একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের যাবতীয় বিশ্বাসের মর্মমূলে আঘাত করল। নড়িয়ে দিল পদার্থবিজ্ঞানের ভিতটাকেই!
আমাদের খুবই চেনা, জানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা ইলেকট্রনের এক ‘তুতো ভাই’ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকানুনের পরোয়া করল না। আক্ষরিক অর্থে থোড়াই কেয়ার। বুঝিয়ে দিল, ব্রহ্মাণ্ডে আরও অনেক কণা রয়েছে, যাদের কথা আমরা এখনও জানি না। এই ব্রহ্মাণ্ড এমন আরও কিছু নিয়মে চলে, যা পদার্থবিজ্ঞানের নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ঘটনা ন’বছর আগে (২০১২) ‘ঈশ্বরকণা’ বা হিগ্স বোসন-এর যুগান্তকারী আবিষ্কারকেও তুচ্ছ করে দিতে পারে।
ইলেকট্রনের মতো হয়তো তার এই তুতো ভাইয়েরও জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণের পর পরই। প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে। বিজ্ঞানীদের সন্দেহটা ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। সেই সন্দেহ যে অমূলক নয়, ব্রহ্মাণ্ডের ‘রহস্য-কুঠুরি’-র দরজা দেখিয়ে দিয়ে এই প্রথম তা বুঝিয়ে দিল ইলেকট্রনের এক তুতো ভাই ‘মিউয়ন’। এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’-সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকায়।
কারা কলকাঠি নাড়ছে ব্রহ্মাণ্ডে?
ইলেকট্রনের এই তুতো ভাইয়ের অদ্ভূতুড়ে আচার, আচরণ এই প্রথম বিজ্ঞানীদের নিশ্চিত ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ১,৩৭০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম ঠিক কী ভাবে হয়েছিল, তার অনেকটাই আমাদের অজানা। জানি না, মহা-বিস্ফোরণের পর ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছিল। জানি না, কেন গোটা ব্রহ্মাণ্ড বেলুনের মতো চার দিকে ক্রমশই উত্তরোত্তর বেশি গতিতে ফুলেফেঁপে উঠছে। কেন একটি ছায়াপথ অন্যটির থেকে দ্রুত গতিতে দূর থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে, জানি না পুরোপুরি। জানা নেই ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য পদার্থ কী দিয়ে তৈরি। যদিও এই ডার্ক ম্যাটারই ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের ৪ ভাগের ১ ভাগ। বাকি প্রায় ৩ ভাগই অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। আমাদের চেনা-জানা কণা এবং পদার্থের ভর সব মিলিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের বড়জোর ২ শতাংশ।
ব্রুকহেভেন থেকে সার্ন, ফের্মিল্যাব: দীর্ঘ পরিক্রমা
তবে এই সব কিছুর পিছনে যে কেউ বা কারা আমাদের কাছে ধরা না দিয়ে কলকাঠি নাড়ছে, তা এ বার স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে ‘মিউয়ন’। মহাকাশ বিজ্ঞানের সবচেয়ে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিত রীতিমতো টলিয়ে দিয়েছে। যে মিউয়ন কণার আবিষ্কার হয়েছিল এখন থেকে ৮৫ বছর আগে। ১৯৩৬ সালে।
আমেরিকার ইলিনয়ের বাটাভিয়ায় ‘ফার্মি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলেটর ল্যাবরেটরি (ফার্মিল্যাব)’-তে ধরা পড়েছে ইলেকট্রনের তুতো ভাই মিউয়নের অদ্ভূতুড়ে আচার-আচরণ। বুধবার (৭ এপ্রিল) ফার্মিল্যাবের তরফে তা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর কিছু দিন আগে (২২ মার্চ) জেনিভায় মাটির নীচে সুড়ঙ্গে ‘সার্ন’-এর ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি)’ গবেষণাগারের একটি পরীক্ষাতেও প্রায় একই রকমের ইঙ্গিত মিলেছিল। সার্ন সেই খবর দিয়ে অবশ্য জানিয়েছিল, এলএইচসি ফের চালু হলে তারা এই পরীক্ষার ফলাফল খতিয়ে দেখবে।
কোথায় চ্যালেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে?
