জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস সন্ধানে
আরবকে জ্ঞানের বাহক এবং গ্ৰীক কে সমস্ত জ্ঞানের উৎস হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে , সেই জ্ঞান কে গ্ৰহণ করতে উপাসনা-পদ্ধতিগত বিশ্বাসে(Theological beliefs) কোনো বাধা থাকে না। ইতিহাসের ঘটনাক্রমের সামান্য যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ এই মিথ্যাচার কে প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট।
নবম শতাব্দীতে বাগদাদের ব্যাত-আল-হাকিমা (Bayt-al-Hakima) পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত বিশেষত ভারতবর্ষ , পার্সিয়া, চীন থেকে জ্ঞান -বিজ্ঞান সংগ্ৰহ করেছিল।তারা যদি মনে করতো পৃথিবীর সকল জ্ঞানের উৎস গ্ৰীস , তাহলে জ্ঞানের প্রবাহ হতো গ্ৰিক থেকে আরবী ভাষা তে। কিন্তু সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ উল্টো কথা বলে।বাগদাদের লাইব্রেরীর আরবী তে অনূদিত জ্ঞানকে পরবর্তীকালে গ্ৰীসের বলে প্রচার করা হয়।
ব্যাত-আল-হাকিমার(Baghdad House of Wisdom) জ্ঞানের উৎস :
ইসলামীয় আরব ভারতবর্ষ থেকে পাটীগণিত এর বিভিন্ন পুঁথি বিশেষ করে আর্যভট্ট , ব্রক্ষ্মগুপ্ত , বরাহমিহির এর বিভিন্ন গ্ৰন্থ যোগাড় করে ব্যাত-আল-হাকিমা তে আরবি ভাষায় অনুবাদ করে(আল-খোয়ারজমির ‘হিসাব-আল-হিন্দ’)।আমরা জানি যে রোমান অঙ্কে (Roman numerals) কোনো সংখ্যা লেখা এবং গণনা করা কত কঠিন।যেমন রোমান অঙ্কে ৮ লেখা হয় এইভাবে— VII এবং ৯ লেখা হয় এইভাবে—IX।এখন ৩৪৭৮ সংখ্যা টি রোমান অঙ্কে লিখলে দাঁড়াবে এইরকম— MMMCDLXXVIII এইরকম চার অঙ্কের দুটো সংখ্যার যোগ , বিয়োগ , গুণ , ভাগের নিয়ম কতটা কষ্টসাধ্য হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।গ্ৰীক-রোমানরা অঙ্ক লেখার এই পদ্ধতি নিয়ে কতো উৎকৃষ্ট বিজ্ঞান-সাধনা(!) করতে পারছিল তাও বোঝা কষ্টকর নয়। আসলে , গ্ৰীকদের বড় কোনো সংখ্যা নিয়ে গণনার প্রয়োজনই হয় নি এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান এর জন্য প্রয়োজনীয় বড় সংখ্যার গণনা তারা করেই নি। কিন্তু ইউরোপে যখন বড় সংখ্যার গণনার প্রয়োজন হলো , তারা আরবদের সংখ্যা লেখার পদ্ধতি কে অনুকরণ করলো। আরবীয় অঙ্ক ‘স্থান-মান পদ্ধতি’তে (Place-Value System) লেখা হয়।এই ‘স্থান-মান পদ্ধতি’ ভারতবর্ষ থেকে আমদানি করে আল-খোয়ারজমি(Al Khwarizmi) যার ল্যাটিন ভাষায় নাম হয়ে যায় অ্যালগরিসমাস(Algorismas)।এই অ্যালগরিসমাস থেকেই অ্যালগরিদম(Algorithm) কথাটির উৎপত্তি। ভারতীয় ‘স্থান-মান পদ্ধতি’ তে অঙ্ক লেখার পদ্ধতি অনুকরণ করেই ইউরোপে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ সহজ হলো। এবার ‘স্থান-মান পদ্ধতি’ একটু বুঝে নেওয়া যাক—–
আমরা জানি , ৩৪৭৮ এ এককের ঘরের অঙ্ক –৮ , দশকের ঘরের অঙ্ক–৭ , শতকের ঘরের অঙ্ক—৪ ও হাজারের ঘরের অঙ্ক-৩।
হা। শ। দ। এ
৩। ৪। ৭। ৮
এককের ঘরের অঙ্ক কে ১ দিয়ে , দশকের ঘরের অঙ্ক কে ১০ দিয়ে , শতকের ঘরের অঙ্ক কে ১০০ দিয়ে এবং হাজারের ঘরের অঙ্ক কে ১০০০ দিয়ে গুণ করে যোগ করলেই সংখ্যা টি পাওয়া যাবে।
অর্থাৎ সংখ্যাটি হবে
৩×১০০০+৪×১০০+৭×১০+৮×১=৩০০০+৪০০+৭০+৮=৩৪৭৮।
অর্থাৎ ভারতবর্ষের সংখ্যা লেখার পদ্ধতি আরবের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছায়। গণিতে ভারতবর্ষের অবদানগুলির মধ্যে অন্যতম সংখ্যা লেখার ‘স্থান-মান পদ্ধতি'(Place Value System)।
