বাম-উদারতাবাদীদের সাথে সঠিক মোকাবিলার জন্য রোমিলা থাপারকে লিখিত সীতা রাম গোয়েল-এর পত্রটি একটি আদর্শ নমুনাঃ একটি ভূমিকা

বাম-উদারতাবাদীদের বিষয়ে প্রথমে যেটি বলা যায় তা হল তারা প্রকৃতপক্ষে নিগ্রহকারী এবং যখন কেউ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তখন তারা নিজেদেরকে অলৌকিকভাবে ‘আক্রান্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। একজিন নিগ্রহিকারীর সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল তার মধ্যে আদব-কায়দা ও ভদ্রতার অনুপস্থিতি। এমনকি রাম ‘সুগন্ধি’ গুহ, (প্রয়াত) গিরিশ কারনাড, (প্রয়াত) ইউ আর অনন্ত মূর্তি, টি এম কৃষ্ণার ন্যায় লেখকদের রচনার সংক্ষিপ্ত পাঠ উক্ত বক্তব্যকে পরিস্ফুট করে। বলা বাহুল্য যে, তারা সকলে এই শিক্ষা লাভ করেছিলেন নিগ্রহকারীদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নবাব নেহেরু-র থেকে। এক ধূর্ত রাজনীতিবিদ হিসেবে নেহেরুর রাজনৈতিক জীবনের স্বল্প জ্ঞাত বিষয় হল যে যখন তিনি চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন হতেন তখন তিনি সাময়িকভাবে পিছু হটে যেতেন এবং পর্দার আড়ালে গিয়ে প্রতিপক্ষকে মধুময় ভাষা শোভিত পত্র মারফৎ প্রতিপক্ষকে তোষণ করতেন যাতে প্রতিপক্ষ তাকে অব্যাহতি প্রদান করে। সেই সময়টা ছিল যদিও অন্যরকম এবং নেহেরূ শঠতার দ্বারা নিষ্কৃতি লাভ করতেন। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী ও নিজ রাজনৈতিক দলের সর্বময় কর্তা হিসেবে তার অবিসংবাদী কর্তৃত্বের চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন না হওয়া সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তখন তিনি তার বিষদাঁত বের করতেন এবং একই প্রতিপক্ষকে একজন মধ্যযুগীয় সুলতানের ন্যায় হিংস্রতার সাথে নিঃশেষ করতেন।

     ঠিক একই প্রবণতা নেহেরুবাদী ইতিহাস প্রতিষ্ঠান জারীনা রোমিলা থাপারের নেতৃত্বে অনুসরন করে। নবাব নেহেরুর ন্যায় তার দল কমিউনিস্ট ভাবধারার সাথে একাত্ম হতে অনিচ্ছুক সকল গবেষক ও ঐতিহাসিকদের হয় নির্বাসিত করেছে অথবা তাদের শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে দিয়েছে। তবুও এমন অনেক অকুতোভয় ব্যক্তিবর্গ ছিলেন যারা এই ভন্ড রাজনৈতিক ও ভন্ড বাম ঐতিহাসিকদের তর্জন-গর্জনের পরোয়া না করে এই সকল ভন্ড রাজনৈতিক ও ভন্ড বাম ঐতিহাসিকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে অদমনীয় চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী যেমন তামিলনাড়ুতে কখওনই একটি কংগ্রেস সরকার গঠিত হবে না তা নিশ্চিত করেছিলেন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সীতা রাম গোয়েল, অরুন শৌরি, কোয়েনার্ড ইলস্ট, ডেভিড র্ফালে এবং মীণাক্ষী জৈন-এর ন্যায় অদম্য ঐতিহাসিকেরা ব্যক্তিগত ক্ষতির সন্মুখীন হয়েও সামনে থেকে লড়াই করেছিলেন। এই লড়াইয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছিল কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, বিপাণ চন্দ্র ও ডি এন ঝা-র ন্যায় নামগুলি বর্তমানে যথার্থভাবে গালিগালাজের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

     উক্ত অদম্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে সীতা রাম গোয়েল ছিলেন প্রধান যোদ্ধা। তিনি মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের সন্মোধনে “ভন্ড” শব্দটি ব্যবহার করলেও ইহাকে আভিধানিক অর্থে অর্থাৎ ‘এক বিশেষ জ্ঞান বা গুণের মিথ্যা দাবিদার এক ব্যক্তি’ হিসেবে প্রয়োগ করেননি, বরং তিনি সহজভাবে ‘ভন্ডামি’ কথাটির মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত মডেলে প্রদান করেছেনঃ

