দু’দলের অনুশীলনের একেবারে শেষের দিকে যুগলবন্দিটা তৈরি হল। চিত্র সাংবাদিকেরা এত ক্ষণ ওঁত পেতে যে ছবিটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
গৌতম গম্ভীর ও শ্রেয়স আয়ার একসঙ্গে? কেকেআর অধিনায়কের কাঁধে হাত রেখে বোঝাচ্ছেন নতুন মেন্টর। আইপিএল ২০২৪ শুরুর লগ্নে ইডেনে এর চেয়ে গভীর মুহূর্ত আর কী হতে পারে? তিনি গৌতম গম্ভীর— নাইট রাইডার্সকে দু’বার আইপিএল ট্রফিই শুধু দেননি, ওয়াংখেড়েতে ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের সেই মায়াবী রাতে ফাইনালের সর্বোচ্চ স্কোরার। তিনি শ্রেয়স আয়ার— হঠাৎই ভারতীয় বোর্ড এবং জাতীয় নির্বাচকমণ্ডলীর হাতে লাল কার্ড দেখে ভারতীয় ক্রিকেট থেকে আপাতত বিসর্জিত। এই দুঃসময়ে গুরু-গম্ভীর আলাপের চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কী হতে পারে?
কিন্তু না, মিলছে না।
তবে কি সুনীল নারাইন-আন্দ্রে রাসেল জুটি? নাইট রাইডার্সের বহু যুদ্ধের এত পুরনো দুই ঘোড়া। ধোনি নিয়ে বিদায়ী আবেগের মধ্যে নাইট শিবিরেও একটা শিরশিরানি উৎপন্ন হচ্ছে। নারাইনের এটাই শেষ বছর নয় তো? হলুদ জার্সি যেমন ধোনিকে ছাড়া ভাবা যায় না, তেমনই বেগুনি হয় না নারাইনকে ছাড়া।
কিন্তু না, এটাও না।
তা হলে নিশ্চয়ই রিঙ্কু সিংহকে নিয়ে কোনও ছবি হবে। ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন তারকা। নাইট রাইডার্স ভক্তদের নতুন ডার্লিং। ওই তো ক্লাব হাউজ়ের লোয়ার টিয়ারে ঝুঁকে পড়েছে জনতা। রিঙ্কু ভাই, রিঙ্কু ভাই— ডেকেই চলেছে তারা। নিশ্চয়ই শাহরুখ বুকে জড়িয়ে ধরেছেন রিঙ্কুকে— এ রকম কোনও ছবি হবে। এমনিতেই শাহরুখ নাইট ভক্তদের জন্য যে আবেগপূর্ণ স্লোগান বাজারে ছেড়েছেন, শুনলে রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। ‘ইয়ে ময়দান মেরা হ্যায়/ইয়ে আসমান ভি/ইয়ে জং মেরি হ্যায়/ম্যায় হুঁ তো হম হ্যায়/ হম হ্যায় তো জিত হ্যায়/আমি কেকেআর!’ এমন বাদশাহী মেজাজ আর গলায় কথাগুলো বলেছেন যে, টিম মিটিংয়ে স্রেফ এটাই বাজিয়ে দলকে শোনাতে পারেন গম্ভীর। রক্ত টগবগ করে ফুটবে। ক্রিকেটের বাজিগর রিঙ্কু সিংহের সঙ্গে বলিউডের বাজিগর শাহরুখ খান। দারুণ ছবি।
কিন্তু শুক্রবারের ইডেনে এই যুগলবন্দিই বা হওয়ার সুযোগ ছিল কোথায়? শাহরুখ নাইটদের প্রথম ম্যাচে থাকবেন। তবে তিনি তো বরাবরই ম্যাচের দিন আসেন আর তার পরে কুসংস্কার অনুযায়ী, কয়েক ওভার পরে মাঠে ঢোকেন। রিঙ্কুর সঙ্গে ছবি উঠলেও শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তবে কি বিপক্ষ সানরাইজ়ার্স হায়দরাবাদের দুই অস্ট্রেলীয়? প্যাট কামিন্স ও ট্রাভিস হেড একসঙ্গে? গত ১৯ নভেম্বর রাতে আমদাবাদে বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের ঘাতক জুটি। এক জন বল হাতে, অন্য জন ব্যাট হাতে চুরমার করে দিয়ে যান ভারতীয় স্বপ্নকে। কে জানে সেই কালরাত্তিরকে মনে করিয়ে আর কোটি কোটি ভারতবাসীর বুকের বাঁ দিকে আরও একবার যন্ত্রণা তুলে সেই দুই শনি ফের এক ফ্রেমে উদয় হল কি না!