আব্বাসীয় খিলাফতের সময়ে , খলিফার পার্সীয়-বৌদ্ধ বংশোদ্ভূত ওয়াজির(মন্ত্রী)দের উদ্যোগে পার্সিয়া ও ভারতবর্ষ থেকে আনা বইগুলোর অনুবাদ শুরু হয়।এই পার্সীয়-বৌদ্ধ বংশোদ্ভূতদের ‘বার্মাকিড’ বলা হতো অর্থাৎ বার্মাক(প্রমুখ)দের উত্তরসূরী।বৌদ্ধ মঠ ‘নববিহার’ এর প্রধান কে ‘বার্মাক’ বলা হতো।রাশিদুন খিলাফতের সময়ে(৬৩৩-৬৫৪খ্রীঃ)খলিফা উমরের(৬৫১ খ্রীঃ) নেতৃত্বে পার্সিয়ার সাসিনীয়( প্রধানতঃ জোরাস্ট্রিয়ান ধর্মাবলম্বী) সাম্রাজ্যের পতন হলে এই বৌদ্ধ বার্মাকরা ইসলাম গ্ৰহণ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , সাসিনীয় সাম্রাজ্য, কয়েক দশক ধরে খ্রীষ্টিয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একদিকে বাইজান্টাইন আর অন্যদিকে খিলাফতের আক্রমণে চার শতাব্দীর (২২৪-৬৫১ খ্রীঃ) সাসিনীয় সাম্রাজ্যের পতন হলো।
বিভিন্ন উৎস থেকে বই অনুবাদ করার অভ্যাস বার্মাকিডদের আগে থেকেই ছিল। পার্থক্য এইটুকুই যে সাসিনীয় সাম্রাজ্যের সময় তারা পার্সি (পাহ্লভি) ভাষায় অনুবাদ করতো আর এখন খলিফার জন্য আরবী তে অনুবাদ করছে।
ছোটোবেলায় আমরা সবাই নীতি শিক্ষামূলক গল্প পড়েছি বা শুনেছি যেখানে বিভিন্ন পশু-পাখি কে চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।এই গল্পগুলোর উৎস প্রায় ৫০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে সংস্কৃতে লেখা ‘পঞ্চতন্ত্র’।পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী গুলি পার্সি ভাষা থেকে আরবী তে অনূদিত হয় প্রায় ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে।এর আগে সংস্কৃত থেকে পার্সি ভাষায় অনুবাদ করা হয় ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে। পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ ; আমাদের , জ্ঞানের প্রবাহের দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়।গ্ৰিক ভাষায় পঞ্চন্ত্রের অনুবাদ হয় ১০৮০ খ্রীষ্টাব্দে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উৎস সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা গেলেও পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কে অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনো ভারতবর্ষের বিভিন্ন মন্দিরের দেওয়ালে পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী খোদাই করা আছে।পঞ্চতন্ত্র প্রমাণ করে যে জ্ঞানের প্রবাহ ভারত থেকে পার্সিয়া , পার্সিয়া থেকে আরব এবং আরব থেকে খ্রীষ্টিয় ইউরোপ— এই পথেই হয়েছিল।
গ্ৰীকদের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর আকর গ্ৰন্থ অ্যালমাজেস্ট(Almagest)।অ্যালমাজেস্ট , বাগদাদে এসেছিল পার্সিয়া থেকে ; পাশের খ্রীষ্টিয় সাম্রাজ্য বাইজান্টাইন থেকে নয়। অর্থাৎ , এমন প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায় যা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হতে হয় যে তথ্যের প্রবাহ বাগদাদ থেকে খ্রীষ্টিয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে হয়েছিল , উল্টোপথে নয়।এইসমস্ত তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যায় , নবম শতাব্দীর পরবর্তী যে গ্ৰন্থগুলির উৎস গ্ৰীস বলে দাবি করা হয় তা মোটেও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। পরবর্তীকালে আরবি থেকে অনূদিত গ্ৰন্থগুলিকে গ্ৰীসের বলে এই কারণেই দাবি করা হয় যাতে খ্রীষ্টিয় ইউরোপ সেই জ্ঞানে নিজেদের অধিকার দেখাতে পারে এবং ইসলামীয় আরব কে সেইসমস্ত জ্ঞানের সৃষ্টিকর্তা নয় , শুধুমাত্র বাহক হিসেবে দেখাতে পারে।
