তিনি আরও ‘বড় কিছু’র জন্য তৈরি হচ্ছেন। বলেছিলেন অপসারিত ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তখনও অবশ্য তিনি সিএবি-র সভাপতি পদে ভোট লড়ার কথা ঘোষণা করেননি। বিসিসিআই সভাপতির চেয়ে বাংলার ক্রিকেটের সর্বেসর্বা তো ‘আরও বড় কিছু’ নয়। তা হলে?
গত বৃহস্পতিবার সৌরভ জানিয়েছিলেন, বিসিসিআইয়ের মসনদ হারালেও জীবনে আরও ‘বড় কিছু’ করার লক্ষ্য তিনি নিয়ে ফেলেছেন। বলেছিলেন, ‘‘আমি ভারতের হয়ে খেলার পরে বাংলার ক্রিকেট সংস্থার সভাপতি হয়েছি। তার পরে সেখান থেকে বিসিসিআই সভাপতি হয়েছি। ভবিষ্যতে আরও বড় কিছু করব।’’
সৌরভ খোলসা না করলেও জনপ্রিয় ধারণা ছিল, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির পদ হারানোর পরে ‘বড় কিছু’ যদি থেকে থাকে, সেটি হল আইসিসি-র চেয়ারম্যানের পদ। সৌরভ সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন। কিন্তু সিএবি নির্বাচনে তাঁর লড়ার ঘোষণা আবার যাবতীয় হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে।
আবার দেয়ওনি। রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার ভোটে মনোনয়ন পেশের দিন ২২ অক্টোবর। আইসিসির ভোটের জন্য ১৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার। সিএবি নির্বাচনের চার দিন আগে। সিএবি ভোটের ফলপ্রকাশ ৩১ অক্টোবর। আইসিসির ১১ নভেম্বর। এই সময়প্রবাহ নজরে রেখেই দেশের ক্রিকেট রাজনীতি সম্পর্কে খবর রাখার দাবিদারেরা বলছেন, গত শনিবার সিএবি ভোটে লড়ার কথা ঘোষণা করলেও সৌরভ নাকি এখনও আইসিসির আশা ছাড়েননি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে তিনি না কি এই ব্যাপারে কথাবার্তা বলছেন। আচমকা তাঁর মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা সেই সম্ভাবনায় আরও জলবাতাস দিয়েছে। বলা হচ্ছে, সৌরভ সর্বোচ্চ স্তরে আলাপ-আলোচনাও শুরু করেছেন। অনেকেরই ধারণা, আইসিসি-র চেয়ারম্যানের পদের দিকে লক্ষ্য রেখেই সৌরভ ‘বড় লক্ষ্য’-এর কথা বলেছিলেন। বাংলা এবং বাঙালির বড় একটা অংশ এখনও সেই সম্ভাবনায় মশগুল। বিশেষত, বাংলার ক্রীড়া সাংবাদিকতা জগতের একটা অংশ। জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যম সৌরভের আইসিসি-র পদপ্রাপ্তি নিয়ে ততটা আশাবাদী নয়।
যেমন জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক মহলও সৌরভের আইসিসি-তে যাওয়ার সম্ভাবনাকে আদৌ আমল দিতে রাজি নয়। সর্বভারতীয় স্তরে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বিরাট অলৌকিক কিছু না-ঘটলে সৌরভের আইসিসি-তে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। রাজনীতি তেমনই বলছে। বস্তুত, বিজেপির জাতীয় স্তরের এক নেতার বক্তব্য, তারকা ক্রিকেটারদের নিয়ে তাঁদের বার বার ভুগতে হয়েছে। একাধিক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি। কপিল দেবের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য এবং পরবর্তী কালে রাজনীতিবিদ কীর্তি আজাদ তার উদাহরণ। যিনি ঘটনাচক্রে কিছু দিন আগে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
বিজেপির বড় অংশের বক্তব্য, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে সৌরভের কোনও সমর্থন নেই। এক জনকেও পাওয়া যাবে না, যিনি সৌরভের হয়ে গলা ফাটাবেন। কেন্দ্রের শাসকদলের বক্তব্য, বোর্ড সভাপতি সৌরভকে বরং বেশি করে মনে রাখা হবে বিরাট কোহলীর সঙ্গে প্রকাশ্যে ‘অবাঞ্ছিত এবং অপ্রীতিকর’ পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে।
কেন্দ্রের শাসকদল আরও মনে করে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাত ধরে সৌরভ শেষ মুহূর্তে ব্রিজেশ পটেলকে ছিটকে দিয়ে বিসিসিআই সভাপতি হয়েছিলেন। ‘বিনিময়ে’ যে বিজেপি কিছু চেয়েছিল, তা বুঝতে বিশাল বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন হয় না। যা সম্প্রতি সৌরভের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বঙ্গজ সাংবাদিকের লেখায় ঘুরেফিরে আসছে। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিচ্ছেন, সেই বিনিময়মূল্য ছিল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে ‘বিজেপির মুখ’ হওয়া। কিন্তু সৌরভ তা হননি। তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, সৌরভ কখনওই তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি। আবার অন্য একাংশের দাবি, সৌরভ রাজি হয়েও শাহকে ‘ঘুরিয়েছেন’। যা সাম্প্রতিক কালে করতে গোটা দেশের যে কেউ একাধিক বার ভাববেন।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তাঁর বেহালার বাড়িতে শাহ সদলে নৈশভোজ সেরে যাওয়ার পরেই সৌরভ বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের দাপুটে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। যা গেরুয়া শিবির ভাল ভাবে নেয়নি। বস্তুত, তারা মনে করেছিল, ওই ঘটনায় শাহের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লেগেছিল!
