সব পেয়েও শূন্যতা! মেসি না রোনাল্ডো, বিশ্বকাপে কে পারবেন আক্ষেপ মেটাতে

রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ। অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টার। বিভিন্ন কারণে এই বিশ্বকাপ বাকিগুলির থেকে আলাদা হতে চলেছে। আয়োজন, পরিকাঠামো, সাজসজ্জা, ব্যাপ্তি— সব কিছুতেই বাকিদের ছাপিয়ে যেতে চলেছে কাতার। একই সঙ্গে যোগ হয়েছে বিবিধ বিতর্ক। তবে এগুলি ছাড়াও, এই বিশ্বকাপ দু’জনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। নিঃসন্দেহে তাঁরা হলেন লিয়োনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। সম্ভবত এই প্রজন্মের দুই সেরা ফুটবলার, যাঁদের কাছে সব রয়েছে, শুধু একটিই জিনিস নেই— বিশ্বকাপ। তাই এ বারের প্রতিযোগিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দু’জনের কাছেই। কাপ হাতে উঠুক না উঠুক, মাথা উঁচু করে বিদায় নেওয়ার মঞ্চ তৈরি করার এটাই শেষ সুযোগ।

প্রথম জনের বয়স ৩৫। দ্বিতীয় জনের ৩৭। কোনও দ্বিধা না রেখেই বলে দেওয়া যায়, এটাই তাঁদের শেষ সুযোগ। নিজের দেশে এখনও বন্দিত নন মেসি। কারণ একটাই। তাঁর ক্যাবিনেটে কোনও বিশ্বকাপ নেই। যাঁকে আর্জেন্টিনা ঈশ্বরের মতো পুজো করে, সেই প্রয়াত দিয়েগো মারাদোনা দেশকে একটি বিশ্বকাপে জিতিয়েছেন, একটির ফাইনালে তুলেছেন। মেসিও ফাইনালে তুলেছেন দেশকে। কিন্তু কাপ আর ঠোঁটের দূরত্ব থেকে গিয়েছে। সব পেয়েও কিছুই পাওয়া হয়নি। বেশ কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে মেসি বলেছিলেন, একটি বিশ্বকাপের বদলে তিনি সব বালঁ দ্যর ট্রফি দিয়ে দিতে রাজি। কতটা মরিয়া, এই সামান্য কথা থেকেই বোঝা গিয়েছিল। মেসি কিন্তু দেশকে কোপা আমেরিকা দিয়েছেন। ফাইনালিসিমা জিতেছেন। বিশ্বকাপটাই বাকি।

বিষয়টি উল্টো রোনাল্ডোর পর্তুগালের ক্ষেত্রে। তারা এক বারও বিশ্বকাপ জেতেনি। মেসির আর্জেন্টিনায় ফুটবল যতটা উন্মাদনা নিয়ে দেখা হয়, রোনাল্ডোর দেশে ততটা নয়। তার কারণ হয়তো একটাই, বিশ্বকাপে আহামরি কিছু কোনও দিনই করে দেখাতে পারেনি পর্তুগাল। তাদের শেষ বড় সাফল্য ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা, যে বার একার হাতে প্রয়াত ইউসেবিয়ো স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন গোটা দেশকে। তবে দেশের হয়ে রোনাল্ডোর সাফল্য খুব একটা কমও নয়। প্রথম বার ইউরো কাপ এবং নেশনস লিগ জিতিয়েছেন। দু’টি আন্তর্জাতিক ট্রফি আছে তাঁরও।

রোনাল্ডোর সঙ্গে মেসির সাক্ষাৎ দেশের হয়ে খুব কম বারই হয়েছে।

মনে করা হয়, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বালঁ দ্যর হল যে কোনও ফুটবলারের জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। হাতেগোনা ফুটবলারই এত দিন এই ট্রফি জিতেছেন। মার্কো ফান বাস্তেন, জোহান ক্রুয়েফ, মিশেল প্লাতিনিরা একাধিক বার এই পুরস্কার জিতেছেন। কিন্তু মেসি এবং রোনাল্ডো যে ভাবে এই পুরস্কারকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন, তা নজিরবিহীন। ২০০৮ থেকে ২০১৭, মাঝের এই কয়েক বছরে মেসি-রোনাল্ডোর বাইরে কেউ বালঁ দ্যর জেতেননি। এত দিন ধরে মাত্র দু’জন ফুটবলার গোটা বিশ্বকে শাসন করছেন, এমন ঘটনা অতীতে দেখা যায়নি।

