেছে ঋষির সাজে
সাজিয়ে দেবে তোরে!
মহামায়ার ইচ্ছায় মহাকালের হাতে চক্র ঘুরে চলেছে। কালের নিয়মে চিন্তার স্রোত ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। একটা সময়ের পর আজ আমাদের নিকট স্বদেশ ও স্বজাতির সভ্যতা ও সনাতনী ধর্ম আমাদের গৌরব ও প্রেমের মুখ্য বিষয় । আজ এই মহাজাতির বিশাল সাধনরাজ্যের মধ্যে যে সমস্ত মহৎ রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে , তৎ সমুদয়ের শ্রদ্ধান্বিতভাবে উপলব্ধি করার একটা অমোঘ আকাঙ্খা আমাদের চিত্তকে ব্যাকুল করে তুলেছে। প্রাচীন ও কীটদষ্ট জীর্ণ পুঁথির উদ্ধার, প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহ , কোন্ স্মরনাতীত কাল হতে সেই সকল আচার অনুষ্ঠান নিয়ম ও ব্যবস্থা আমাদের সমাজ , রাজনীতি ও অর্থনীতিকে একটু একটু করে নিৰ্মাণ করেছে , সেই সকল সুপ্রাচীন তত্ত্বকে উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা আমাদের এই চিত্ত চঞ্চলতার পরিচায়ক।
একটি অতি বৃহৎ ও সভ্যজাতি বহু বহু শতাব্দীর মধ্য দিয়ে এক সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। হঠাৎ কোন এক নব্য জ্ঞানদৃপ্ত সভ্যতা তার অনুষ্ঠান ও তার নিয়ম , তার সকল কিছু নিয়ে যখন এ দেশে এল ,তখন হঠাৎই আমরা এক দারুণ মোহ ও বিস্মৃতিতে , অভিভূত হয়ে পড়লাম। আমাদের নিজেদের কি আছে অন্বেষণ করতেই ভুলে গেলাম। তার নিগূঢ় অর্থ কি তাও ভাবার অবসর হারালাম। আমাদের অবসর গ্রাস করল ঘরে বসে থাকা কিছু খেলা, যন্ত্র ইত্যাদি। আমরা নিজত্ব বর্জন করে আত্মপ্রকৃতি হতে সর্বতোভাবে বিচ্যুত হয়ে অন্ধ অনুকরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এই সময় নিজেকে নষ্ট করে একেবারে অমৃত ত্যাগ করে মৃতের লোকে ছুটে ছিলাম। তারপর #এখনকালচক্ৰঘুরে গেছে। তাই আজ এই প্রবন্ধ রচনা।
বিদেশী নানা প্রলোভন নগর সমূহে প্রবেশ করে আমাদের সুপ্রাচীন ও তপস্যানিরত ভারতবর্ষকে তথা হতে নির্বাসিত করে বিহগকলকন্ঠ মুখরিত ছায়াশীতল শান্ত পল্লীগুলোকে ক্রমে ক্রমে অধিকার করছে। সেই ইন্দ্রজাল হতে রক্ষার দায় তো আমাদেরই উপর বর্তায়।
যাঁরা যথার্থ স্বদেশ প্রেমিক , তাঁদের আজ এই ভয়াবহ সমস্যায় পুরদেশে বীরের মতো দাঁড়াতে হবে। নানা রকম বৈদ্যুতিক প্রলোভনকারী ক্রীড়া , যাতে দেহ বা মন বা মস্তিষ্ক কিছুরই সঞ্চালনা হয় না কবেল শরীরের পাতন ও ক্ষতি সাধন হয় সেসবের প্রভাবে আমাদের মাঠে ঘাটে দৌড়ে বেড়ানো খেলা বা গৃহের মাঝে মস্তিকে চালনার খেলা গুলিকে ভুলেই গেছে। এর মধ্যে প্রাচীন খেলা গুলী অবলুপ্ত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। তবুও কোথাও কোথাও যখন দেখি প্রাচীন ক্রীড়া গুলির চিহ্নটুকু দেখি তখন সত্যই হৃদয় পুলকিত হয়ে ওঠে।
