১৮ অক্টোবর, শুক্রবার। কেপ ক্যানাভেরালের সময়ের হিসেবে সকাল ৭টা ৩৮ মিনিট। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের (International Space Station-ISS) বাইরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। মহাশূন্যের গা ছমছমে হাড়হিম করা অন্ধকারে পা রাখলেন দুই মহিলা নভশ্চর। মাধ্যাকর্ষণ-শূন্য বা মাইক্রোগ্র্যাভিটির মধ্যে শরীর ভাসিয়ে হেঁটে চলা দুঃসাহসিক কাজ ছাড়া কিছুই নয়। আর পায়ের নীচে যেখানে অনন্ত, অসীম মহাকাশ। সামান্য বিচ্যুতি মানেই ওই মহাশূন্যে নিজেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলা। ক্রিস্টিনা কচ এবং জেসিকা মেয়ার। মার্কিন মহাকাশগবেষণা কেন্দ্র নাসার এই দুই নভশ্চর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন। মহাকাশে হাঁটাহাঁটি করে ‘স্পেসওয়াক’ (Spacewalk) ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে ৬১ এক্সপিডিশনের ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টিনা ও জেসিকা। মহাশূন্যে হাঁটার অভিজ্ঞতা ক্রিস্টিনার আগেই ছিল। এটা তাঁর চতুর্থ ‘স্পেসওয়াক’ আর জেসিকার প্রথম। ২০২৪ সালের চন্দ্রাভিজান ‘Artemis lunar exploration’-এর আগে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন বা আইএসএসে। ‘All Women Spacewalk’-এর লাইভ স্ট্রিমিং সামনে এনে নাসা জানায় ৭ ঘণ্টা ১৭ মিনিট মহাকাশে হেঁটে রেকর্ড করেছেন ক্রিস্টিনা ও জেসিকা।
পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে চলেছে পৃথিবীর বাসযোগ্য স্যাটেলাইট আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। এখান থেকে বেরিয়ে এসে মহাশূন্যে হাঁটাকেই বলে ‘স্পেসওয়াক’। এর আরেক নাম ইভিএ (Extravehicular Activity)। প্রথম ‘স্পেসওয়াক’ হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ১৮ মার্চ। সেটা ছিল মাত্র ১০ মিনিটের। মার্কিন নভশ্চর এড হোয়াইট হেঁটেছিলেন মহাকাশে। ভয় আর শঙ্কার আগল ভাঙলে ক্রমশই নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে মহাশূন্যের অজানা জগতে পা রাখতে শুরু করেন নভশ্চরা। গত অর্ধশতকে এমন অন্তত ৪২০টি ‘স্পেসওয়াক’ হয়েছে। যার মধ্যে সকলেই পুরুষ। ৪২১তম ‘স্পেসওয়াক’ থেকে আসরে নামেন মহিলারা।
সাধারণত দেখা যায় স্পেস স্টেশনে কোনও যান্ত্রিক গলদ দেখা দিলে তার মেরামতি করতে বাইরে আসেন নভশ্চররা। এ বার সেই দায়িত্ব ছিল ক্রিস্টিনা ও জেসিকার উপর। কোনও রোবোটিক আর্ম নয়, প্রযুক্তির সাহায্যও নয়, পায়ে হেঁটেই স্পেস স্টেশনে নির্ধারিত ইউনিটে পৌঁছন দুই মহিলা। ভিতরে থেকে সেই সময় কম্যান্ড দিচ্ছিলেন চারজন পুরুষ নভশ্চর। ইউনিটে পৌঁছে ব্যাটারি লাগিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে নির্দিষ্ট সময়েই ফিরে আসেন ক্রিস্টিনা ও জেসিকা। ‘উইমেন’স হিস্ট্রি মান্থ’-এ ইতিহাস গড়ে নাসা।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পদার্থবিদ, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টিনা এখন নভশ্চর
পড়াশোনা পদার্থবিদ্যায়। পেশায় ছিলেন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। অভিযানের নশা ছিল শিরায়-উপশিরায়। সুদূর দক্ষিণ মেরুর আন্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড সামিটে বহু আগেই নজির গড়েছিলেন ক্রিস্টিনা। অজানার খোঁজে পাড়ি দেওয়াই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। গড্ডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে হাই এনার্জি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষণায় যোগ দেন ক্রিস্টিনা। মহাকাশের রহস্যের খোঁজ করতে করতেই নভশ্চর হওয়ার ইচ্ছাটা আরও গাঢ় হয়।
২০১৩ সালে নাসার স্পেস-মিশনে যোগ দেন। পৃথিবীর মাটি ছাড়েন চলতি বছর ১৪ মার্চ। ইতিমধ্যেই একজন মহিলা হিসেবে মহাকাশে ৩২৮টি পার্থিব দিন কাটিয়ে ফেলেছেন ক্রিস্টিনা। মহাকাশে হেঁটেছেন তিন বার। তবে দীর্ঘ সাত ঘণ্টা ধরে ‘স্পেসওয়াক’ এই প্রথম। আর্টেমিস লুনার মিশনেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে তাঁর।
পেঙ্গুইন নিয়ে গবেষণা জেসিকা মেয়ারের…এখন ‘স্পেসওয়াক’-এ রেকর্ড
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক জেসিকা মেয়ার। পড়াশোনা জীববিজ্ঞানে হলেও পাঁচ বছর বয়স থেকেই নভশ্চর হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন জেসিকা। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে মহাকাশবিদ্যায়। একই সঙ্গে পিএইচডি করেন মেরিন বায়োলজিতে। আন্টার্কটিকায় পেঙ্গুইন নিয়ে তাঁর গবেষণা দীর্ঘদিনের।
