চোরে চোরে মাসতুতো ভাই – পর্ব ১

চোরেদের মরসুম , তাই ভাবলাম একটু চোর নিয়ে লেখা হয়ে যাক। প্রাচীন কাল তো বটেই, পঞ্চাশ, ষাট মায় নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেও সিঁধেল চোর ব্যাপারটা গাঁ ঘর এবং মফঃস্বলের মধ্যবিত্ত ,নিম্নবিত্তদের কাছে বেশ ভয় ও দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল। কলকাতা শহর এখনের মতো তখনও অর্বানাইজড হয়ে যায়নি। কংক্রিটের জঙ্গলের বদলে সবুজ বৃক্ষ অরণ্যের সমাহার অধিক ছিল। শহরতলি তো আরও অধিক নিঝুম ছিল। কলকাতা এবং তার আশেপাশের এলাকায় যেমন – বেহালা, শকুন্তলা পার্ক, ঠাকুরপুকুর, দমদম, বরানগর অঞ্চলেও তাদের প্রবল প্রতাপ ছিল। ছোট বেলায় ঠাকুমা, পিসির কাছে শুনতাম সে সময় ডাকাত পড়ার মতোই আতঙ্কের ব্যাপার ছিল সিঁধেল চোর। সারা গায়ে পিচ্ছিল করে তেল মেখে , মুখে ভুষোকালি মেখে , ছোট ধুতি খাটো করে শক্ত করে বেঁধে খালি গায়ে নাকি তারা রেতের বেলায় আসত গৃহস্থের রাহু হয়ে। তাদের সিঁধকাঠি আবার কামার শালায় তৈরি হতো। একটা প্রবাদ আছে না – চোরে , কামারে দেখা নেই/ সিঁধ কাঠি তৈরির বহর ষোলোআনা। জানি না সে সময় চোর ও কামারের দেখা হতো কিনা ? তবে কামার সিঁধকাঠি নির্মাণ করত এবং তা বিক্রিও হতো।

সিঁধকাঠি দেখতে অনেকটা শাবলের মতো। লোহার তৈরি সেই কাঠি দিয়ে ধীরে ধীরে ইঁট সরিয়ে গাঁথনি আলগা করে , ইঁট খুলে মাথা গলানোর মতো জায়গা করত। সেই স্থান দিয়ে পা গলিয়ে দেখে নিত কোনো বিপদ আছে কিনা? বিপদ মানে – কুকুর , ইঁদুর কল,বঁটি বা দা হাতে বসে থাকা গৃহস্থ। বিপদ না থাকলে সেখান দিয়ে মাথা গলিয়ে শরীরটা ঢুকিয়ে নিত। এমন গল্প অনেকের কাছে শুনতাম, যে সিঁধেল চোর মাথা গলিয়েছে আর বাড়ির নতুন বউ সিঁধ কাটার শব্দে গর্তের মুখে রাম দা নিয়ে বসে । চোর মাথা ঢোকাতেই……

সে সময় নাকি বহু বিখ্যাত ও কৃতী চোর ছিল। ইয়ে চোর বলে সমাজে অসম্মান ছিল না। বরং তারা এমন শিল্পের সঙ্গে চুরি করত যে সমাজে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। এমন কিছু চোর ছিল বলে শুনেছি, যে তারা নাকি নিঃশ্বাসের শব্দে ঠাওর করত গৃহস্থের ঘুম্ কতখানি গভীর হয়েছে। আমার ঠাকুরদার সোনার ব্যবসা ছিল। ঠাকুমার কাছে শুনেছি ঠাকুরদার দোকান এবং আমাদের বেহালার আদি বাড়ি মিলিয়ে মোট তিনবার ডাকাত পড়েছিল। ঘুমন্ত ঠাকুমার গলার চামড়া ছিঁড়ে বড় তারা গিনির হার নিয়ে গিয়েছিল। ঠাকুমা বলতেন, এসব চোর ডাকাতরা নাকি নানা ধরনের দেহবন্ধন, ঘরবন্ধন ইত্যাদি তুকতাকে বিশ্বাস করত। নানা প্রকার শারীরিক কসরৎও জানত। গাঁ পড়শীর তাড়া খেয়ে এঁদো পুকুর, বিলে ডুব দিয়ে মাথায় একটি ফুটো করা কালি হাঁড়ি ভাসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ভেসে থাকত। চোর জোৎস্না রাতে , গরমের দিনে কচুরীপান ভর্তি পুকুরকে মাঠ ভেবে ছুটতে গিয়ে সে একে বারে যাচ্ছেতাই অবস্থায় পড়েছে সেসব খবরও তখন শোনা যেত।