প্রতিটি প্রাচীন ক্রীড়ার অন্তরালে প্রাচীন ভারত সমাধিমগ্ন হয়ে উপবিষ্ট আছে। ভারতবর্ষীয় সাধনায় যা বিশিষ্টতা, ভারতবর্ষ তা প্রাচীন দর্শনসাহিত্য কাব্য ,স্থাপত্য , ভাস্কর্য, গৃহস্থালীর মধ্য দিয়ে যে সকল সত্য যুগ যুগান্ত ধরে প্রচার করছে , এই অতি প্রাচীন এবং অবলুপ্ত ক্রীড়াগুলির মধ্যেও সেই সমস্ত মহাসত্যের অপূর্ব সমাবেশ রয়েছে। শৈশবের মোহস্মৃতি বিজড়িত, কৈশোর স্বপ্নের নন্দন মন্দার সুরভিত , কোটি কোটি কোমল কন্ঠের কৌতুক হাস্যরোল মুখরিত শান্ত পল্লীর ক্রীড়াক্ষেত্রগুলি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
আমার নিজস্ব মত, ক্রীড়ার কোনো বালক বালিকা হয় না বা স্ত্রী পুরুষ বিভেদ হয় না। অন্তত ছোট বেলায় আমি তেমন ভেদ পাই নি , সেখানে কেবল একরাশ স্বাধীন শৈশব আদরে ঘিরে থাকত। সেই আবেগ বৈশাখের দুপুরের কাঠফাটা গরম হোক বা বর্ষায় একমানুষ জল হোক বা হাড় হিম করা শীত সকল ঋতুর আপন আপন শৈশব ছিল , সেই শৈশবে খেলা ছিল।
ঐখানে মা পুকুর পাড়ে
জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে
হোথায় হব বনবাসী—
কেউ কোত্থাও নেই।
ঐখানে ঝাউতলা জুড়ে
বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে,
শুক্নো পাতা বিছিয়ে ঘরে
থাকব দুজনেই।
শিশু যেমন দেখে , অধিকাংশ ক্ষেত্রে তেমনই শেখে। তাই যা তার মনে ধরে সে প্রায়ই তার অনুকরণের চেষ্টা করে। তাই একসময় ঠাকুর গড়ে খেলা হোক বা তালপাতার খাঁড়া দিয়ে মাটির পাঁঠা বলি অথবা নামগান করা সবই সেই শৈশবের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি ছিল। এখন সে সব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই দেখা যায়। পুতুল খেলা , পুতুল বা বিড়ালের বিয়ে, রান্নাবান্না এসবই শৈশবের নিজস্ব । সবার মধ্যেই এমনটি দেখা যায়। দোকান করা , কুলির জলে পাতার ঠোঙা কিংবা ডোঙা ভাসিয়ে ছুটোছুটি এসব খেলা বালক বালিকা দুদলেই মিলেমিশে খেলে।
বর্তমানের খেলাগুলি শিশুকে শিখিয়ে না দিলে খেলতে পারে না। ছোট বেলায় বল কিনতে না পেরে লোকের বাড়ির গাছের বাতাবি লেবু পেড়ে বা ছেঁড়া ন্যাকড়ার পুঁটুলী বেঁধে বল বানিয়ে খেলতাম । এখন সে সব স্মৃতিও বিস্মৃত প্রায়। আজকাল গ্রাম বা মফঃস্বল দেখলে বাঙ্গালীর যে নিজস্ব কিছু খেলা ছিল তা আর জানা যায় না। আজকাল অতীত , শৈশব , গ্রামের খেলা কোথায় যেন লুপ্ত হয়ে গেছে।
এসব অতীত খেলা কোন সময়ে কিরূপে সৃষ্টি হয়েছিল তা বলা যায় না । এসব খেলার সৃষ্টিকর্তাদের সকলের নামও খুঁজে পাওয়া যায় না । লুপ্ত যেসব খেলা ইত্যাদি নিয়ে এই প্রবন্ধের নানা পর্বে আলোচনা করব সেসব খেলা কোনো ভাবে পুনরায় প্রচলন করা যায় কিনা , তার কোন কোন উপকারিতা আছে , সেগুলি চর্চা করলে মস্তিষ্ক এবং শরীরের উপর কি কি প্রভাব পড়বে সেসব নিয়ে বর্তমান ব্যায়ামকুশলী বা ডাক্তার প্রমুখরা আলোচনা করে দেখতে পারেন।
