Allyson Felix: তাঁর কীর্তির সামনে ম্লান বোল্টও, বিশ্বমঞ্চে ৩০ পদক জিতে বিদায় অ্যালিসন ফেলিক্সের

সব রূপকথা চিত্রনাট্য মেনে শেষ হয় না। তাই দু’দশকব্যাপী অ্যাথলেটিক্স জীবনের শেষ রেসে তাঁর গলায় সোনা নয়, ঝুলল ব্রোঞ্জের পদক। আমেরিকায় চলা বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের ৪x৪০০ মিটার মিক্সড রিলে রেসে আমেরিকাকে চমকে দিয়ে সোনা জিতে নিল ডোমিনিকান রিপাবলিক। শেষ পর্যায়ে অসাধারণ দৌড়ে রুপো পেল নেদারল্যান্ডস। আমেরিকা তৃতীয়। তবু ওরেগনের হেওয়ার্ড ফিল্ড ছাড়ার সময় দর্শকদের মুখে শুধু তাঁরই নাম।

অ্যালিসন ফেলিক্স। পদকসংখ্যা এবং কৃতিত্বের বিচারে অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ক্রীড়াবিদ। শনিবার রেসে দৌড়নোর পর তাঁর পকেটে ৩০টি পদক। এর মধ্যে অলিম্পিক্সে পেয়েছেন ১১টি, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯টি। ২০০৪ সালের আথেন্স অলিম্পিক্সে ২০০ মিটারে রুপো জয় দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা শেষ হল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতে। তুলনা করতে বসলে দেখা যাচ্ছে, ফেলিক্সের পরে রয়েছেন মার্লিন ওটি, যিনি জিতেছেন ২৩টি পদক। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের দ্রুততম মানব উসেইন বোল্টের পকেটে রয়েছে ২১টি পদক।

ফেলিক্সকে অনায়াসে বসানো যায় রাফায়েল নাদাল, রজার ফেডেরার, সেরিনা উইলিয়ামস, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বা টাইগার উডসের দলে। নিজেদের খেলায় এঁরা প্রত্যেকেই সসম্মানে বিরাজমান। প্রত্যেকেই নিজেদের এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, যা ছোঁয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্বপ্নের মনে হবে। তার একটা বড় কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে এঁরা নিজেদের সাফল্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে টিকিয়ে রেখেছেন। পরিস্থিতি যা-ই হোক, তাঁদের পারফরম্যান্সের রেখচিত্র কখনও নামেনি। হ্যাঁ, এঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময় খেলা থেকে দূরে ছিলেন। কাউকে চোট-আঘাত ভুগিয়েছে। কেউ আবার মাঠের বাইরে বিতর্কে জড়িয়েছেন। তবে মাঠে নামলে নিজেদের সেরাটা দিয়েছেন।

ফেলিক্সের কথাই বলা যাক। বর্ণময়, সফল কেরিয়ার থাকা সত্ত্বেও মাঠের বাইরে প্রচুর লড়াই লড়তে হয়েছে তাঁকে। ২০১৮ সালে তিনি সন্তানসম্ভবা থাকার সময় বেঁকে বসে তাঁর স্পনসর এক বিখ্যাত ক্রীড়াসরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থা। তাঁর চুক্তি রাতারাতি ৭০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। যখন ফেলিক্স জানতে পারেন মাতৃত্বের সময় তাঁকে কোনও ভাবে সাহায্য করা হবে না, তখন অন্য লড়াই শুরু হয়। ফেলিক্স একটি অলাভজনক সংস্থা তৈরি করেন, যাঁরা বিশ্বের সমস্ত ক্রীড়াবিদ, কোচ এবং সাপোর্ট স্টাফকে মাতৃত্বকালীন সাহায্য করবে। পাশাপাশি তৈরি করেন একটি কোম্পানি, যারা শুধু মহিলা ক্রীড়াবিদদের জন্য জুতো তৈরি করবে। শুধু তাই নয়, এক মানবাধিকার সংগঠনের হয়ে আফ্রিকার রোয়ান্ডা, উগান্ডা এবং প্যালেস্টাইনের মতো দেশে গিয়ে সেখানকার তরুণদের খেলাধুলোয় উৎসাহিত করেছেন।

শেষ রেসের পর বললেন, “গত দুটো বছর আমার জীবন, দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা এবং পদকের বাইরেও যে একটা জীবন রয়েছে, সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। কোনও দিন ভাবিনি এ রকম একটা দিকে জীবন আমাকে ঠেলে নিয়ে যাবে। এ বার থেকে মহিলা এবং মা হওয়া ক্রীড়াবিদদের সাহায্য করাই আমার মূল উদ্দেশ্য। জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।”

ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে ১৯৮৫ সালের ১৮ নভেম্বর জন্ম ফেলিক্সের। শারীরিক গড়নের কারণে ছোটবেলায় সহপাঠীরা তাঁকে ডাকত ‘চিকেন্স লেগ’ বলে। পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি উচ্চতা এবং ভারী গড়নের ফেলিক্সের পাগুলি ছিল সরু। অনেকটা ‘মুরগির ঠ্যাং’য়ের মতোই। ফেলিক্সকে রাগানোর জন্য ওই নামে ডাকলেও সহপাঠীরা জানতেন, ওই সরু পায়ের কত জোর! জিমে পরিশ্রম করে ভারী ভারী ওজন তুলতে তাঁর জুড়ি ছিল না। হাইস্কুল স্প্রিন্ট কোচ জোনাথন প্যাটনের পরামর্শেই দৌড়ে আসা। নবম গ্রেডে পড়ার সময় ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট মিটে অংশগ্রহণ। পরে সেই মিটে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হন। ২০০১-এ জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক পদক পান। কয়েক মাস পরেই মেক্সিকো সিটিতে ৫০ হাজার দর্শকের সামনে ২২.১১ সেকেন্ডে ২০০ মিটার দৌড়ন। জুনিয়র পর্যায়ে যা ছিল ইতিহাসের দ্রুততম দৌড়। তবে সেই প্রতিযোগিতায় ডোপ পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলে রেকর্ডবইয়ে তা ঠাঁই পায়নি।