কলকাতার ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি)’-র ইন্সা সিনিয়র সায়েন্টিস্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী নবকুমার মণ্ডল জানাচ্ছেন, পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে, ভরের তারতম্য থাকলেও আমাদের চেনা জানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের (‘লেপটন্স’। যেমন, ইলেকট্রন, মিউয়ন, টাও) মৌলিক ধর্মের কোনও ফারাক নেই। ধর্মের নিরিখে তারা অভিন্নই। সার্ন-এর মার্চের পরীক্ষার ফলাফল সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে কোনও ভারী কণা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে ভেঙে গেলে তা সম পরিমাণে মিউয়ন এবং ইলেকট্রন কণা তৈরি করবে। কিন্তু সার্ন-এর পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল পাল্লাটা ইলেকট্রনের দিকেই একটু বেশি ভারী।
রহস্য-কুঠুরির দরজার হদিশ
বুধবার ফার্মিল্যাবের কণাপদার্থবিজ্ঞানী তথা অন্যতম গবেষক ক্রিস পলি বলেছেন, ‘‘মিউয়নের এই থোড়াই কেয়ার মনোভাব মঙ্গলে নাসার রোভার পারসিভের্যান্স-এর নিখুঁত ল্যান্ডিংয়ের ভিডিয়ো তোলার মতোই যুগান্তকারী এবং গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো ঘটনা।’’ পলির সঙ্গে ওই আবিষ্কারের গবেষণায় কাজ করেছেন সাতটি দেশের ২০০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী। ২০ বছর আগে, ২০০১ সালে আমেরিকারই ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একটি পরীক্ষায় এমন ইঙ্গিত মিলেছিল। কিন্তু খরচের জন্য সেই পরীক্ষাকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য-কুঠুরির দরজা দেখাও যায়নি।
ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সেই পরীক্ষাই ২০ বছর পর করা হয়েছিল ফার্মিল্যাবে। ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলিকে আনিয়ে ও তাদের আরও উন্নত করে তুলে। পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছিল- ‘মিউয়ন জি মাইনাস ২’। গবেষকরা জানিয়েছেন এই পরীক্ষার ফলাফল এতটাই নিখুঁত যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি ৪০ হাজার ঘটনায় মাত্র ১টি।
মেঘের আড়ালের ‘ইন্দ্রজিত’দের হদিশ মিলবে!
নবকুমার বলছেন, ‘‘এটা সত্যি সত্যিই সাড়াজাগানো ঘটনা। কারণ এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডে আরও অনেক কণা বা পদার্থের কথা আমরা এখনও জানি না।’’
নবকুমার জানাচ্ছেন, ইলেকট্রনের দুই তুতো ভাই। মিউয়ন আর টাও কণা। মিউয়ন ২০৭ গুণ ভারী ইলেকট্রনের চেয়ে। আর টাও কণারা মিউয়নের চেয়ে আরও ১৭ গুণ বেশি ভারী। ভারী বলেই মিউয়ন এবং টাও কণারা অস্থায়ী হয়। তেজস্ক্রিয় বিকিরণে ভেঙে যায় ইলেকট্রন ও সবচেয়ে হাল্কা কণা নিউট্রিনোয়। মিউয়ন ভেঙে যায় এক সেকেন্ডের ২২ লক্ষ ভাগের ১ ভাগ সময়ের মধ্যে। এই মিউয়নের একটি বিশেষ ধর্ম রয়েছে। যার নাম- ‘ম্যাগনেটিক মোমেন্ট’। একে ইংরেজির ‘g’ দিয়ে বোঝানো হয়। ৯৩ বছর আগে বিজ্ঞানী পল ডিরাক তাঁর তত্ত্বে দেখান একটি মিউয়নের ক্ষেত্রে এই ‘g’-এর মান হওয়া উচিত ২। কিন্তু পরে জানা যায় এই মিউয়নরা একা থাকে না। তাদের আশপাশে মেঘের মতো থাকে ভার্চুয়াল ইলেকট্রন ও অন্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। ফলে এই ‘g’-এর মান হওয়া উচিত ২-এর বেশি। এই পরীক্ষার নাম তাই দেওয়া হয়েছে ‘মিউয়ন জি মাইনাস ২’।
নবকুমারের কথায়, ‘‘এই g মাইনাস ২-এর মান কত হবে তা নির্ভর করে মিউয়ন কণার আশপাশে মেঘের মতো আর কত রকমের ভার্চুয়াল কণা রয়েছে, তার উপর। মিউয়ন কণার চার পাশে কারা কারা ঘোরে তা জেনে স্ট্যান্ডার্ড মডেল মিউয়ন কণার g মাইনাস ২-এর যে মান নির্ধারণ করেছে, ফের্মিল্যাব-এর পরীক্ষায় সেই মান আরও বেশি হয়েছে। যা বোঝাচ্ছে, আমাদের চেনা জানার গণ্ডির বাইরেও ব্রহ্মাণ্ডে আরও অনেক কণা রয়েছে যারা মিউয়ন কণার চার পাশে মেঘের মতো রয়েছে।’’