১) তাদেরকে আঘাত না করা,

২) মাথা উঁচু করে তাদেরকে মোকাবিলা করা,

৩) স্বাধীনভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখা,

৪) যখন তারা তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতে শুরু করে তখন তারা অস্বস্তি পড়তে শুরু করে ও 

   নিজেদের বক্তব্যের জায়গাটি হারাতে থাকে,

৫) শেষ পর্যায়ে তারা আক্রান্ত হওয়ার নাটক শুরু করে।

    সাম্প্রতিক ইতিহাস উক্ত সকল বৈশিষ্ট্যগুলিকে বাস্তবিকভাবে সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে।

    ১৯৯১ সালে রোমিলা থাপারকে লেখা সীতা রাম গোয়েলের একটি চিঠি উক্ত মডেলের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে যে দৃষ্টান্ত গোয়েলের রচনাতেও অসংখ্য। এই পত্রে রোমিলা থাপার ও তার অনুগামী ঐতিহাসিকদের তিনি তীব্র ধিক্কার জানিয়েছিলেন যারা দাবি করেছিল যে মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকেরা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেনি ও হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেনি ইত্যাদি। গোয়েলের এই পত্রটি দৃঢ ঐতিহাসিক গবেষণা, সত্যের প্রতি একনিষ্ঠতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিযুক্ত এক প্রবল প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় অকুতোভয়তার একটি দৃষ্টান্তমূলক মেলবন্ধন।

    বস্তুত এখানে গোয়েলের অবিস্মরনীয় কীর্তি দু’খন্ডে রচিত ‘Hindu Temples: What Happened to Them’ শীর্ষক গ্রন্থের সংযোজিত অংশে অন্তর্ভুক্ত উক্ত পত্রটির উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলঃ

    রোমিলা থাপারকে লিখিত সীতা রাম গোয়েলের পত্রের উদ্ধৃতাংশঃ

    আমরা মার্কসীয় অধ্যাপকদের আলোচনায় ফিরে আসি ………..

    আমরা এক হাজারেরও বেশি বছর ধরে মুসলিমদের দ্বারা লিখিত আশিটি ইতিহাসসমূহের উদ্ধৃতি দিয়েছি। আমরা বহু ইসলামিক লেখমালাসমূহেরও উদ্ধৃতি দিয়েছি যা উক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্যকে সমর্থন করে। এইসকল উদ্ধৃতি বিস্তীর্ণ এলাকায় ও দীর্ঘ সময় ধরে কিভাবে হিন্দু মন্দিরগুলি ধ্বংস হয়েছে তা তুলে ধরে। আমরা এক্ষেত্রে কোনও সম্পাদকীয় মন্তব্য বা এতে সাম্প্রদায়িক রঙ প্রদান করিনি। উপরন্তু মুসলিম ঐতিহাসিকদের ব্যবহৃত প্রকৃত ভাষাই Actual Language) অবিকলভাবে আমরা ব্যবহার করেছি।

    কিন্তু আমাদের উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমানগুলি অধ্যাপকগন (মার্কসীয়) সাল-তারিখের নামমাত্র তালিকা হিসেবে প্রত্যাখান করবে। আমরা এই সকল অধ্যাপকগনের কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করতে পারি তা হল তারা সেইসমস্ত ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও ব্যাখা নিয়ে হাজির হবেন যেখানে মুসলিম বর্ণনায় উল্লেখিত হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসসাধনকে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কিংবা অন্যকোনও অ-ধর্মীয় অভিপ্রায়ে বিশ্লেষণ করা হবে।

   আমরা আমাদের অবস্থানে অনড়, যথা- মুসলিম ধর্মতত্ত্বেই সরাসরি ও সন্তোষজনক ব্যাখা প্রদান করা হয়েছে যে কেন মুসলিম বিজয়ীবর্গ ও শাসকবর্গ হিন্দু মন্দিরগুলির এরুপ অবস্থা করেছিল। আমরা এই মুসলিম ধর্মতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়েছি এবং এর পাশাপাশি এই মুসলিম ধর্মতত্ত্ব কিভাবে ইহার চূড়ান্ত রুপ ধারন করেছিল তার ইতিহাসও প্রদান করেছি। সেই সময়ে আরবে এই ধর্মতত্ত্বের উত্থানের পিছনে বস্তুতান্ত্রিক অবস্থা ও বৈষয়িক ঐতিহাসিক চালিকাশক্তিসমূহ কি ছিল?

