ঋগ্বেদ সংহিতাকে শুধুমাত্র একটি ধর্মগ্রন্থ বলে যারা মনে করেন তাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। এর দশটি অধ্যায়ের মধ্যে রচিত ১০,৬২২টি ঋক এবং তার সঙ্গে সামবেদ সংহিতার (যা ছন্দার্চিক বা পূর্বার্চিক ও মহানাম্নী আর্চিক বা উত্তরার্চিক) এবং যজুর্বেদ সংহিতার (শুক্লযজুর্বেদ ও কৃষ্ণযজুর্বেদ), এই তিনের মিশ্রণে তৈরি হওয়া এক মহাজাগতিক ত্রিমাত্রিক বিস্ময় যা আমার মত অজ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে ব্যক্ত করা এককথায় একটা অকল্পনীয় ধৃষ্টতার সমান। এই বৃহৎ মহাবিশ্বের গঠন চিত্রের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণও বলে এটা ত্রিমাত্রিক। কিন্তু পৃথিবীতে এখনও এমন একটিও বৈজ্ঞানিক ইকুইপমেন্ট নেই যেটা দিয়ে ঋগ্বেদের গভীরতা মাপা সম্ভব। তবে নিশ্চিত যে বিজ্ঞান কিন্তু একদিন এর সঠিক মূল্যায়ন উপলব্ধি করবে এবং এর ১০০ শতাংশ সঠিক ব্যাখ্যা উন্মোচিত হবেই হবে কিন্তু সেইদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানুষদের কাছে সেই তত্ত্বগুলি আর কোন কাজে আসবে না কারণ পৃথিবীর সময়কাল অনুযায়ী সেটা হবে আমার ভাষায় অন্তরসলিলার যুগ, পূর্ব কল্পে যাকে মহাপ্লাবনের সময় বলা হয়েছিল। আমার পুরানো সব লেখা যারা পড়েছেন তাদের কাছে এর অর্থ হয়তো কিছুটা পরিষ্কার। তবে এর বেশি ভূমিকা না দিয়ে মূল বিষয়বস্তুর উপর আজ আলোকপাত করব।
প্রচেতা কি এবং কী এর ভূমিকা এটাই হবে এই পোস্টের আলোচ্য বিষয়।
ঋগ্বদের ৭ম অধ্যায়ের ১৭নং সুক্তের ৫নং এ ঋষি বশিষ্ঠ লিখিত একটি ঋক দিয়ে শুরু করছি-
“বংস্ব বিশ্বা বার্ষ্যাণি প্রতেতঃ সত্যা ভবন্ত্বশিষো নো অদ্য”
অব্যয়- বংস্ব অর্থে কেন্দ্রস্থ, বিশ্ব অর্থে বিশ্বের, বার্ষ্যাণি অর্থে বরণীয়, প্রচেতঃ অর্থে প্রচতা, ভবন্ত্বশিষো (ভবন্তু+আশিষ) অর্থে আশিষ স্বরূপ হও, নো অর্থে আমাদের, অদ্য অর্থে আজ।
অর্থ- বিশ্বের কেন্দ্রস্থ বরণীয় প্রচেতা আজ আমাদের সত্যের আশিষ স্বরূপ হও।
বিঃ দ্রঃ- এই শ্লোকটির কোন তথাকথিত পন্ডিতের মর্মার্থ করা মানে দেখলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে।©️ শান্তনু দাশগুপ্ত
এখন প্রশ্ন, কে এই প্রচেতা? তাকে বিশ্বের কেন্দ্রস্থ বলা হল কেন? এর খোঁজ করলে একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভান্ডার চোখের সামনে খুলে যাবে। ঋগ্বেদ সংহিতা একথা বলে যে পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এই গ্যালাক্সির কর্ণধার সূর্য স্বয়ং ব্রহ্ম যার পরিচালন ব্যবস্থা আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত নক্ষত্রমালিকার (Milky way) সুচারু ব্যবস্থাপনার একটি জীবন্ত অঙ্গ হিসেবে সদা কার্যরত রয়েছে। