একসময় ঘাটমাথা এবং কোকনের গিরিপথ শিব্বা রাও ও তাঁর নির্মিত সৈন্যবাহিনীর অশ্বখুরের শব্দে দিগ্বিদিক বিকীর্ন করত।শিব্বা রাও ষোড়শ বৎসর বয়ঃক্রম হতেই স্বীয় ক্ষমতা স্থাপনের নিমিত্ত প্রকাশ্যভাবে কার্য করতে শুরু করেন। এই সময় হতে তিনি ধীরে ধীরে লোকবল সংগ্রহ করে ভাবী মহাযুদ্ধের আয়োজন করতে লাগলেন। বালকগন সাধারণত যে বয়ঃক্রমে ক্রীড়া করে সময় অতিবাহিত করতেন সেই সময় বালক শিবাজী একটি নব হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনে ব্রতী হয়েছিলেন। শিবাজী কার্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হয়ে দেখলেন তাঁর একটি বিষয় বড়ই অভাব। শিব্বা রাওয়ের আবার অভাব ? হ্যাঁ… কি সেই বিষয়?
দক্ষিণাত্য প্রদেশ দুর্গ বহুল ….এবং শাহাজীর বিস্তৃত জায়গীর ছিল। কিন্তু সেই জায়গীর মধ্যে একটিও দুর্গ ছিল না।শিবাজী যে ব্যবসা অবলম্বন করতে যাচ্ছেন দুর্গই তার প্রধান পণ্য ছিল। দুর্গ না থাকলে সে বাণিজ্য সুচারু রূপে সম্পন্ন হয় না। তাই তিনি কার্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হয়ে সর্বপ্রথম দুর্গ উপার্জনের চেষ্টা করলেন।
১৫৬৮ শকে (১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে ) , তখন শিবাজী ১৯ বৎসর …এই সময় বিজাপুর কর্ণাটযুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন।শিবাজী সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন।স্বীয় বাসনা চরিতার্থ করবার নিয়ত ভোর অঞ্চলস্থ তোরণা দুর্গে প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তোরণা দুর্গ পুনার দক্ষিণপশ্চিম নয় ক্রোশ দূরে অবস্থিত। অসীম চতুরতার প্রমান দিলেন শিব্বা রাও। সে সময় বহু দুর্গের প্রধান কর্মচারীগন এবং সৈন্য সমূহ শিবাজীর বীরত্বের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর চতুরতা , বীরত্ব , স্বদেশ প্রেম ও হিন্দু রক্ষার আদর্শ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। তাই মানুষ এমনি তাঁর প্রেমে পাগল ছিল। সুতরাং , তোরণার প্রধান কর্মকর্তারাও তাঁর সঙ্গ দিতে কুণ্ঠা বোধ করলেন না। একদা মধ্যরাত্রের আঁধারে শিব্বা রাওয়ের মবলা সহচর সৈন্যসহ তোরণা আক্রমন করলেন। বিনা রক্তপাতে প্রথম হিন্দু সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হল। এইরূপে তিনি দুর্গ অধিকার করে মবলাগণকে অনায়াসলব্ধ জয়োল্লাসে উল্লসিত ও ভবিষ্যৎ কার্য সাধনের নিমিত্ত প্রোৎসাহিত করেন।
এই সময় তাঁর প্রিয় বীর সহচরগন – তানাজি মালুসারে, সুরেরাও কাঁকড়ে , বাজীফসলকর, যেসজী কঙ্ক প্রমুখরা তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে বহু বার্ষিক রাজ্য সংস্থাপন যজ্ঞে প্রধান অধ্বর্য্যু হয়ে আজীবন বিশ্বস্তভাবে তাতে আহুতি প্রদান করতে শুরু করেন ।
শিব্বা রাও তোরণা দুর্গ অধীন করে তার অভ্যন্তরে যেসব স্থান পুরাতন, বিপক্ষের আক্রমনের জন্য সুগম ছিল সে সকল স্থান দুর্গম , দৃঢ় এবং নবরূপে নির্মাণ করলেন। দুর্গের এইরূপ জীর্ণ সংস্কার করার সময় শিবাজী এক স্থান খনন কালে বহুল পরিমানে সুবর্ন মুদ্রা প্রাপ্ত হন। জনসাধারণ শিবাজীর এই দৈব অর্থ প্রাপ্তির কথা শ্রবণ করে ধারণা করতে লাগলেন যে ,শিব্বা রাও সাধারণ লোক নন এবং পরমেশ্বর তাঁর উপর সদা অনুগ্রহ বর্ষন করেন।
অকস্মাৎ এই অর্থপ্রাপ্তির ফলে , শিবাজী সেই অর্থদ্বারা তোরণা দুর্গ সংস্কার সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেন এবং যুদ্ধোপযোগী দ্রব্যসম্ভারে দুর্গকে পরিপূর্ণ করেন। এরপর তিনি তোরণার একক্রোশ দূরবর্তী মুরবাদ নামক পর্বতের উপর কে দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গ নির্মাণ তাঁর অসম্ভব বুদ্ধির পরিচয় বহন করে। এই দুর্গই ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজগড় । এই দুর্গ মধ্যেই শিবাজী রাজ্যাভিষেকের পূর্বকাল পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ওকে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন।
শিব্বা রাওয়ের এই সকল কার্য পরম্পরা শাহাজীর কর্ণগোচর হতে বিলম্ব হল না। যদিও শাহাজী হৃদয়ের অভ্যন্তরে কোনো না কোনো ভাবে হিন্দু রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন ,তবুও পুত্রের এরূপ অসম সাহসী কার্যাবলী তাঁর মনাসপটে ভয়ের উদ্রেক ঘটাল।তিনি ভীত হয়ে শিব্বা রাওকে ভর্ৎসনা করে উপদেশপত্র লিখে এরূপ সকল কার্য হতে বিরত থাকতে বললেন।
দাদোজী কন্ডোদেব শিবাজীর কুশাগ্রীয় মতি ক্ষিপ্রকারীতা এবং নির্ভীকতা অবলোকন করে আপন হৃদয় বড়ই আহ্লাদিত হতেন। কিন্তু এসব ধীরেসুস্থে না করলে শাহাজীর বিপদ হতে পারে বিবেচনা করে , দাদোজী শিব্বা রাওকে কীয়দ সময়ের নিমিত্ত ক্ষান্ত হতে উপদেশ দেন। ফলত, গুরু আজ্ঞা শিরোধার্য করে শিবাজী কিছুদিন স্থির থেকে পৈতৃক সম্পত্তি ও বিষয়ের উন্নতি কল্পে মনোনিবেশ করেন।
তারপর ? তারপর কি হল ? শিব্বা রাও কেমন করে ফিরলেন আবার সেই মহান কর্মে?