তাছাড়াও এইসব খেলার যতটুকু বিবরণ প্রাপ্ত হয় নানা গ্রন্থ ইত্যাদি থেকে তা সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা করেছি মাত্র। কারণ এসব প্রাচীন ক্রীড়ার মধ্যে ঐতিহাসিক অখন্ড ভারতের পল্লীর আচার ব্যবহার, রীতিনীতি একটি ভগ্নাংশ , জাতীয় চরিত্র , একটি শৈশব চিত্র এবং গ্রাম্য শিশু মানসের একটি প্রতিচ্ছবির আভাস প্রাপ্ত হয় ।
কেহ বলে সন্ধ্যা করি জলেতে নামিয়া।
ডুব দিয়া লইয়া যায় চরণে ধরিয়া।।
আমাদের প্রাচীন কাব্যগ্রন্থগুলিতে সেকালের খেলায় বিশেষ কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। শ্রীচৈতন্য ভাগবতে শ্ৰীগৌরাঙ্গের বাল্যকালের নানা কথার উল্লেখ আছে। সেখানে গঙ্গায় স্নানরত বালক নিমাইয়ের খেলার একটি সুন্দর চিত্র আছে । নিমাইয়ের দস্যিপানায় উত্যক্ত হয়ে নদীয়ার লোক জগন্নাথ মিশ্রের নিকট নালিশ করতে এসেছেন।
কেহ বলে মোর পৃষ্ঠ দিয়া কান্ধে চড়ে।
মুঞিরে মহেশ বলি ঝাঁপ দিয়া পড়ে।।
বালিকারা শচীমাতার নিকট এসে অনুযোগ করছেন –
ওকড়ার বিচি দেয় কেশের ভিতরে।
এগুলো কিন্তু তেমন ভাবলে খেলা , তেমন ভাবলে বাল্যকালের দুরন্তপনা।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামর চন্ডী মঙ্গলে কালকেতুর প্রসঙ্গে #খেলেদান্ডাগুলিভাঁটা – র উল্লেখ পাই। অপর দিকে শ্রীমন্ত সওদাগর যেন একেবারেই প্রহ্লাদ চরিত্র।
ব্যাধের ছেলে কালকেতু –
লইয়া ফাউড়া ডেলা যার সঙ্গে করে খেলা
তার হয় জীবন সংশয় ।
যে জনে আঁকড়ি ধরে পড়য়ে ধরণী পরে
ভয়ে কেহ নিয়ড়ে না রয়।।
লক্ষ্যভেদ, বাঁটুল ছুড়তে শেখা, খেদিয়ে শজারু ধরা ও বাঁটুল ছুঁড়ে শিকারাদি সাধারণ খেলা নয়। বরং এগুলি আত্মরক্ষা , যুদ্ধ প্রণালী এবং শক্তি প্রদর্শনের মধ্যেও পড়ত।
এক রকম খেলা হল #ফাউড়া_ডেলা। ছোট বাঁশের লাঠি নিয়ে পোড়া মাটির ঢিল তাক করে ছুঁড়ে মারাকে ফাউড়া ডেলা বলা হত। পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন স্থানে লাঠিকে ফাবড় বলে । একটি নির্দিষ্ট স্থানকে বা নির্দিষ্ট কাউকে লক্ষ্য করে ওই লাঠি ছুঁড়ে দেবার নাম ফাবর মারা বা ফাবড়ানো। বীরভূমে অতীতে রাখাল বালকদের মধ্যে ফাবড় মারার পাল্লামূলক একটি খেলা ছিল। যার ফাবড় সর্বাপেক্ষা অধিক দূরে যাবে সেই খেলায় জয়ী হতো। ডেলা বা ঢিল ছোড়ারও পাল্লা চলত। পোড়ামাটির ঢেলা বা ঘুটিংও ফাবড় দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হতো।
শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় কয়েক প্রকার খেলার কথা উল্লিখিত হয়েছে । “বলরাম ও কৃষ্ণ কখন ভ্রমণ , কখনো উল্মফন , ক্ষেপণ , আস্ফোটণ , বিকর্ষণ ও বাহুযুদ্ধ দ্বারা ক্রীড়া করতে লাগলেন। কখনো বিল্ব ,কখনো কুশুম্ভ বৃক্ষের ফল, কখনো বা আমলক দ্বারা ক্রীড়া করতে লাগলেন। কখনো ভেকের ন্যায় জলে সন্তরণ করতে লাগলেন। কখনো ধরা ছোঁয়া খেলা বা চোর শাসক খেলায় অস্পৃশ্য হয়ে অন্যকে ধরার নিমিত্ত দৌড়ে বেড়াতে লাগলেন। কখনো #অন্ধরূপ ধারণ করে ক্রীড়া করতে লাগলেন। কখনো মৃগাদি বা পক্ষীর ন্যায় বিচরণ ও শব্দাদি করতে লাগলেন। কখনো দোলায় দুলতে লাগলেন। কখনো বা রাজা হয়ে ক্রীড়া আরম্ভ করলেন। “
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লিখিত চোর শাসক – নিজে দুস্টু চোর হয়ে অন্যকে দৌড়ে স্পর্শ করা , অন্ধরূপ ধারণ করা ইত্যাদি খেলা তো আজও বঙ্গ তথা ভারতে প্রচলিত আছে। স্থানভেদে এই খেলার প্রকারভেদ দেখতে পাই।কোথাও এই খেলা বুড়ি ছোঁয়া , কোথাও চোর দারগা ইত্যাদি নামে পরিচিত।
একটা খেলা ছোট বেলায় আমার দিদা ঠাকুমারা খেলতেন বলে তাঁদের মুখে শুনেছি। তাঁদের মধ্যে একজন বুড়ি হতো। বুড়ি গোপনে হাতের একটি আঙ্গুল মটকে সব আঙ্গুল গুলো বের করতো। তারপর এক এক জন বালক বালিকা বুড়ির এক একটি
আঙ্গুল ধরতো। যে ওই মটকানো আঙ্গুলটি ধরতো সেই হতো অস্পৃশ্য। বুড়ি তখন বলতো ” তেলি, হাত পিছলে গেলি। ” এরপর বাকি ছেলেমেয়েদের ছেড়ে বুড়ি অস্পৃশ্যের চোখ চেপে আটকে ধরতো। তারপর শুধাত ” ভাত কেমন ?” অস্পৃশ্য বলতো – ” টগবগ” ।
” ডাল কেমন ?”
- ভুরভুর
“তরকারী কেমন ?”
- ছেঁক ছেঁক
বুড়ি তাকে ছেড়ে দিয়ে তখন বলতো , ” আয় ফুল ঝিঙের ঝোল , যাকে পাবি তাকে ছোঁ। “
অস্পৃশ্য এর পর দৌড়ে যাকে ছুঁতে পারত সেই হতো পরের অস্পৃশ্য।
খেলার শেষে অস্পৃশ্যত্ব ঘুচিয়ে দিতে হতো। অস্পৃশ্য বালক বা বালিকার হাতে একগাছি ঘাস বা একটি সবুজ পাতা দিয়ে শুধাতো ” এটা কি ?”
অস্পৃশ্য বালক বা বালিকা বলতো , ” বিছে “।
বুড়ি বলতো , ” হাড়ি তোর গেল ঘুচে …” , এমনি করেই খেলা শেষ হতো। যদি কোনো বালক বা বালিকা অস্পৃশ্য হবার খেলা সম্পূর্ণ না করে চলে যেত তখন সকলে তাকে গালি দিত। এটাই খেলার নিয়ম । সেই গালিতে বলা হতো ” তাল গাছে জল পড়ে টপর টপর । হাড়ি হয়ে ঘরে যায় মুচির চাকর। ” এরম আরও অনেক খেলা আছে যাতে অস্পৃশ্য হবার রীতি আছে।
অন্ধরূপ ধারণ করে ভ্রমণ – বোধহয় কানামাছি খেলা। স্থান ভেদে এই খেলা নানারূপে প্রচলিত আছে। এতে একজনের চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে পার্শ্ববর্তী বালক বালিকাদের ছোঁবার চেষ্টা করে। সঙ্গীদল তখন ছুটে পালায়। চোখ যার বাঁধা সে যাকে ছোঁবে , তার চোখ বাঁধা পড়ে এবং পূর্ববর্তীকে মুক্তি দিতে হয়।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ ) বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস
২) গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি