বিশ্বকাপে টানা ন’টি ম্যাচে জয়। সব দলের বিরুদ্ধে দাপট। এ বারের বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার ভারতীয় দল এমন কাজ করে দেখিয়েছে, যা অতীতের কোনও দলই করে দেখাতে পারেনি। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং— ক্রিকেটের তিনটি বিভাগেই দক্ষতার শীর্ষে রয়েছেন ভারতের ক্রিকেটারেরা। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা উঠছে, এটাই কি ভারতের সর্বকালের সেরা এক দিনের দল?
প্রশ্নটিই এমন, যার পক্ষ এবং বিপক্ষ, দুটোতেই অজস্র মত থাকবে। কিন্তু রোহিতেরা যে ভাবে দাপট দেখিয়েছেন তাতে বিপক্ষের মত যে খুব একটা জোরালো হবে না তা বলেই দেওয়া যায়। কারণ, বিশ্বকাপে এমন দাপট অতীতের কোনও ভারতীয় দল দেখাতে পারেনি।
ভারতের সাফল্যের রসায়ন কী? এক বাক্যে যদি এর উত্তর দিতে হয়, তা হলে দলের একতার কথাই সবার আগে উঠে আসে। গোটা দল একটি সুতোয় গাঁথা রয়েছে। প্রত্যেকেই জানেন নিজের কাজটি ঠিক কী। ক্রিজে নেমে সেটা পালন করে আসছেন ধারাবাহিক ভাবে।
ওপেন করতে নেমে রোহিত এবং শুভমন গিল শুরুটা দারুণ করছে। পাওয়ার প্লে-র ফায়দা পুরোপুরি নেওয়ার চেষ্টা করছে ভারত। পাওয়ার প্লে-তে সর্বোচ্চ রান রবিবারই উঠেছে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। অতীতে ভারতের প্রবণতা ছিল পাওয়ার প্লে-র মধ্যে একাধিক উইকেট হারিয়ে ফেলা। এ বারের বিশ্বকাপে নিউ জ়িল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ বাদে মোটামুটি দাপটই দেখিয়েছে ভারত। রোহিত শুরুটাই করছেন আগ্রাসী ভাবে, যা তিনি আগেই বলেছিলেন। শুভমন কিছুটা থিতু হয়ে হাত খুলছেন।
বিরাট কোহলি প্রতি ম্যাচেই রান করছেন। এখন এ বারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান তাঁরই। চার নম্বর নিয়ে ভারতের যে দুর্বলতা গত দু’টি বিশ্বকাপে ছিল, তা-ও এবার মিটিয়ে দিয়েছেন শ্রেয়স আয়ার। ২০১১ বিশ্বকাপের যুবরাজ সিংহের পর এই প্রথম ভারতের চার নম্বর কোনও ব্যাটার এতটা ভরসা জোগাচ্ছেন। একটা পরিসংখ্যানে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। এই মুহূর্তে কোহলির রান ৫৯৪। ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর পরে রয়েছে রোহিত (৫০৩), শ্রেয়স (৪২১) এবং রাহুল (৩৪৭)। টপ অর্ডার যদি এ রকম ফর্মে থাকে তা হলে যে কোনও কোচেরই চিন্তা কমে যায়।
এ বার আসা যাক বোলিং বিভাগের দিকে। এখানেও গোটা দল এক হয়ে রয়েছে। পাঁচজন বোলারই একে অপরের পরিপূরক। এক জনের খারাপ দিন আরেক জন সেটা পুষিয়ে দিচ্ছেন। এক জন বোলার বিরাট সফল, আরেকজন ব্যর্থ এমনটা হচ্ছে না। ১৬টি উইকেট নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে সবার উপরে রয়েছেন মহম্মদ শামি। এর পর যশপ্রীত বুমরা এবং রবীন্দ্র জাডেজার ১৫টি করে উইকেট। কুলদীপ যাদবের ১৩টি এবং মহম্মদ সিরাজের ১১টি উইকেট রয়েছে। প্রথম ২৫ জনের মধ্যে ভারতের পাঁচ বোলারই রয়েছেন। এর মধ্যে জাডেজা আবার অলরাউন্ডার। তিনিও সুযোগ এলেই ব্যাট হাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছেন।
ভারতের রিজার্ভ বেঞ্চও কম শক্তিশালী নয়। হার্দিক পাণ্ড্যের মতো নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার পরেও দলের আত্মবিশ্বাস এত টুকু টলেনি। মহম্মদ শামি এসে পর পর তিনটি ম্যাচে ১৪টি উইকেট নিয়ে বাকিদের ছাপিয়ে গিয়েছেন। মাঝে সূর্যকুমার যাদব এসে শূন্যস্থান ভরাট করে দিয়েছেন।
ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার দীনেশ কার্তিক বলেই দিয়েছেন, “আমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে বলে দিতে পারি, এটাই এক দিনের ক্রিকেটে ভারতের সর্বকালের সেরা দল। বিশ্বকাপে তো বটেই। ২০২৩-এর যে দলটা গোটা বিশ্ব শাসন করছে, তা অতীতের কোনও দলই করে দেখাতে পারেনি। অতীতে সেরা দলগুলিকে এই দলের পাশে দাঁড় করিয়ে দিন। তার পরেও দেখবেন পারফরম্যান্স এবং চাপ সামলানোর বিচারে এই দল বাকিদের থেকে এগিয়ে রয়েছে।”
রোহিতের এই দলের কাছাকাছি যদি কোনও দল আসতে পারে, তা হলে ২০০৩ বিশ্বকাপের সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দল। জোহানেসবার্গে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে এসে তাদের টানা আট জয়ের দৌড় থেমে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেই অস্ট্রেলিয়া দল এতটাই শক্তিশালী ছিল যে প্রথম সারির ক্রিকেটারদের বাদ দিলেও অনায়াসে জিতে যেতে পারত। তখনকার পরিবেশও আলাদা ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পেস এবং বাউন্সি উইকেটে অস্ট্রেলিয়া বাদে বাকি দলদের হারানোও কম কৃতিত্বের নয় ঠিকই। সেই দলও সচিন, সৌরভ, রাহুল দ্রাবিড়দের মতো অভিজ্ঞদের পাশাপাশি বীরেন্দ্র সহবাগ, যুবরাজ সিংহ, হরভজন সিংহের মতো তরুণেরা ছিলেন।
তার পরে আসতে পারে ২০১১-য় মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দল। ঘরের মাঠে সে বার প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে খেলতে নেমেছিল দল। পাশাপাশি, দলের অন্দরে কিছু ঝামেলাও প্রকাশ্যে এসেছিল। কিন্তু ধোনির ঠাণ্ডা মাথা এবং ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিয়ে চলার ক্ষমতার কারণে ট্রফি ওঠে ভারতের হাতেই।
সেই জিনিস পরের দু’টি বিশ্বকাপে দেখা যায়নি। ২০১৫-ই হোক বা ২০১৯, সেমিফাইনালে উঠলেও ভারতের দলের মধ্যে সেই অপ্রতিরোধ্য ব্যাপারটা ছিল না যা সর্বকালের সেরা হয়ে উঠতে গেলে দরকার। ঠিক যে রকম প্রথম দু’টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। ছ’টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জিতেছিল তারা। সেই একমাত্র জয়টি ছিল পূর্ব আফ্রিকার বিরুদ্ধে!
তবে এত দূর পর্যন্ত এসেও একটা কথা না বললেই নয়, সর্বকালের সেরা দল কোনটি তার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে বিশ্বকাপ জয়। ২০২২ সালের আগে পর্যন্ত লিয়োনেল মেসিকে অনেকেই দিয়েগো মারাদোনার সঙ্গে তুলনা করতেই রাজি ছিলেন না। কারণ মারাদোনার একটা বিশ্বকাপ ছিল। মেসির ছিল না। সে যতই ফাইনালে উঠুন, যতই দাপট দেখান, সাফল্য তো আসে ট্রফিতেই। একটা বিশ্বকাপ জিতে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মেসি।
এই একই কারণে অনেকে ১৯৮৩ সালের কপিলদেবের দলকে এগিয়ে রাখতে পারেন। পর পর দু’টি বিশ্বকাপজয়ী, বিশ্বের ত্রাস সৃষ্টিকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ় দলকে হারানো কম বড় কথা ছিল না। তা-ও আবার দলের সেরা ব্যাটারের সঙ্গে অধিনায়কের ঝামেলা এবং আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও।
রোহিত শর্মা কি মেসি হতে পারবেন? রোহিত শর্মা কি কপিল দেব বা ধোনি হতে পারেন? উত্তর পাওয়ার জন্য গুণতে হবে আর ৬টা দিন।