গীতায় একটি শ্লোক আছে :
ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি কেচিদাত্মানমাত্মনা।
অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্মযোগেন চাপরে।।
কেউ কেউ পরমাত্মাকে অন্তরে ধ্যানের দ্বারা দর্শন করেন, কেউ সাংখ্য-যোগের দ্বারা দর্শন করেন এবং অন্যেরা কর্মযোগের দ্বারা দর্শন করেন।
গীতার এই নির্দেশকে ই শিব্বা রাও নিজের জীবনের চলার পথের পাথেয় করেছিলেন। তিনি অপেক্ষা করেছিলেন গুরুর আদেশের। ১৫৬৯ শক ( ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) দাদোজী কন্ডোদেব সপ্ততি বৎসর বয়ঃক্রমে পদার্পন করলেন। বৃদ্ধের শরীর জ্বরার আক্রমণে জীর্ণ ,শীর্ণ শিথিল এবং রোগ প্রবণ হয়ে পড়ল।মৃত্যু আসন্নবর্তী এরূপ অবগত হয়ে তিনি একদিন শিবাজীকে আহ্বান করে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন , সেই উপদেশ শিব্বা রাওয়ের হিন্দু সাম্রাজ্য গঠনের অগ্নিকে পুনরায় প্রজ্জ্বলিত করেছিল।
ন কর্মণামনারম্ভান্ নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্লুতে।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধং সমাধিগচ্ছতি।।
নহি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ।।
কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্ ।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে।।
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন।
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ স বিশষ্যতে।।
নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণ।।৮।।
অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছেন,
“কর্ম ও সন্ন্যাসযোগের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ?”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্দ্ধিধায় বলেছেন দু’টি যোগই মোক্ষপ্রদ হলেও সন্ন্যাসযোগ অপেক্ষা কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ।
মানুষ মুক্তি পাবার জন্য সন্ন্যাসী হয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তারা
প্রকৃত সন্ন্যাসের মর্ম জানেনা। কর্ম বন্ধনের কারণ নয়। কর্মফলের প্রতি আসক্তিই বন্ধনের কারণ। বলা হয়েছে, কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও নয়। আসক্তি যেন কর্মপ্রবৃত্তির কারণ না হয়ে দাড়ায়।
এভাবে আসক্তিহীন হতে পারলে সন্ন্যাসের ফল পাওয়া যায়। তাকে আর বনে জঙ্গলে ঈশ্বর খুঁজে বেড়াবার দরকার হয়না।
কেউ যদি মনে করতে পারেন যে, তিনি একজন কর্মীমাত্র। সৃষ্টিকর্তা তাকে
পাঠিয়েছেন কিছু কর্ম সম্পাদনের জন্য। তাই তিনি কোন কর্মের ফলের প্রতি লালায়িত না হয়ে তার জন্য নির্ধারিত কর্ম তিনি অতিশয় মনোযোগ সহকারে করে যাচ্ছেন। কোন একটি কর্মকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দিচ্ছেন না আবার কোন কর্মকে
হালকাভাবেও দেখছেন না। প্রতিটি কর্ম ঈশ্বরের কর্ম, তাই কর্মমাত্র সমান
গুরুত্বপূর্ণ। সংসার আশ্রমের তিনি একজন
কর্মীমাত্র। যিনি অকর্মে কর্ম দর্শন করেন এবং কর্মে অকর্ম দর্শন করেন, এইরূপ জ্ঞানীব্যক্তি যথার্থ কর্মী। এরূপ কর্ম কখনও বন্ধনের কারণ হয়না। এরূপ কর্মে সন্ন্যাসের ফল পাওয়া যায়।
মৃত্যু আসন্নবর্তী বৃদ্ধ ব্রাহ্মন দাদোজী শিব্বা রাওকে শেষ মুহূর্তে কর্মযোগী হবার সেই শিক্ষাকে সুবিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। যেমন –
শরশয্যায় শায়িত অবস্থায় ভীষ্ম , জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয় যুধিষ্ঠিরের যেমন জিজ্ঞাসা অনুসিৎসা ও প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন ….সম্ভবত সেগুলি গীতার পরে মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে এবং অতিবাহিত মহা জীবনের পথ প্রদর্শক মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর জীবন চরিত