সেই প্রেক্ষিতে সৌরভের পক্ষে আইসিসি-র চেয়ারম্যান পদের মতো ‘বড় লক্ষ্য’ হাসিল করা যথেষ্ট কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ প্রথমত, এ জন্য তাঁকে নানা রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। বিনিময়ে তাঁকেও কিছু দিতে হবে। একটি মহলের বক্তব্য, এ নিয়ে নাকি আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে তার কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন কোনও তরফে মেলেনি। কিন্তু প্রথম মহলের বক্তব্য সঠিক হলে সৌরভকে এ বার তার ‘মূল্য’ দিতে হবে। লাখ টাকার প্রশ্ন হল— তিনি কি তাতে রাজি থাকবেন?
বোর্ডের সভাপতি পদ থেকে সরানোর পর সৌরভকে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মারফত আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সৌরভ তা পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করেন। জানিয়ে দেন, তিনি যে বোর্ডের সভাপতি, তার একটি সাব কমিটির চেয়ারম্যান হতে তিনি রাজি নন। বিজেপির একটি অংশের মতে, হিমন্তের মতো বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বের ‘বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন’ নেতাকে দিয়ে ওই প্রস্তাব দেওয়ানোর অর্থ, বিজেপি এখনও সৌরভের জন্য দরজা খোলা রাখতে চায়। আবার অন্য একাংশের মতে, ওই প্রস্তাব দিয়ে সৌরভকে আরও ‘বিড়ম্বিত’ করার চেষ্টা হয়েছিল। সৌরভ গুগলিটা সঠিক পড়েছেন এবং ব্যাট-প্যাড বাড়িয়ে সেটির মোকাবিলা করেছেন।
যদিও বাংলা সংবাদমাধ্যমের একাংশ এখনও মনে করছে যে, শেষ মুহূর্তে সৌরভ খেলা ঘুরিয়ে দেবেন। যেমন দিয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে। তার মধ্যেই সৌরভ নিজে ঘোষণা করেছেন, তিনি সিএবি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন। যা থেকে সৌরভ-ঘনিষ্ঠদের ধারণা, প্রাক্তন বোর্ড সভাপতি এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, তিনি লড়াই ছাড়ছেন না। কোনও না কোনও ভূমিকায় তিনি ক্রিকেট প্রশাসনে থেকে যাবেন। আবার অন্য একাংশের বক্তব্য, আইসিসির আশা এখনও ছাড়েননি সৌরভ। সেই মর্মে আলাপ-আলোচনাও চালাচ্ছেন। কিন্তু ‘হাতের পাঁচ’ সিএবি-টা করে রাখলেন। বঙ্গীয় ক্রীড়া সংবাদমাধ্যমের একাংশ এখনও মনে করছে, শেষ মুহূর্তে সৌরভ খেলা ঘুরিয়ে দেবেন। যেমন দিয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে। এই অংশের দাবি, সিএবি নির্বাচনটা আসলে ‘ডামি’। সৌরভ তার আবডালে ‘বড় লক্ষ্য’ই রেখেছেন। আবার ওই অংশের মধ্যেও একটি গোষ্ঠীর বক্তব্য, আইসিসি হবে না বুঝেই রাজ্য সংস্থার ক্রিকেট প্রশাসকের রাস্তাও খোলা রেখেছেন সৌরভ। অনেকের মতে, সেটি দিল্লিকে সৌরভের ‘বার্তা’। যে ঘোড়া থেকে ফেলে দেওয়া হলেও তিনি ধরাশায়ী থাকছেন না। আবার অন্য একাংশের মতে, সিএবি নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা আইসিসির আশা নেই বুঝেই।