হুঁ, হুঁ, সেটাও নয়।
সাসপেন্স আর না বাড়িয়ে বলে দেওয়া যাক। ছবিটা আসলে দুই অস্ট্রেলীয় ফাস্ট বোলারের। নাইট রাইডার্সের দীর্ঘকায় বাঁ হাতি এগিয়ে গেলেন তাঁর দেশের অধিনায়কের দিকে। মিচেল স্টার্ক ও প্যাট কামিন্স। রোহিতের দলকে হারানো সেই ঘাতক দলে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন। শনিবার দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ। এমনিতেই দুই অস্ট্রেলীয় পেসারের দ্বৈরথ ঘিরে শিরোনাম তৈরি হয়ে গিয়েছে। নাইট এক্সপ্রেস বনাম হায়দরাবাদ মেল। দু’জনের হাত মেলানো দেখতে দেখতে একটা সংখ্যা মাথায় আসছিল— ৪৫.২৫ কোটি। ৪৫ কোটি ২৫ লক্ষ। আইপিএলের ইতিহাসে সর্বকালীন সর্বোচ্চ দরের দুই ক্রিকেটার। স্টার্ক ২৪ কোটি ৭৫ লক্ষ। কামিন্স ২০ কোটি ৫০ লক্ষ। কোনও দল ফাইনাল খেললে আইপিএলে সব মিলিয়ে খেলবে ১৭টি ম্যাচ। একটা হিসাব সমাজমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছে। স্টার্কের এক-একটা বলের দাম ৬ লক্ষ মতো। কামিন্সের প্রত্যেকটা বলের দাম ৫ লক্ষ। স্টার্ক শুনলাম বলেছেন, ইডেনের পঁয়ষট্টি হাজার দর্শকের সামনে খেলতে মুখিয়ে আছেন। কেউ কি তাঁর কানে কানে এটাও মনে করিয়ে দিল যে, ভাই ২৪ কোটি ৭৫ লক্ষের ঠ্যালা টের পাবে যদি বলগুলো গ্যালারিতে উড়ে উড়ে গিয়ে পড়ে। তখন ডিজে না বাজিয়ে দেন, ‘উড়ি উড়ি যায়, উড়ি উড়ি যায়!’ টাকার চাপ আর ভর্তি গ্যালারির গর্জন মিলিয়ে হাই ব্লাড প্রেশার বাধিয়ে দেশে ফিরলে দোষ দিয়ো না যেন। সঙ্গে তাড়া করবে আইপিএলের অতীত রেকর্ডের ভূত। ২০১৫-তে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে ১৩টি ম্যাচ খেলে পেয়েছিলেন ২০ উইকেট। ওভার প্রতি রান দেন ৬.৭৬। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শেষ ৪০টি ম্যাচের হিসাব ধরলে ওভার প্রতি ৮ রানেরও বেশি করে দিয়েছেন। যদিও এ দিন ইডেনে দাঁড়িয়ে শুনলাম, নাইট রাইডার্স অন্দরমহলে দারুণ উত্তেজনা তৈরি করেছেন স্টার্ক। দুরন্ত গতিতে বল করছেন, সম্পূর্ণ ফিটনেস নিয়ে নামবেন, যেটা তাঁর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল। কামিন্সও যতই বিশ্বকাপ ও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট জিতুন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হিসেবে, টি-টোয়েন্টি দুনিয়ায় ততটা সড়গড় নন।
