সম্প্রতি নয়ডার সুরজপুর জেলা আদালত ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। অপরাধ— সাড়ে তিন বছরের একটি বাচ্চাকে ‘ডিজিটাল রেপ’ বা ধর্ষণ করেছেন তিনি। ‘ডিজিটাল’ শব্দটা শুনে প্রথমেই মনে হয়, এটা নিশ্চয়ই সাইবার ক্রাইম। মোবাইল বা ভিডিয়ো বা কম্পিউটারের সাহায্য ভার্চুয়াল ধর্ষণ। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়! শব্দটা ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’ হলেও এর সঙ্গে সাইবার অপরাধের কোনও সম্পর্ক নেই।
তা হলে কী এই ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর ক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি এসেছে ‘ডিজিট’ থেকে। ইংরেজিতে ‘ডিজিট’ অর্থে শুধুমাত্র সংখ্যা নয়, তার আরও একটি অর্থ আঙুল, বুড়ো আঙুল এবং পায়ের আঙুল। আর তাই ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর অর্থ— যৌনাঙ্গে আঙুল বা তেমনই কিছু ঢুকিয়ে নির্যাতন। আগে এই ধরনের ঘটনা শ্লীলতাহানি বলে গণ্য হত। সেই হিসেবে ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’ শব্দবন্ধটি কিছুটা নতুন-ই বলা যেতে পারে।
২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণের ঘটনার পরই ধর্ষণ আইনে বদল আনা হয়। সংসদে নতুন ধর্ষণ আইন পাশ হয়। আর সেখানে এই ধরনের ঘটনাকে ধর্ষণ আইনের ৩৭৫, ৩৭৬ ধারা এবং পকসো আইনে অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হয়। ২০১৩ সালেই ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’ শব্দবন্ধের ব্যবহার শুরু। শুধুমাত্র পকসো আইনে মামলা হলে অপরাধীর ৫ বছরের জেল হতে পারে, আর ৩৭৬ ধারায় মামলা হলে ১০ বছরের জেল বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
নয়ডার ঘটনায় মামলা হয়েছিল ৩৭৬ ধারায়। অভিযোগ, নয়ডার ৪৫ সেক্টরের সালারপুল গ্রামে নিজের মেয়ের বাড়ি ২০১৯ সালে এসেছিলেন আকবর আলি। আদতে পশ্চিমবঙ্গের মালদার বাসিন্দা তিনি। অভিযোগ, মেয়ের বাড়িতে কেউ না থাকার সুযোগে লজেন্সের লোভ দেখিয়ে সাড়ে তিন বছরের প্রতিবেশী বাচ্চাটিকে ডাকতেন তিনি এবং তাকে ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’ করতেন। অর্থাৎ, বাচ্চাটির শরীরে যৌনাঙ্গ অনুপ্রবেশ না করিয়েও আঙুল অনুপ্রবেশ করিয়ে যৌন নিগ্রহ। তথ্য প্রমাণ এবং আট জনের বয়ানের ভিত্তিতে আলিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন দায়রা বিচারক অনিল কুমার সিং। ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয় তাঁর। আলির আইনজীবীর দাবি ছিল, তাঁর মক্কেল ইতিমধ্যেই কয়েক বছর জেল খেটে ফেলেছেন, ফলে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হোক। কিন্তু বিচারক এই যুক্তি মানেননি।
২০১৩ সালের আগেও ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর একাধিক ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সেগুলোর কোনওটাই ধর্ষণের অভিযোগ বলে গণ্য হয়নি। এর আগে দিল্লিতে ৬০ বছরের এক বৃদ্ধাকে লোহার রড ঢুকিয়ে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল এক অটোচালকের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হলেও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ এবং ৩৭৬ ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়নি।
২০১২ সালে মুম্বইয়ে ২ বছরের এক শিশুকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে,বাচ্চাটির গোপনাঙ্গ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার প্রমাণ মেলেনি। পরে জানা যায়, শিশুটির বাবা দীর্ঘদিন আঙুল ঢুকিয়ে মেয়েকে যৌন হেনস্থা করতেন! বিকৃত মানসিকতার সেই বাবাকে গ্রেপ্তার করা হলেও ধর্ষণ প্রমাণিত না হওয়ায় কড়া কোনও সাজাই পাননি তিনি!
পরিসংখ্যান বলছে, শিশুদের এ ধরনের হেনস্থার ঘটনা বিরল নয়। ভারতে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুরা পরিজন বা পরিচিতদের হাতে ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর শিকার হয়। যেহেতু এক্ষেত্রে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায় না, ফলে ধর্ষণের মামলা হওয়া বা অপরাধীর শাস্তি পাওয়ার ঘটনা কমই ঘটে। ২০১৩ সালে ধর্ষণ আইনে বদল এই ধরনের অপরাধে শাস্তির দরজা খুলে দিয়েছে।
ক’দিন আগেই নয়ডায় সাত মাসের শিশুকে ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫০ বছরের এক প্রৌঢ়। গত মে মাসে নয়ডারই ৮১ বছরের এক স্কেচ আর্টিস্টকে ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৭ বছরের এক নাবালিকাকে নাকি সাত বছর ধরে এ ভাবে যৌন হেনস্থা করতেন তিনি! গত জুন মাসে নয়ডার কাছেই পাঁচ বছরের এক শিশুকে ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে তার বাবা। তবে, সালারপুলের ঘটনায় যাবজ্জীবন সাজা একটা নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করল বলেই মনে করছেন আইনি বিশেষজ্ঞরা।