ফুটবলে এই দু’জনের দাপট তুলনা করা যায় টেনিসের সঙ্গে। রজার ফেডেরার এবং রাফায়েল নাদালের অবিশ্বাস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবারই জানা। মেসি-রোনাল্ডোও সমগোত্রের। মেসি কিছুটা ফেডেরার ধাঁচের, যিনি ভরসা রাখেন শিল্পের উপরে। রোনাল্ডো আবার নাদাল, যার কাছে শিল্প কম, শারীরিক শক্তি বেশি। ব্যক্তিগত স্তরে ফেডেরার-নাদালের বন্ধুত্ব অবশ্য অতুলনীয়। ফেডেরারের শেষ ম্যাচে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখা গিয়েছে নাদালকে। রোনাল্ডোর অবসরের দিন মেসি, বা মেসির অবসরের দিন রোনাল্ডো এমন করবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু পরস্পরকে সমীহ, সম্ভ্রম রয়েছেই।

দু’জনের ব্যক্তিগত জীবন অবশ্য একে অপরের উল্টো। মেসি দীর্ঘ দিন প্রেম করে বিয়ে করেছেন ছোটবেলার বান্ধবীকে। তিন সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার। অন্যান্য কোনও নারীর সঙ্গে তাঁর নাম জড়ায়নি। চুলের স্টাইল, জামাকাপড়, কোনওটাই নজরকাড়া নয়। রোনাল্ডো সেখানে অনেক বেশি রঙিন। ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। একাধিক বার সঙ্গিনী বদলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগেও চুলের পরিচর্যা করতে ভোলেন না। গোল করলে কারওর সাহস নেই রোনাল্ডোর মাথার চুল ঘেঁটে দেওয়ার। তাঁর পোশাক গোটা বিশ্বের কাছে আদর্শ। তবে একটি ব্যাপারে মিল রয়েছে। দু’জনের কেউই রাজনীতি, কূটনীতিতে জড়াননি। বরাবর দুটোকে আলাদা রেখেছেন। সম্প্রতি দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারোর হয়ে প্রচার করেছিলেন নেমার। মেসি-রোনাল্ডো? ভাবাই যায় না।

স্পেনে ক্লাব ফুটবল খেলার সময় মেসি-রোনাল্ডো।

দুই ফুটবলারের উপর নির্ভর করে বিশ্বের অর্থনীতি। কে ভাল খেলছেন, কে খারাপ খেলছেন তার উপর শেয়ার বাজারের দর ওঠানামা করে। বিশ্বের নামীদামী সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর তাঁরা। একটা সামান্য ভুলচুক গোটা সংস্থার ভবিষ্যৎ ধসিয়ে দিতে পারে। তাঁরা যে ক্লাবে খেলেন, সেই ক্লাবের শেয়ার দর হয় আকাশচড়া। লাইন দিয়ে আসতে থাকে স্পনসর। মেসি-রোনাল্ডোকে দেখেই সেই ক্লাবকে ভালবাসতে শুরু করেন সাধারণ ফুটবলপ্রেমী। সে কারণেই নিজেদের ক্লাবে মেসি-রোনাল্ডোর প্রতিপত্তি হয় বেশি। না হলে মেসির বিরুদ্ধে মুখ খোলায় চাকরি খোয়াতে হয় বার্সেলোনার এক কর্মীকে?

তবে এ বার দু’জনেরই ফুটবল জীবনের সায়াহ্ন। ক্লাবস্তরের সেই প্রতিপত্তি কবেই গিয়েছে। মেসি এখন প্যারিস সঁ জরমঁর প্রধান ফুটবলার নন। ক্লাবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলায় রোনাল্ডোর তো ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে ভবিষ্যতই অনিশ্চিত। জীবনের শেষ পর্বে এসেও কোনও ফুটবলার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, এমনটা অতীতেও দেখা যায়নি। পেলে জীবনের সেরা ছন্দে থাকতে থাকতেই ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন। মারাদোনার ফুটবল জীবন শেষ হয়েছে কোকেন নিয়ে নির্বাসিত হয়ে এক বিষাক্ত অধ্যায়ের মাধ্যমে।

এখানেই মেসি-রোনাল্ডো আলাদা হতে পারেন। হয়ে উঠতে পারেন উদাহরণ। ফুটবলজীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বকাপ হাতে তোলার সৌভাগ্য সবার হয় না। মেসি-রোনাল্ডো পারবেন? উত্তর পাওয়া যাবে ১৮ ডিসেম্বর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.