২০০৩-এ প্যারিসে প্রথম বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নামা। ২০০ মিটারে ষষ্ঠ হন। পরের বছর অলিম্পিক্স। প্রথম প্রয়াসেই পদক। ২০০ মিটারে রুপো পান। ২০০৫-এর হেলসিঙ্কি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে কনিষ্ঠতমা হিসাবে ২০০ মিটারে সোনা জেতেন। দু’বছর পর ওসাকায় দ্বিতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসাবে একটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তিনটি সোনা জেতেন। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সে তিনটি সোনা জেতেন তিনি। ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারের পর আমেরিকার প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসাবে এই কৃতিত্ব গড়েন।

২০১৮-য় অন্তঃসত্ত্বা হন। চোট ছাড়া দীর্ঘ ক্রীড়াজীবনে সেই প্রথম কোনও কারণে বিরতি নেওয়া। মাঠের বাইরে স্পনসরের বিরুদ্ধে তো লড়তে হচ্ছিলই। শারীরিক ভাবেও তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁর প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া ধরা পড়ে, যা অ্যাফ্রো-আমেরিকান মহিলাদের মধ্যে খুবই স্বাভাবিক। হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সন্তানও। ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হন ফেলিক্স। তার পরেই আমেরিকার স্টেট হাউস কমিটিতে বিস্ফোরক অভিযোগ আনেন তিনি। সাফ বলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে আমেরিকার হাসপাতালগুলিতে যথাযথ মাতৃত্বকালীন পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে না। তাঁদের শারীরিক উপসর্গকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। অভিযোগ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

পরের বছরই আমেরিকার ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ সংবাদপত্রে কলামে সমালোচনা করেন ক্রীড়া সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থার। সে বছরই ওই সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন। মাতৃত্বের পর প্রথম প্রতিযোগিতায় নামাও ২০১৯-এই। ব্যক্তিগত ৪০০ মিটার ইভেন্টে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। তবে মিক্সড রিলে-তে প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১৩তম সোনা জিতে টপকে যান বোল্টকে। মাথায় ছিল টোকিয়ো অলিম্পিক্স। শেষ বার অলিম্পিক্সের মঞ্চে নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন। কোভিডের কারণে যখন গোটা বিশ্ব থমকে, তখন রাস্তায়, ফাঁকা ফুটবল মাঠে, সমুদ্রসৈকতে দৌড়ে নিজেকে ফিট রেখেছিলেন। হতাশ হতে হয়নি। ৪০০ মিটারে ব্রোঞ্জ জেতা ছাড়াও ৪x১০০ মিটার এবং ৪x৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জেতেন। অলিম্পিক্সে ১১টি পদক জিতে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ক্রীড়াবিদ হয়ে যান।

ফেলিক্সের সম্পর্কে বাংলার অ্যাথলেটিক্স কোচ কুন্তল রায় বললেন, “এক কথায় কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ। এত বছর ধরে দাপট দেখিয়েছে। অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব। ওর মতো এত দিন ধরে বোল্টও দৌড়তে পারেনি। ছোটবেলা থেকে খেলেছে ফেলিক্স। গোটা বিশ্বের সমস্ত ক্রীড়াবিদদের কাছে আদর্শ উদাহরণ। এখনকার দিনে অনেক ক্রীড়াবিদই খুব কম সময়ের জন্য আসে। তারা ফেলিক্সকে দেখে শিখতে পারে।”

কুন্তলের সংযোজন, “মা হওয়ার পর যে কোনও খেলাতেই ফিরে আসা প্রচণ্ড কঠিন। শারীরিক পরিবর্তন হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে। সে সব কাটিয়ে ফেলিক্স শুধু প্রত্যাবর্তনই করেনি, বিশ্বমঞ্চে পদকও জিতে নিল। এমন ক্রীড়াবিদকে নিয়ে কে না গর্বিত হবে! কুর্নিশ করি ওর অ্যাথলিটজীবনকে।”


শনিবার মিক্সড রিলে শেষ হওয়ার পর যখন গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে তাঁর নাম, ফেলিক্স হাসছিলেন। একে একে নিজের সতীর্থদের জড়িয়ে ধরলেন। তার পর আইএএএফ প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান কো-র থেকে পদক নিলেন। গ্যালারি থেকে মা-কে দেখছিল তিন বছরের ক্যামরিন। পদক নিয়ে বললেন, “দেশের মানুষের সামনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পদক জেতা বরাবরের স্বপ্ন ছিল। জীবনের শেষ রেসে তা অবশেষে পূর্ণ হল। হয়তো জীবনের সেরা ছন্দে আমি নেই। কিন্তু ক্যামরিনের সামনে দৌড়নো, ওর সঙ্গে এই মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া, এই অনুভূতি অবর্ণনীয়।”

যার জন্যে এত লড়াই, সেই ক্যামরিন মায়ের পদকের সময় সঙ্গে নেই কেন? হাসতে হাসতে ফেলিক্সের উত্তর, “আরে, ও তো আইসক্রিম খেতে গিয়েছে। মাত্র তিন বছর বয়স। জীবনটা পুরোপুরি উপভোগ করে নিক।”

না বলেও কি ফেলিক্স তা হলে আগামীর ফেলিক্স তৈরির ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.