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রকে আবর্তন করে ইংলিশ আলফাবেট 9এর আকৃতিতে ঘূর্ণিয়মান প্রত্যেকটি নক্ষত্র, নিহারিকা ও সমগ্র মৌলের আঁধারগুলির একটি নির্দিষ্ট সময়কাল ও পথ নির্ধারিত হয়ে আছে। ঋষিদের দ্বারা ঋগ্বেদে লিখিত ঋক এবং ততসহ অন্যান্য কিছু দিকনির্দেশক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে এই ছায়াপথে সূর্যের ভূমিকা কি এবং ঠিক কত বছর এর পরিক্রমা কাল নির্ধারিত হয়ে আছে। আমাদের সমগ্র ছায়াপথের সম্পূর্ণ নক্ষত্রমন্ডলীর যে ক্লাষ্টার ঋষিরা করে দিয়েছিলেন তার সংখ্যা ২৭ । এর মানে ২৭ টি ক্লাস্টারের মধ্যে মূখ্য ভূমিকাযুক্ত তারাগুলির এক একটি গুচ্ছ সহ মোট ১০৫৬টি নক্ষত্রের উপর অর্পন করা হয়েছে। এটাকে একটি শ্রেনীবিভাজন বলে যা পৃথিবীতে উপস্থিত যে কোন বিষয়ের উপর তাত্ত্বিক ভাবে প্রযোজ্য। ঠিক এর ঘূর্ণনের অন্য একটি বিষয়ও তাঁদের উপলব্ধির মধ্যে ছিল, তা হল ‘মেরু তারকা’। মহাজাগতিক দিক থেকে পৃথিবী যেমন ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ঠিক তেমন ভাবে গতিশীল সূর্য স্বপরিবারে ২২৫ মিলিয়ন (আনুমানিক) বছরে তার নিজের মিল্কিওয়ে গ্যালাকটিক সেন্টারকে পরিভ্রমণ করতে সময় নেয়। অন্যদিকে সূর্যের “প্লাটনিক ইয়ার” বা যাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার “গ্রেট ইয়ার” বলে, তা হল ২৫,৮০০ বছরে উপরে উল্লেখিত ২৭ টি নক্ষত্রমন্ডলীকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসার সময়। যদিও সূর্য থেকে পৃথিবীতে দূরত্বের কারণে এই সংখ্যাটা ১২০ বছর বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় মোট ২৫,৯২০ বছর। প্রতি ৭২ বছরে সূর্যের এক ডিগ্রী করে সরণের জন্য ৩০° করে এক একটি রাশির হিসাবে মোট ১২ টি রাশির জন্য তৈরি করা এক পূর্ণ বৃত্ত ৩০°X১২= ৩৬০° ভ্রমণের জন্য ৭২ বছর X ৩৬০°= ২৫,৯২০ বছর সময় লাগে। এই বৃহত্তর সময়কালে সমগ্র ছায়াপথের যে যে নক্ষত্রমন্ডলী গুলিকে লক্ষ্য করে সূর্যের গতিপথ চিহ্নিত করে আছে মাইলস্টোন হিসাবে তার নাম দেওয়া হয়েছে “মেরুতারকা”। একটি রিলে রেসে যেমন ভাবে লক্ষ্যে থাকা বিষয়টির পরিবর্তন হয় না এবং তার কাছে পৌঁছে গেলেই একমাত্র লক্ষ্যর পরিবর্তন হয়ে নতুন লক্ষ্য স্থির হয়, যতক্ষণ না সম্পূর্ণ গোলাকার মাঠের পরিভ্রমণ সম্পূর্ণ হচ্ছে, তেমনই এই ২৫,৯২০ বছরের দীর্ঘ সময়ে সূর্যের মোট ৭টি নক্ষত্রমন্ডলীর একটি করে তারা লক্ষ্য স্থির হয়ে আছে, যাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে ভূমেরু তারকা বলা হয়ে থাকে। রাত বা দিনের আকাশে সব তারকাদের পরিভ্রমণ ঘটতে থাকলেও ভূ-মেরু তারকা সব সময় পৃথিবী থেকে স্থির ভাবে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে ততক্ষণ না তার সময়কাল শেষ হয়ে যায়। ঠিক এই কারণেই ধ্রুবতারার (Alpha Ursae Minoris) নাম Polestar হয়েছে। উত্তরের আকাশ বিগত ২০১৯ বছর ধরে শিশুমার নক্ষত্রমন্ডলী বা Ursa Minor নক্ষত্রপুঞ্জের লেজের এই তারাটি আমাদের মেরুতারকার ভূমিকা পালন করে চলেছে। বছরের সব রাতের আকাশে তারাদের গতিপথ পরিবর্তন হলেও