আগে গাঁ ঘরে চোর ঢোকা ভারী অশুভ বলে গণ্য হতো। এখনো হয়। সে কিছু চুরি করুক বা না করুক। ঠাকুমা বলতেন , ঘরে কালো মাথা ঢুকলে অলক্ষ্মী আগমন হয়। সংসারে অকল্যাণ হয়। চোরেরা সেই সময় নানা রকম পদ্ধতি গ্রহণ করত চুরি করতে। কেবলমাত্র সিঁধ কেটেই চুরি করত না। অনেক চোর বাড়ি ঢুকে বেরোনোর রাস্তা খুলে দিত। কেউ কেউ বাড়িতে বাচ্চা ছেলে ঢুকিয়ে খিল খোলাত। চুরির পর অনেকে গেরস্থ ঘরে হাগু করে যেত। এই নিয়ে একটু পরে একটা গল্প বলছি। যা হোক, বাড়িতে চোর ঢুকলে আগে গৃহস্থরা ব্রাহ্মণ ডেকে শান্তিস্বস্ত‍্যয়ন করতেন। ঠাকুমা বলতেন, অনেক গৃহস্থ কর্তা নাকি চোরের পাল্টা তুক ইয়ে ঘরবন্ধন করতেন। রাতে বিছানায় ঢুকে মশারির দিকে তাকিয়ে ঘুমানোর আগে লৌকিক ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করতেন। এই যেমন —

কুঁচো কচ্ছপ কাঁকড়া
কুঁচো কচ্ছপ কাঁকড়া
কফফল কফফল
চোরের যাত্রা নিষ্ফল নিষ্ফল
যদ্দুর যায় কফফলরা
সাপ বাঘ চোরা না বাড়ায় পা…. ইত্যাদি।

চোরদের কীর্তি নিয়ে নানান অদ্ভুত আশ্চর্য গল্প আছে। বাংলা উপন্যাসেও আছে , ছোট গল্প, ছোটদের গল্প … চোরের অনেক গল্প। আগে তো সাধারণ মানুষ ব্যাংকের লকার ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না বা উদাসীন ছিল। ফলে তখন গাঁ ঘর, মফঃস্বলে গৃহস্থ ঘরে বড় বড় কাঠ, লোহার সিন্দুক থাকত বা বস্তায় থাকত ধান বেচা কাঁচা টাকা। সেগুলো দেওয়াল কেটে চোরা কুঠুরিতে, মাটির নীচে ঘর করে গুপ্তধনের মতো সঞ্চিত হতো। এগুলো কেবল বঙ্গে নয় , সমগ্র ভারতেই ছিল। উত্তর ভারতে এগুলোকেই বলা হত তয়খানা। চোর বা ডাকাতরা ঘরের লোকজনের মারফত সেসব খবর পেত, যেমন – কাজের লোক , শরিকি শত্রু প্রমুখ মাধ্যমে। চুরি করে সেসব নিয়ে দূরে জঙ্গলে গিয়ে ভেঙে ফেলত। বস্তায় ভরত বাসন, পয়সা, গয়না। এসব চোরেরা গরু , কুকুর, ছাগলের মতো অবলা প্রাণীর উপরেও কম অত্যাচার করত না। শুনেছি বাজবরণআঠা খাইয়ে এসব অবলা পশুগুলোকে বোবা করে দিত।