তবে আগুনে ঘি ঢালতে পারে ইডেনের বাইশ গজ। যেখানে বাড়তি বাউন্স থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। হালফিলে ইডেনের পিচে অতীতের মতো স্পিনারদের হাতে বল উঠলেই ‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক, এই দুনিয়া ঘোরে বনবন বনবন’ গান বাজে না। বরং এমনই গতিসম্পন্ন ও বাউন্সে ভরা যে, সময়-সময় দেশে বসে বিদেশ মনে হয়েছে। বিশ্বকাপের সময় কী ছিল, তা ভেবে আর কাজ নেই কারণ সেই লঙ্কাও এখন নেই, সেই রাবণও নেই। দ্রাবিড়-রোহিত ইডেনে আবদার করে যা পেয়েছেন, একই অভ্যর্থনা গম্ভীর-শ্রেয়স পাবেন, ভাবলে এটাও ধরে নিতে পারেন বেঙ্গালুরুতে নাইটদের দ্বিতীয় ম্যাচে গম্ভীরকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাবেন বিরাট কোহলি। তাই স্টার্ক বনাম কামিন্স দ্বৈরথ জমতেই পারে শনিবারের ইডেনে। মনে রাখতে হবে, এ বারের আইপিএল থেকে দু’টো বাউন্সারের নিয়মও চালু হয়েছে। তাই পেসারদের জন্য বাড়তি সুবিধা থাকছে। হায়দরাবাদের হাতে কামিন্স ছাড়াও ভুবনেশ্বর কুমার আর উমরান মালিক আছে। টি নটরাজন আছে। কেকেআরের স্টার্ককে বাদ দিলে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ পেস আক্রমণ। সেটা অবশ্যই চিন্তার কারণ।
শাহরুখের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইডেন কি গাইবে ‘আমি কেকেআর’? সানরাইজ়ার্সকে উড়িয়ে বেগুনি রঙে কি হোলি খেলবে কলকাতা? ভক্তদের আশার একটা বড় কারণ গম্ভীরের প্রত্যাবর্তন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মস্তিষ্কে অনেককে হার মানাতে পারেন। ব্যক্তিপুজোয় বিশ্বাসী নন, দল নিবেদিত প্রাণ। এ দিনও সবার শেষে মাঠ ছাড়লেন। গম্ভীর ডাগআউটে থাকা মানে চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতকে দেখে ঝিমুনি আসার মতো ব্যাপার নেই। বরং সব সময় তক্কে তক্কে থাকতে হবে, এই না তেড়ে গেলেন কারও দিকে! তাঁর আগ্রাসী মনোভাব দলের মধ্যে সংক্রমিত হলে অবশ্যই অনেক ডাকাবুকো কেকেআর-কে দেখতে পাওয়া উচিত। শ্রেয়স আয়ার গতবার চোটের জন্য ছিলেন না, তিনি ফিরছেন। সবচেয়ে বড় কথা, রিঙ্কু সিংহ নামছেন সিংহপ্রতাপ নিয়ে। নাইটদের প্র্যাক্টিস ম্যাচে স্টার্ককে যে ভাবে তিনি পেটাচ্ছিলেন, তা দেখে আশা-আশঙ্কা দুই-ই হচ্ছিল। রিঙ্কু পাঁচ ছক্কার পারফিউম গায়ে মেখে নতুন মরসুম শুরু করবেন। আর স্টার্ক হায়দরাবাদ ম্যাচেও এ রকম মার খাবেন না তো? হায়দরাবাদের হেনরিখ ক্লাসেন আছে, বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ট্রাভিস হেড আছে। দু’জনেই বড় শট মারতে পারেন। সঙ্গে এডেন মার্করাম। খুবই নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান।
অনুশীলন শেষে নাইট রাইডার্স ক্রিকেটারদের বাসে ওঠা দেখতে দেখতে আবার মনে হচ্ছিল, ‘আর’ বলতে এখন রাসেল নয়। রিঙ্কু। ‘এস’ বলতে স্টার্ক পরে, আগে সিংহ। জনতা বাঁধনহারা এক জনকে নিয়েই। রিঙ্কু সিংহ। শনিবারের ইডেনে তিনি ব্যাট হাতে নামলেই ডিজে বাজিয়ে দিতেই পারেন ‘তুনে মারি এন্ট্রিয়া রে, দিল মে বজি ঘণ্টিয়া রে’!