এই নক্ষত্রটির অবস্থানের পরিবর্তন হয় না যদিও এই তারকার পরিবর্তন গত ১০০ বছর ধরে নতুন করে সংগঠিত হয়ে চলেছে এবং উত্তর মেরুর চৌম্বকক্ষেত্রের অবস্থানের পরিবর্তন হবার কারণে যা Ursa Major নক্ষত্রপুঞ্জের Merak এর স্থলাভিষিক্ত সংগঠিত হবার অভিমূখে রয়েছে। এটি ঋগ্বেদের কাছে একটি মহাজাগতিক সত্য কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানের কাছে একটি আধুনিক বিজ্ঞান। এর সপক্ষে এই লিঙ্কটি দিলাম দেখে নেবেন কিভাবে মেরুতারকার পরিবর্তন ঘটছে।©️শান্তনু দাশগুপ্ত
যে ঋকটি আমি এখানে তুলে ধরেছি সেই ঋকটির রচনা হবার সময়কালেই প্রচেতা ছিল আমাদের পৃথিবীর মেরুতারকা যাকে বৈজ্ঞানিক নক্ষত্রমন্ডলী নামাঙ্কন অনুযায়ী Draconis Constellations বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ঋষি বশিষ্ঠ তাকেই বরণ করে নিয়েছেন এই ঋকটির মাধ্যমে।
অয়ন অর্থ সঞ্চার, স+অয়ন= সায়ন, সঞ্চারের সঙ্গে যার গতি নির্ধারিত। এখন সায়ন গতি অর্থে কার সঙ্গে কার গতি? সূর্যের সঞ্চারের সঙ্গে পৃথিবীর গতির নাম সায়ন গতি। আর এই সায়ন গতি হল মেরুতারকার কালবিধান কর্তা। ঋগ্বেদের বিশ্বদেবগণ বা উত্তরাষাঢ়া (Sagittarius) নক্ষত্রের, যাকে Harcules বলে, তার শীর্ষবিন্দু থেকে অনুরাধা (Antares, Scorpionis) নক্ষত্রের উপরিভাগে অবধি সূর্যের সঞ্চারপথের দিকচক্রের পশ্চিমভাগ Draconis Constellations অর্থাৎ প্রচতা নক্ষত্রমন্ডলী তারা পৃথিবীর মেরুতারকা হিসাবে মোট ৫১৬০ বছর ধরে পৃথিবীর দক্ষিন প্রান্তে পরিব্যাপ্ত ছিল। ঋগ্বেদের অনেক ঋক্ এই প্রচেতা নক্ষত্রের সাক্ষী বহন করে লিখিত আছে। বেদের পরবর্তী কালে রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা বাল্মীকি তাঁর রচনায় “আমি দশম প্রচেতা” বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন।
Draco বা তক্ষকমন্ডলী পৃথিবীর উত্তর আকাশে অবস্থিত একটি তারকামন্ডলী এবং অষ্টম বৃহত্তম নক্ষত্রমণ্ডল হিসাবে পরিচিত। ল্যাটিন ভাষায় এর নামের অর্থ ড্রাগন বা ড্রোকোনম যার অর্থ “বিশাল সর্প” এবং নক্ষত্রটি বর্তমানে উত্তর আকাশের মধ্য দিয়ে যায়।
টলেমির বর্ণিত ৪৮টি নক্ষত্রমন্ডলীর অন্যতম। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে সারা বছরই এই নক্ষত্র মন্ডলী দৃশ্যমান থাকে এবং রাতের আকাশ থেকে কখনই এটি অস্ত যায় না।©️ শান্তনু দাশগুপ্ত
নক্ষত্রের অন্যান্য নক্ষত্রগুলির মধ্যে রয়েছে একটি বিশেষ নক্ষত্র যার নাম থুবান (Thuban – α Draconis), যা এর পুচ্ছকে গঠন করে। যেহেতু পৃথিবী তার অক্ষগুলিতে কাঁপছে (যাকে বলা হয় প্রিসেশন)তাই এর নড়াচড়া পৃথিবী থেকে পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন মিশরীয়রা যখন পিরামিড তৈরি করছিলেন তখন থুবান (Thuban – α Draconis) ছিল পৃথিবীর মেরুতারকা। এই বিষয়ে সমগ্র বিশ্ববাসী না জানলেও মিশরের পিরামিডে খোদিত হয়ে আছে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাওয়া সেই বিজ্ঞান যাকে বিশ্বের বিজ্ঞজনেরা অন্তত জানেন। তেমনই পবিত্র বাইবেলে লেখা আছে প্রতাপশালী রাজা হেরোদের আমলে যিহুদীয়া বেথলেহেম শহরে যিশুর জন্ম হয়। সেই সময়ে প্রাচ্য থেকে কয়েকজন জ্যোতিষী জেরুজালেমে এলেন। তাঁরা জানতে চাইলেন, –