আমার জন্ম বেহালা , শীলপাড়া ছাড়িয়ে আরো ভিতরে। চারিদিকে জঙ্গল, কাঁচা রাস্তা, অন্ধকার ( আমাদের ওখানে অনেক পরে বিদ্যুৎ আসে)। বড় পিসি যানজট থেকে একটু দূরে থাকতে পছন্দ করতেন। তাই ওখানে উনি পুকুর পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে জমি কিনে বাড়ি করলেন। আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। আমার বাবা, মা, ঠাকুমা, কাকা, পাঁচ পিসি, আমাদের কুকুর ভুতো। সারাদিন বাড়িতে কচকচি লেগে থাকত। মানে কাক চিল বসার সময় পেত না। বাড়ির সামনের দিকে বড় রান্না ঘর ছিল। উনুনে বড় বড় হাঁড়ি কড়ায় রান্না হতো। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় একটা বাজত রোজ, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা। আর সঙ্গে ছিল।মশার উৎপাত। আমার ন পিসি ছিলেন ভীষণ বাতিক গ্রস্থ মানুষ। যত রাতই হোক সেই পাহাড় প্রমাণ বাসন মেজে শুতে যেতেন। কুয়োর পাড়ে শীত ও মশারা তাঁর ছাই দিয়ে বাসন মাজার কাছে হার মেনে যেত। একজন চোরও মেনে ছিল। চোরটা বোধহয় চুরি করবে বলে কুয়োতলায় এঁদো অন্ধকারে রাত আটটা থেকে বসেছিল। কারণ গাঁ ঘরে ওটাই শোয়ার আদর্শ সময় ছিল সে সময়। আমি কিন্তু নব্বই দশকের কথা বলছি। যাক, তো সেই চোর দেখল আমাদের বাড়িটি ইস্পেশাল। সন্ধ্যের পর থেকে অহিরাবণ মহীরাবণ যুদ্ধ চলে। চিৎকার, কান্না ঝগড়া ইত্যাদিতে ভামগুলো ভয়ে ছাদে ওঠে না। ভূত , পেত্নী ইত্যাদিরা অন্য বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল বোধহয়। তো চোর মশা, ভ্যাপসা গরম আর সঙ্গে ঝির ঝির বৃষ্টি নিয়ে বসে প্রমাদ গুনছিল। কখন এই বাড়ির লোক খেয়ে ঘুমাতে যাবে এবং সে চুরি করবে। ন পিসি প্রায় রাত একটার সময় লম্প আর বাসন নিয়ে কুয়োতলায় উপস্থিত হলেন। ঝনঝন , ঝমঝম শব্দে বাসন রেখে, ঝপাস করে কুয়োয় বালতি ফেলে জল তুললেন। তুলে কাঁসার বাসন তেঁতুল, ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে লাগলেন। বিশাল হাঁড়ি কড়াই এর কালি তুলতে দেখে চোর সেদিন আর ধৈর্য্য রাখতে পারেনি। কুয়োর পাশ দিয়ে সেই চোর বলে উঠল, ” এ তোরা শুবি নে”….

অন্ধকারে পিসি প্রথমে ভূত ভেবেছিলেন। প্রথমে বোবায় ধরেছিল, তারপর বাবা গো ,মাগো , আমাকে ভূতে খেল রে বলে চিৎকার জুড়ে দিলেন। আমদের বাড়ির পাশে কিছু বনবাসী ( সাঁওতাল) এখনো বাস করেন। বাবা, কাকা, সাঁওতাল কাকুরা লাঠি নিয়ে ছুটে এল। চোর ব্যাটা তখন মহাফ্যাসাদে পড়েছে। পালানোর পথ নেই। বাবা, কাকা হ্যারিকেনের আলো নিয়ে এসে দেখলেন ভূত নয় কো, বেঁটে এক আস্ত মানুষ কালি মেখে দাঁড়িয়ে আছে। অঙ্গে তার একটুকরো কাপড় ছাড়া কিছু নেই। তেলকালিমাখা শরীর বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে। সারারাত আমগাছে বেঁধে রেখে সকালে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

পরের দিন আরেকটা গল্প বলব….

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী
( ছবি সংগৃহীত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.