   পরবর্তী দ্বিতীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করা যায় তা অধ্যাপকগন (মার্কসীয়) The Times of India-এর একটি পত্রে [১৯৮৬-র আগস্টের কোনো এক সময়ে] বলেছিলেন। তারা (মার্কসীয় অধ্যাপকগন) বলেছিলেন অসহিষ্ণুতার কার্যকলাপ সকল ধর্মের অনুরাগীরাই সম্পাদন করেছিল …….. আমরা হিন্দুদের থেকে বৌদ্ধ, জৈন বাঃ সর্বপ্রাণবাদীদের স্বতন্ত্রকারী তাদের দর্শণ বিনিময় করিনি। কিন্তু আমরা আপাতত তাদের বক্তব্যকে সমর্থন করছি এবং অনুরোধ করছি নিম্নলিখিত বিষয়গুলি তুলে ধরতেঃ

১) যে-কোনও সময়ে কোনও হিন্দুর দ্বারা বৌদ্ধ ও জৈন স্মৃতিসৌধ এবং সর্বপ্রাণবাদীদের মন্দির ধ্বংসকরনের বিবরণ উল্লেখকারী লেখমালাসমূহের তালিকা।

২) যে-কোনও সময়ে কোনও হিন্দুর দ্বারা বৌদ্ধ ও জৈন স্মৃতিসৌধ এবং সর্বপ্রাণবাদীদের মন্দির ধ্বংসকরনের বিবরণ বর্ণনাকারী হিন্দু সাহিত্য তথ্যসূত্রের উদ্ধৃতি।

৩) বৌদ্ধ ও জৈন স্মৃতিসৌধ এবং সর্বপ্রাণবাদীদের মন্দির অপবিত্রকরন বা লুন্ঠনের নিদান প্রদানকারী বা এইসকল ক্রিয়াকলাপকে ধর্মীয় বা পূণ্যকর্ম হিসেবে উপস্থাপনকারী হিন্দু ধর্মতত্ত্বের।

৪) বৌদ্ধ ও জৈন স্মৃতিসৌধ এবং সর্বপ্রাণবাদীদের মন্দির অপবিত্রকারী বা ধ্বংসকারী বা হিন্দু উপাসনালয়ে পরিবর্তনকারী নায়ক হিসেবে হিন্দুদের থেকে সন্মোধনপ্রাপ্ত হিন্দু রাজা বা সমরনায়কদের নামের তালিকা।

৫) সুদূর বা সাম্প্রতিক অতীতে অপবিত্রকৃত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত বা হিন্দু উপাসনালয়ে পরিবর্তিত বৌদ্ধ ও জৈন স্মৃতিসৌধ এবং সর্বপ্রাণবাদীদের মন্দিরের তালিকা।

৬) বৌদ্ধ ও জৈন স্মৃতিসৌধ এবং সর্বপ্রাণবাদীদের মন্দিরের স্থানে প্রতিষ্ঠিত বা প্রথমোক্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের উপাদান্সমূহ ব্যবহারকারী হিন্দু মন্দির বা স্মৃতিসৌধের তালিকা।

৭) হিন্দু মন্দির বা স্মৃতিসৌধের দ্বারা জবরদখলকৃত এবং ন্যায্য দাবিদারের কাছে সেগুলি প্রত্যাপর্নের আর্জিকারী বৌদ্ধ ও জৈন এবং সর্বপ্রাণবাদী নেতা ও সংগঠনের নাম।

৮) বৌদ্ধ ও জৈন এবং সর্বপ্রাণবাদীদের তাদের উপাসনালয়ের ন্যায্য পুনঃস্থাপনের দাবি অগ্রাহ্যকারী বা স্থিতাবস্থা বজায়কারী আইনের বা ‘হিন্দুত্ববাদ বিপদে রয়েছে’ বলে চিৎকারকারী বা তাদের জবরদখলের সমর্থনে দাঙ্গাকারী হিন্দু নেতা বা সংগঠনের নাম।

   আমরা মনে করি যে এই ধরনের শক্তিশালী সাক্ষ্যপ্রমান ধর্মীয় স্থানসমূহের পুনঃস্থাপনের যুক্তির প্রতি সীমাসমূহের প্রশ্নটিকে এককভাবে স্থির করবে।

   যদি অধ্যাপকগন (মার্কসীয়) আমাদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলির উত্তর প্রদানে ব্যর্থ হন কিংবা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে উপযুক্ত সাক্ষ্য পেশ করতে না পারেন তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হব যে জ্ঞানী শিক্ষাবিদ হওয়ার বদলে তারা একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থনে বিশেষ উদ্দেশ্য বা আপাতভাবে ন্যায়সঙ্গত ব্যাখা প্রদানকারী মানববিদ্বেষী রাজনীতিবিদ। বস্তুত তাদের ‘স্ট্যালিনবাদী’ বললেও অত্যুক্তি হিবে না। স্ট্যালিনবাদ হল একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সত্যের অপলাপের অনুশীলন।

   চলবে…….    

সন্দীপ বালকৃষ্ণ
অনুবাদ : অধ্যাপক শুভজিৎ আওন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.