“ইহুদিদের যে রাজা জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি কোথায়? প্রাচ্যের আকাশে তাঁর জন্মের প্রতীক তারার উদয় আমরা দেখেছি। আমরা এসেছি তাঁকে প্রণাম করতে।” (Matthew 2:1-2)।
এটাই ছিল শিশুমার নক্ষত্রের ধ্রুবতারা স্থলাভিষেকের প্রমাণ। এছাড়াও বাইবেলে শিশুদের যীশুর কাহিনীতে এটা দেখানো হয়েছে বিশাল সর্প Draconis পরবর্তীতে উদিয়মান প্রভু যীশু।
আকাশের দিকচক্রের পশ্চিমভাগের প্রচেতা নক্ষত্রমালিকা ৫১৬০ বছর ধরে ভূ-মরু অতিক্রম করেছিল। তার পর আজ থেকে ২০১৯ বছর আগে ২য় খ্রিষ্টাব্দে তার জায়গায় এগিয়ে এসে ভূ-মেরুর উত্তর দিকচক্রের শিশুমার নক্ষত্রের (Alpha ursa Minor) ধ্রুবতারা (Polestar) স্থলাভিসিক্ত হয়ে বিচরণ করছে।
এখানে Draconis Constellations এর একটু পরিচয় দেই।
Draconis তারকারা খুব বেশি উজ্জ্বল নন। ড্রাগনের মাথাটি চারটি তারা (বিটা, গামা, অনু ও শি ড্রাকোনিস) নিয়ে থাকে ট্র্যাপিজয়েডে এবং হারকিউলিসের ঠিক উত্তরে অবস্থিত। সেখান থেকে, ড্রাগনের দেহ আকাশের দিকে এঁকে বেঁকে বিগ ডিপার এবং লিটল ডিপারের মধ্যে শেষ হয়।
মোট ১৫ টি মূল তারা নিয়ে গঠিত এই Draconis Constellations এর পরিচিতি দিলাম:-
Eltanin – γ Draconis (Gamma Draconis)
Rastaban – β Draco
Kuma – ν Draconis (Nu Draconis)
Grumium – ξ Draconis (Xi Draconis)
Altais – δ Draconis (Delta Draconis)
Tyl – ε Draconis (Epsilon Draconis)
Batentaban Borealis – χ Draconis (Chi Draconis)
Batentaban Australis – φ Draconis (Phi Draconis)
Aldhibah – ζ Draconis (Zeta Draconis)
Aldibain – η Draconis (Eta Draconis)
Θ Draconis (Theta Draconis)
Edasich – ι Draconis (Iota Draconis)
Thuban – α Draconis (Alpha Draconis)
Shǎowèi – κ Draconis (Kappa Draconis)
Gianfar (Giausar) – λ Draconis (Lambda Draconis)
এছাড়াও অন্যান্য তারাগুলি যা পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তা হল:-
Ο Draconis (Omicron Draconis)
Alsafi – σ Draconis (Sigma Draconis)
42 Draconis
Arrakis – μ Draconis (Mu Draconis)
26 Draconis
BY Draconis
Struve 2398 – HD 173739/HD 173740 (Gliese 725)
Kepler-10
GD 356 এবং অন্যান্য।
©️শান্তনু দাশগুপ্ত
রামায়ণে লিখিত আছে সাধুসন্তদের ভিরের মাঝে সীতা সহ পুত্রদের নিয়ে এগিয়ে এসে ঋষিশ্রেষ্ঠ বাল্মিকী প্রভু শ্রী রামকে বলেছিলেন, –
“হে দাশরথি! ধৰ্ম্ম চারিণী, স্বত্রতা, এই সীতা লোকাপবাদ হেতু আমার আশ্রম সমীপে পরিত্যক্ত হইয়াছিলেন। হে মহাব্ৰত রাম! ইনি এক্ষণে লোকাপবাদ তীত তোমার নিকট প্রত্যয় প্রদান করিবেন: তুমি অনুজ্ঞ কর। এই দুই দুৰ্দ্ধৰ্ম যমল জানকীপুত্র তোমারই পুত্র, ইহা আমি তোমাকে সত্য বলিতেছি। হে রাঘব নন্দম! আমি প্রচেতার দশম পুত্র, আমি মিথ্যা বাক্য স্মরণও করি না; ইহারা তোমারই পুত্র”।
বাল্মীকি হলেন প্রচেতাপুত্র। ‘প্রচেতা’ শব্দের অর্থ হল প্রকৃষ্ট জ্ঞান (ঋগ্বেদ ১.৪৩.১) — প্রকৃষ্ট চেতঃ যাহার। ‘পুত্র’ (পুৎ+√ত্রৈ+অ (ক)-ক) এই প্রকৃষ্ট জ্ঞানবানকে ত্রাণ করেন এবং তিনিই বাল্মীকি। ‘চেতঃ’ বা ‘জ্ঞান’ শব্দটির তাৎপর্য গভীর।
এখন এই প্রচেতা নক্ষত্রের ৫১৬০ বছর, + ২৪ বছর ( ১২০÷২৫৮০০X৫১৬০ বছর) + শিশুমার নক্ষত্রের ২০১৯ বছর (২য় খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০২১ পর্যন্ত)= ৭২০৩ বছর পূর্বে অর্থাৎ ৫১৬০+২৪= ৫১৮৪ খ্রীঃ পূঃ প্রচেতা নক্ষত্রের আগমনের সময়কাল নির্ধারিত হবে আজ থেকে ৭২০৩ বছর পূর্বে অর্থাৎঋগ্বেদ সৃষ্টির সময়কাল ছিল এর ঠিক ৯০৫ বছর বাদে অর্থাৎ সোম দেবতার যুগের প্রায় মধ্যস্থল। প্রচেতার আগে Lyra Constellation (নক্ষত্রমন্ডলী)এর উজ্জলতম নক্ষত্র অভিজিৎ (Vege) ছিল ভূ-মরুতারকা, যার শেষ সময়কাল ৫১৮৩ খ্রীঃ পূঃ যখন রুদ্রের যুগের (Beteleguse) মধ্যবর্তী অবস্থান। ঐ সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিবরণ আমি পূর্বেই আমার অন্য একটি লেখায় আগেই উল্লেখ করেছি।
https://www.facebook.com/groups/1986155931647573/permalink/2797045673891924/
তাই সামাজিক অবক্ষয় ও বিচ্ছিন্ন মানসিকতার কারণে প্রচেতা নক্ষত্রের আগমনের বার্তা ঋষিকুল হয়ত বিচারের মধ্যে আনেননি। প্রচেতা নক্ষত্রটির আগমনের ৯০৫ বছরের মধ্যেই ঘটে গেছে সেই সব ঘটনা যার কারণে তৈরি হয়ে আর্যকূলের বহিরাগত তথ্যটির উপস্থাপনা যার প্রায়শ্চিত্ত আজও বহন করে চলেছি আমরা।
না তো আর্যরা বহিরাগত ছিলেন, এটা যেমন ধ্রুবসত্য আর না তো একথা মিথ্যা যে ইরানের মালভূমি মানে শাকদ্বীপ থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে হয়ে, বর্তমানে আফগানিস্তানের উপর দিয়ে এই ভারতবর্ষে মানে তৎকালীন জম্বুদ্বীপে আর্যদের প্রবেশের তথ্য মিথ্যা। দুটোই সত্য কিন্তু তার ব্যাখ্যা কারুরই জানা নেই, এখানেই দন্দ্বের জন্ম। আমার মনে হয়েছে ২৪০ থেকে ৩০০ বছরের মত একটি বিপুল পরিমাণ সময়ে যদি কোন জাতির একটি অংশ তার নিজ আদি বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীর একটি অন্য আবহাওয়া যুক্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে, তবে সেই অঞ্চলের প্রকৃতি আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলে মিশে রং রূপ ও চরিত্রের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হবেই হবে। তাই হয়েছিল। এই কারণেই বহিরাগত আর্যদের রক্তে কিছুটা ক্যাম্পিয়ান, কিছুটা অস্ট্রেলাইড ও কিছুটা আলপাইন সংস্কৃতি মিশে ছিল। ঠিক এই বিষয়ে আমার আরো একটি লেখা রয়েছে।
