১৩ বছরে গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে ওঠা হয়নি, খেলা বদলের খেলায় মেতেছেন ছ’মাসের মা সোয়াইতোলিনা

ছ’মাস আগে মা হয়েছেন। তিন মাস আগে ফিরেছেন প্রতিযোগিতামূলক টেনিসে। উইম্বলডন খেলছেন ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে। ইউক্রেনের সেই এলিনা সোয়াইতোলিনা উইম্বলডনে চমকে দিলেন টেনিসপ্রেমীদের। চমকে দিলেন শীর্ষ বাছাই ইগা শিয়নটেককেও। মহিলাদের সিঙ্গলসের কোয়ার্টার ফাইনালে পোল্যান্ডের খেলোয়াড়কে হারিয়ে দিলেন ৭-৫, ৬-৭ (৫-৭), ৬-২ গেমে।

সোয়াইতোলিনার লড়াইটা টেনিস কোর্টের বাইরেও। ফরাসি ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে বেলারুশের এরিনা সাবালেঙ্কার কাছে হারার পর হাত মেলাননি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোর সঙ্গে ছিল বেলারুশ। ম্যাচের পর নিজের দেশে সামরিক হানার নীরব প্রতিবাদ করেছিলেন ইউক্রেনের সোয়াইতোলিনা। সমালোচিত হয়েছিলেন। উইম্বলডন খেলতে এসে অবশ্য প্রথম থেকে সমর্থনই পেয়েছেন তিনি। ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে বছরের তৃতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলতে আসা ২৮ বছরের খেলোয়াড়ের মন পড়ে রয়েছে দেশে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউক্রেনে রয়েছে তাঁর পরিবার। প্রতি দিন সকালে উঠে প্রথম কাজ পরিবারের সকলের খবর নেওয়া। বাড়ির কথা না জানতে পারলে বাকি অনুশীলন বা ম্যাচে মন দিতে পারেন না।

মানসিক চাপ নিয়েই উইম্বলডন খেলছেন। কোর্টে অবশ্য সেই চাপ ছাপ ফেলতে পারছে না। ভিনাস উইলিয়ামসকে প্রথম রাউন্ডে ৬-৪, ৬-৩ গেমে হারিয়ে শুরু করেছিলেন যাত্রা। সেখানে বাধা হতে পারলেন না শিয়নটেকও। গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব নেই সোয়াইতোলিনার ঝুলিতে। নেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতাও। সেরা ফল ২০১৯ সালে উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেনের শেষ চারে পৌঁছানো। এ বার কি পারবেন সেই বাধা পেরোতে? উত্তর দেবে সময়। অধুনা লন্ডনের বাসিন্দার শক্তি ব্যাকহ্যান্ড শট। আর লড়ে যাওয়ার অদম্য মানসিকতা। বিশ্বের প্রাক্তন ৩ নম্বর বাছাইয়ের সামনে ইউক্রেনের টেনিসকে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে এ বার। শিয়নটেককে হারিয়ে উঠে মেনে নিলেন সে কথা। চেষ্টা করবেন খেতাব জিততে।

১৭টি সিঙ্গলস খেতাব রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। এই পরিসংখ্যান মোটেও টেনিস বিশ্বের কুলীণসুলভ নয়। যদিও খেলা তাঁর রক্তে। সোয়াইতোলিনার বাবা ছিলেন কুস্তিগির। মা রোয়ার। ক্রীড়াবিদ বাবা-মার মেয়ে সোয়াইতোলিনা পাঁচ বছর বয়সে বেছে নিয়েছিলেন টেনিস। তাঁর দাদা টেনিস খেলতেন। তাঁকে দেখেই টেনিসের প্রতি আকর্ষণ। দাদা টেনিস চালিয়ে যেতে পারেননি। সোয়াইতোলিনা কিন্তু হাল ছাড়েননি। বাড়িতে খেলাধুলার পরিবেশ থাকায় তাঁর ইচ্ছায় বাধা হয়নি পরিবারও।

সোয়াইতোলিনাকে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইউক্রেনের প্রতিনিধিত্ব করার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না। দেশই তাঁর কাছে আগে। তাই সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে শত্রু দেশের প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত না মেলানো নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই তাঁর। বরং প্রতিবাদ করতে পেরে তিনি খুশি।

জুনিয়র পর্যায়ে ফরাসি ওপেন জিতেছেন। উইম্বলডন ফাইনাল খেলেছেন। রিয়ো অলিম্পিক্সের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছেন। ২০১০ থেকে পেশাদার টেনিস খেললেও সোয়াইতোলিনার ১৩ বছরের টেনিসজীবন ততটা ঝকঝকে নয়। তবু মঙ্গলবার শিয়নটেককে হারিয়ে নজর কেড়ে নিয়েছেন তিনি। রাশিয়া-ইউক্রেন লড়াইয়ে শিয়নটেক ইউক্রেনের সমর্থক। তাঁর টুপিতেও রয়েছে ইউক্রেনের পতাকা। তবু কোর্টের লড়াইয়ে সোয়াইতোলিনা ছাড় দিলেন না শীর্ষ বাছাইকে। উইম্বলডন কোয়ার্টার ফাইনালে অবাছাই সোয়াইতোলিনা ভুল করলেন বেশ কিছু। তার থেকেও বেশি প্রতিপক্ষের ভুলের ফায়দা তুললেন। ব্রেক পয়েন্ট কাজে লাগালেন। প্রথম সেট জেতার পরেও আত্মতুষ্টিতে ভোগেননি। জানতেন, সুযোগ পেলেই শিয়নটেক অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারেন। তাই গোটা ম্যাচে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখলেন। বিনা লড়াইয়ে এক পয়েন্টও দিলেন না। ম্যাচের প্রথম গেমে শিয়নটেক তাঁর সার্ভিস ভাঙলেও পাল্টা প্রত্যাঘাত করেছেন। শেষ পর্যন্ত এ বারের উইম্বলডন থেকে ছুটি করে দিয়েছেন শীর্ষ বাছাইয়ের।

মা হওয়ার মাত্র ছ’মাসের মধ্যে গ্র্যান্ড স্ল্যামের শেষ চারে সোয়াইতোলিনা। টেনিসজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি আগের থেকে বেশি ধারালো। আরও বেশি তীক্ষ্ণ। আরও বেশি একাগ্র। আরও বেশি ধৈর্য্যশীল। আরও বেশি লড়াকু। আরও বেশি শক্তিশালী। সোয়াইতোলিনা চান নিজের টেনিসজীবনের রেখা চিত্র বদলাতে। যে বদলের খেলা তিনি শুরু করেছেন পাঁচ বারের ভিনাসকে হারিয়ে। যে বদলের খেলায় হারতে হল শিয়নটেককেও। সন্তানের জন্ম দেওয়ার ছ’মাস পর নিজের খেলাকে নব জন্ম দিচ্ছেন বিশ্বের ৭৮ নম্বর খেলোয়াড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.