আমরা দেখলাম খ্রীষ্টিয় ইউরোপ যেমন টলেডোর লাইব্রেরীতে বিভিন্ন বইয়ের আরবী থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিল , তার আগে ইসলামীয় আরব একই কাজ বাগদাদে করেছিল বহুমূল্য প্রাচীন গ্ৰন্থগুলির অনুবাদ পার্সি ভাষা থেকে আরবী তে করে। অর্থাৎ ,বিশ্ববিখ্যাত বাগদাদ ও টলেডো লাইব্রেরীর জ্ঞানচর্চা শুরু হয় অনূদিত বই থেকে। বাগদাদে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন যা কিছু সংযোজন হয়েছিল তার পেছনে এই অনূদিত গ্ৰন্থগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমরা দেখলাম , বাগদাদের লাইব্রেরীর ঔজ্জ্বল্য ছিল পার্সিয়া থেকে আনা অনূদিত বইগুলোর জন্য।টলেডো হোক বা বাগদাদ জ্ঞান-সূর্যের আলো তারা শুধু প্রতিফলিত করেছিলো , জ্ঞান-সূর্যের উদয় করবার মতো সামর্থ্য এদের ছিল না। তাহলে কি পার্সিয়ার ছিলো ? পার্সিয়া তে এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছিল ? না ; পার্সিয়া-টলেডো ও বাগদাদের মতোই জ্ঞানের ব্রক্ষ্মান্ডে এক গ্ৰহ মাত্র , নক্ষত্র নয়। জানতে হলে আমাদের আরো অতীতে যেতে হবে।
আগেই বলা হয়েছে ,বার্মাকিড নামে যাদের পরিচয় আমরা পেলাম তারা তাদের পুরোনো অভ্যাসকেই বাগদাদে অব্যাহত রেখেছিল অর্থাৎ প্রাচীন পুঁথি গুলির অনুবাদ।পার্সিয়া তে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এর জ্ঞান জিজ-ই-শাহরিয়ার(Zij-i-Shahryar) নামে অনূদিত হয়।
পার্সিয়ান সম্রাট প্রথম খসরু (৫৩১-৫৭৯ খ্রীঃ) ভারতবর্ষে নিজের মন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন জ্ঞানের সন্ধানে ; এথেন্স বা আলেকজান্দ্রিয়া তে নয়।দাবা খেলার পদ্ধতি , পঞ্চতন্ত্র , জ্যোতির্বিজ্ঞান , গণিত এর নিয়ম ভারতবর্ষ থেকে পার্সিয়া তে যায় , পাশের খ্রীষ্টিয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে নয়। যদিও সেই সময় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে কিছু নেওয়া , খসরুর পক্ষে যথেষ্ট সহজ ছিল ।কারণ দুর্বল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য সেই সময় খসরু কে যুদ্ধবিরতির জন্য কর দিতে বাধ্য ছিল এবং বাইজান্টাইন এর দার্শনিকরা শরণার্থী হয়ে পার্সিয়া তে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে , সেইসময় গ্ৰীকদের গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান আয়ত্তের মধ্যে থাকলেও(যদি তার অস্তিত্ব থেকে থাকে!) খসরু কেনো তা অনুবাদের উপযুক্ত মনে করেন নি এবং সুদূর ভারতবর্ষ থেকে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান শিখতে নিজের মন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন।
অর্থাৎ ; আমরা দেখলাম অন্ধকার যুগ থেকে শুরু করে ক্রুসেডের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত ইতিহাস , গ্ৰিকদের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উৎকর্ষতার সাক্ষ্য দেয় না।
এইসমস্ত তথ্য থেকে , আমাদের কি এই সিদ্ধান্তে আসা অযৌক্তিক হবে যে , সাধারণ গণনা করার মতো ক্ষমতা গ্ৰীসের না থাকায় গ্ৰীকরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল যতদিন না পর্যন্ত অনূদিত আরবীয় পুঁথির মাধ্যমে নবম শতাব্দীতে ভারতীয় জ্ঞান বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে খ্রীষ্টিয়-গ্ৰিকদের কাছে পৌঁছায় ?
আরবীয় বইগুলোর উৎস হিসেবে গ্ৰীসকে দেখানোর গল্প এই কারণেই ছড়ানো হলো যাতে ক্রুসেডের পূর্ববর্তী সমস্ত জ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে গ্ৰীসকে দেখানো যায় — যে গ্ৰীস এতদিনে নিজেদের পুরোনো সংস্কৃতি ভুলে বা পরিবর্তন করে সম্পূর্ণভাবে খ্রীষ্টিয় উপাসনা-পদ্ধতি অনুসরণ করে ।
আর প্রাচীন গ্ৰিকদের কৃতিত্ব স্বীকার করলে নতুন ইউরোপের হীনমন্যতার কারণ নেই যেহেতু প্রাচীন গ্ৰিকদের অনেক পরেই খ্রীষ্টিয় উপাসনা পদ্ধতি প্রসারলাভ করে এবং দুই সংস্কৃতির সরাসরি সংঘাতের ইতিহাস এতদিনে বহু পুরাতন এবং বিস্মৃত।
( তথ্যসূত্র অন্তিম পর্বে দেওয়া হবে)
পিন্টু সান্যাল (Pintu Sanyal)