সূত্রের খবর, সিএবি নিয়ে তিনি আগেই নবান্নের সঙ্গে আলোচনা সেরে রেখেছেন। রাজ্য সরকার যদিও এখনও পর্যন্ত ‘সক্রিয়’ ভাবে সিএবি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নবান্নের ১৪ তলার আশীর্বাদ যে প্রয়োজন, তা সব পক্ষই জানে। প্রসঙ্গত, এক মাস আগে রেড রোডে দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানের শেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়িতে উঠে তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে গিয়েছিলেন সৌরভ। প্রায় দেড় ঘণ্টা সেখানে ছিলেন তিনি। অনেকের দাবি, সেই সময়েই সিএবি সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছে। কারণ, বোর্ড সভাপতি পদে তাঁকে যে দ্বিতীয় ‘টার্ম’ দেওয়া হচ্ছে না, তা সৌরভের কাছে তত দিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, অনেকেই মনে করছেন, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত এবং কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরকে অগ্রাহ্য করে দেশের ফুটবল প্রশাসনের মহাকর্তা হিসেবে প্রাক্তন ফুটবলার কল্যাণ চৌবেকে বেছে নিয়ে বিজেপি এই বার্তাও দিতে চাইছে যে, তাদের কাছে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবল বেশি ‘প্রাসঙ্গিক’। তাঁদের মতে, ক্রিকেট প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ থেকে এক বাঙালির বিদায় এবং ফুটবল প্রশাসনের শীর্ষ পদে এক বাঙালির আগমনের ফলে এটা স্পষ্ট যে, দিল্লি সৌরভকে নিয়ে আর বিশেষ কিছু ভাবছে না।
কিন্তু তবুও সৌরভকে নিয়ে এত জল্পনা কেন? কারণ, সর্বভারতীয় স্তরে বাঙালির আর কোনও ‘গ্রহণযোগ্য’ মুখ নেই। সৌরভ ছাড়া যিনি আছেন, তিনি মমতা। বামপন্থীরা অনেক আগেই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। জ্যোতি বসুর পরে সর্বভারতীয় স্তরে আর কোনও বাঙালি বামপন্থী নেতাকে দেখা যায়নি সেখানে রাজনৈতিক অভিঘাত তৈরি করতে। অনেকে অবশ্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেন। প্রথম জন লোকসভার স্পিকার হয়েছিলেন। দ্বিতীয় জন রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু বাঙালি বলতে সর্বভারতীয় স্তরে ‘গ্রহণযোগ্য মুখ’ একমাত্র সৌরভ। কলকাতার এক শিল্পোদ্যোগী যেমন সৌরভকে দিয়ে তাঁর পণ্যের বিজ্ঞাপন করিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা অনেককে দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছি। একমাত্র সৌরভের নামই বিক্রি হয়! আমাদের অনেক সময় বিভিন্ন কারণে বিনোদন জগতের লোকজনকে ব্যবহার করতে হয় ঠিকই। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছু হয় না।’’ সে অর্থে বলতে গেলে ব্যবসাও তো সমাজেরই অঙ্গ। ফলে সামগ্রিক ভাবে বাঙালি সমাজও সৌরভেই আলোড়িত থাকে। তারা মনে করে, সৌরভই একমাত্র বাঙালি, যিনি জাতীয় স্তরে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। সেই কারণেই বিজেপিও তাঁকে নিয়ে ‘আগ্রহী’ হয়েছিল।
তবে একই সঙ্গে জাতীয় স্তরে বাঙালি হিসেবে একমাত্র সৌরভের এই ‘গ্রহণযোগ্যতা’ সামগ্রিক ভাবে বাঙালি জাতিকে নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা, বাণিজ্য এমনকি, খেলাধুলো— সমস্ত ক্ষেত্রেই বাঙালি এখন পিছনের সারিতে। তাই সৌরভ আরও বেশি ঝলমল করছেন। তাই তাঁকে নিয়ে যত কল্পনা, তত জল্পনা!