২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কাজ করেছিলেন হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে। মহাকাশ-গবেষণায় নেশা থাকায় নাসার স্পেস-ফ্লাইট মিশনেও ভাগ নিয়েছিলেন নানা সময়ে। মাইক্রোগ্র্যাভিটি নিয়ে চর্চা শুরু করেন একটা সময়। নাসার Extreme Environment Mission Operations (NEEMO)-তে জেসিকার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কাজ করেছেন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিতেও (ESA)।
জেসিকা একজন দক্ষ মিশন কন্ট্রোল ক্যাপসুল কমিউনিকেটর (CapCom)। ৪৭ এক্সপিডিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। ‘স্পেসওয়াক’ এই প্রথমবার হলেও আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের যাবতীয় গবেষণা ও মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে জেসিকা মেয়ারের। বর্তমানে নাসার ৬১ ও ৬২ এক্সপিডিশনে রয়েছেন তিনি।
পথ দেখিয়েছিলেন ক্যাথেরিন সুলিভান, নজির গড়েছিলেন বেপরোয়া পেগি হুইটসন..মহাকাশে নারী-শক্তির জয়ের সূচনা ১৯৮৪ সাল থেকে
এসটিএস-৩১ মিশন স্পেশালিস্ট মার্কিন নভশ্চর ক্যাথরিন সুলিভানই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি ‘স্পেসওয়াক’ করে চমকে দিয়েছিলেন বিশ্বকে। তিনবার হেঁটেছিলেন মহাশূন্যের অতলান্ত অন্ধকারে। মহাকাশে কাটিয়েছিলেন ৫৩২ ঘণ্টা। তারপর থেকে ১৪ জন হেঁটেছেন মহাশূন্যে। ৪০টি ভিন্ন স্পেসওয়াকে।
সবচেয়ে বেশি বয়সী মহিলা নভশ্চর যিনি মহাশূন্যে হেঁটে রেকর্ড করেছিলেন তাঁর নাম সকলেরই জানা। তিনি পেগি হুইটসন। ২০১৭ সালে ৫৬ বছর বয়সী পেগি মহাকাশে হেঁটেছিলেন টানা ৬ ঘণ্টা। গত ১৪ বছরে তিন-তিন বার পাড়ি জমিয়েছেন মহাকাশে। প্রথম দু’বারের সফরেই মহাকাশে কাটিয়ে ফেলেছেন ৩৭৭টি পার্থিব দিন-রাত। সেরে ফেলেছেন ৩৯ ঘণ্টা ৪৬ মিনিটের হাঁটাহাঁটি।
মহাকাশে অনেক মহিলাই তাঁদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। নভশ্চর কেট রুবিনস প্রথম যিনি মহকাশে ডিএনএ সিকুয়েন্স বার করেছিলেন। ৪২/৪৩ এক্সপিডিশনে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি থেকে প্রথম ইতালীয় মহিলা সামান্থা ক্রিস্টোফোরেত্তি মহাকাশে গিয়েছিলেন। এলেনা সেরোভা প্রথম রাশিয়ান মহাকাশবিজ্ঞানী যিনি স্পেস স্টেশনে বায়োসায়েন্স নিয়ে গবেষণা চালিয়েছিলেন। ২৪/২৫ এক্সপিডিশনে ১৬৩ দিন স্পেস স্টেশনে থেকে রেকর্ড করেছিলেন মহাকাশবিজ্ঞানী শ্য়ানন ওয়াকার। তিনি গবেষণা চালিয়েছিলেন সেল বায়োলজি (Cell Biology) নিয়ে।
তা ছাড়াও, আর্থ সায়েন্স ডিভিশনের ডিরেক্টর ছিলেন সান্দ্রা কফম্যান। হেলিওফিজিক্স বিভাগে নিকোলা ফক্সের গবেষণা মনে রাখার মতো। প্ল্যানেটারি সায়েন্স ডিভিশনের ডিরেক্টর লোরি গ্লেজের মাইক্রোগ্র্যাভিটির অভিজ্ঞতা বিশাল।
স্পেস স্টেশনে দীর্ঘদিন থাকলে জিনেও বদল আসে, ঝুঁকির তোয়াক্কা করেন না ক্রিস্টিনা ও জেসিকা
মহাকাশে এখনও অবধি মোট ৬৫ জন মহিলা গিয়েছেন। ২০১৮ সাল থেকে মাইক্রোগ্র্যাভিটি নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। বিশ্বের ১০৬টি দেশে প্রায় ৩৬০০ জন মহাকাশবিজ্ঞানী ও নভশ্চর অংশ নিয়েছেন স্পেস-মিশনে। পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে থাকা স্পেস স্টেশনে ছ’মাসের বেশি কোনও নভশ্চর থাকেন না। মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলেন দীর্ঘসময় স্পেস স্টেশনে কাটালে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। মার্কিন নভশ্চর স্কট কেলি ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন। কাটিয়েছিলেন এক বছরের বেশি। আইএসএস থেকে পৃথিবীতে ফেরার পর স্কটকে নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন শুধু শারীরিক (ফিজ়িয়োলজিক্যাল) বদল নয়, জিনের বদলও ঘটেছে দীর্ঘ মহাকাশবাসে।
ক্রিস্টিনা বলেন, “প্রাণের ঝুঁকি থাকলেও ঐতিহাসিক স্পেসওয়াক যে কোনও নভশ্চরের জীবনেরই মূল লক্ষ্য। মহাকাশ-অভিযানের লিঙ্গভেদ নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না। এই অভিজ্ঞতা অনুপ্ররেণা দেবে বাকিদের। আরও অনেক মহিলাই অজানাকে জানতে, অচেনা চিনতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।”
চৈতালী চক্রবর্তী