লকডাউনে ভারত-পাক যুদ্ধের স্মৃতি আঁকড়ে রন্তিদেব

 “আমাদের যখন বালক বয়স , ক্লাস সেভেনে পড়ি , তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেঁধেছিল। বাংলাদেশ যুদ্ধ। সে দিনগুলির কথা বেশ মনে আছে এখনো।“ লকডাউনের স্মৃতি এভাবেই এঁকেছেন সম্পাদক-রাজনীতিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত।

করোনা-আতঙ্কের অনিশ্চয়তা আর লকডাউনের জাঁতাকলে অধিকাংশের মত ঘরবন্দী রন্তিদেবও। ভারত-পক যুদ্ধের স্মৃতি তাঁর কথায়, “বিকেল পাঁচটা বাজতেই কার্ফু আর ব্ল্যাক আউট। বাড়ির বড়োরা পাঁচটা বাজার আগেই পড়িমরি বাড়ি ফিরে আসতেন। পাড়ার ল্যাম্পপোস্টগুলো মুড়ে ফেলা হয়েছে কালো কাগজে। সন্ধে হলেই বাড়ির দরজা জানালা সব বন্ধ। জানালার কাঁচে কালো রঙের প্রলেপ। এক ফোঁটা আলোর বিন্দুও যেন বাইরে বেরতে না পারে। সন্ধে হলেই গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে পাড়া। মাঝে মাঝে শুধু পুলিশের বুটের মশমশে শব্দ। মাঝে মাঝে খড়খড়ি ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করতাম বাইরে অন্ধকারে ডুবে থাকা শহরটা। বড়োরা দেখতে পেলে হা -হা করে ছুটে আসতেন। সরিয়ে আনতেন জানালার কাছ থেকে। ওই বালক বয়সে শুনেছিলাম ক্ষীণ আলোর রেখা দেখেই নাকি শত্রুপক্ষের বোমারু বিমান হানা দিয়ে যেতে পারে আমাদের শহরে। ওই ব্ল্যাক আউটের ভিতরই একদিন আমাদের পাড়ার বাচ্চুকাকু গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। আর কয়েকজন তাসুড়ে পাড়ার রকে হ্যারিকেনের আলোয় তাসের আসর জমিয়েছিল। তাদেরও ধরল পুলিশ। তা নিয়ে কদিন খুব আলোচনা চলল পাড়ায়। এসবের মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ সবার বুকে কাঁপন ধরিয়ে বেজে উঠত সাইরেন। রাত আটটার সময় রেডিও সেট ঘিরে বসে পড়ত বাড়ির সবাই। স্থানীয় সংবাদ পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে দিল্লি থেকে ইথারে ভেসে আসত নীলিমা সান্যালের কন্ঠস্বর। ওদের সঙ্গে আমরা চলে যেতাম বাংলাদেশের রণাঙ্গনে । কতোটা এগোল ভারতের সেনারা অধীর আগ্রহে জানতে চাইতাম আমরা। রেডিও ঘিরে গোল হয়ে বসে সবাই প্রার্থনা করতাম , ঠাকুর এই যুদ্ধে যেন আমরা জিতে আসতে পারি। দেবদুলালের খবর পড়া শেষ হলে আমার ঠাকুমা দুহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করতেন। কার উদ্দেশ্যে কে জানে।

তারপর একদিন হঠাৎ পাশের বাড়ির জানালা খুলে একজন বলে উঠল , আমরা জিতে গেছি। সেদিন সমস্ত বাড়ির জানালা হাট করে খুলে গেল। অন্ধকার দূর করে সন্ধেবেলা স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠল। পাড়ার মোড়ে আবার ছেলে বুড়োরা আড্ডা জমালো। আবার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল আমাদের এই শহরে।“

ফেসবুকে লিখেছেন, “এতদিন পরে , এই প্রৌঢ়ত্বে , আমি আবার অপেক্ষা করে আছি সেই দিনটার জন্য। যেদিন পাশের বাড়ির জানালা খুলে কেউ একজন বলে উঠবে , এই যুদ্ধে আমরা জিতে গেছি। সেদিন আবার নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে আপাতত মৃতপ্রায় আমাদের এই শহরটিতে।এই যুদ্ধেও মানুষ জিতবে , জয় হবে মানবতার। এ প্রত্যয় আমার রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.