https://www.facebook.com/groups/1986155931647573/permalink/2784970688432756/
ঋষি বশিষ্ঠ, ঋষি অগস্ত্যের কাছে বিশ্বামিত্রের পরাজয়ের কারণ ঠিক এখানেই লুকিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়দের কাছে অগস্ত্যের ছিলেন দুর্বার এক বিভীষিকাময় ঠিক তেমন ভাবেই পুনর্বসু নক্ষত্রমন্ডলী (Gemini Constellations) এর Castor নক্ষত্রে সময়কাল ছিল ৬৬৪২ খ্রীঃ পূঃ থেকে ৫৬৮২ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত আদিত্য দেবতাদের সময়কাল এবং এটাই ছিলো সিন্ধু সভ্যতার সূচনার সঠিক সময়কাল। মনে রাখতে হবে একটা সভ্যতা যেরকম একদিন তৈরি হয় না তেমন ভাবেই একদিনেও ধ্বংস হয়ে যায় না। সঠিক সহাবস্থান যেরকম একটু একটু করে শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ তৈরি করে ঠিক তেমন ভাবেই বিভেদ তৈরি হলে একটু একটু করে তা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। ঋগ্বেদের ৩য় মন্ডল ও ৭ম মন্ডলের পরস্পর বিরোধী ঋকের শক্তিকে প্রকাশের মাধ্যমে এই ধ্বংসের ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে। কালের ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে যাকে কেউ মুছে দিতে পারেনি সেই ঋগ্বেদকে আমরা বিজ্ঞান দিয়েই একদিন প্রতিষ্ঠা করব। ©️শান্তনু দাশগুপ্ত
প্রচেতা নক্ষত্রমন্ডলীর ভূ-মেরুতারকা থাকাকালীন সুদীর্ঘ ৫১৮৪ বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর বহু কিছুর গঠন ও ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে আছে। প্রচেতা যেমন বেদের সৃষ্টির জন্য দায়ী তেমন ভাবেই হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার বিনাশ সহ আরব সাগরের তলায় ঘুমিয়ে থাকা শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীর পতনের জন্য সম পরিমাণ দায়ী। Oceanology তথ্য কিন্তু সে কথাই বলে। ঠিক তেমনি ২য় খ্রিষ্টাব্দে স্থলাভিসিক্ত বর্তমানে ভূ-মেরুতারকা ধ্রুবতারা কিন্তু ৫১৮৪ বছর ধরে আরো কিছু ধ্বংস ও একটা সুবিশাল প্রকৃতির বিপর্যরের সাক্ষী হয়ে থাকবে। বিগত ১০০০ বছর ধরে আমাদের সভ্যতা, স্থাপত্যশৈলীর ধ্বংসের যেমন সাক্ষী হয়ে রইল ধ্রুবতারা, তেমনই শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র, ১২০০০ বছরের শেষের এই কল্পে পৃথিবীর একমাত্র বিনাশের কারণ হয়ে দ্বারাবে। শেষ করার আগে শুধু একটাই কথা বলব পৃথিবীর ছায়াপথে প্রতি ২৫৯২০ বছরে সপ্ত ভূ-মেরুতারকার আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁরা পৃথিবীর বুকে তাঁদের ছাপ ফেলে যায়, এটাই একমাত্র সত্য। কেউ এটাকে অস্বীকার করলে এটা মিথ্যা হয়ে যাবে না কারণ এটাই জ্বলন্ত বিজ্ঞান।
“বাঙমে মনসি প্রতিষ্ঠিতা, মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্
আবিরাবীর্ম এধি বেদস্য ম আনীস্থঃ শ্রতং মে মা প্রহাসীঃ”।
বৈদিক বাক্ আমার মনে প্রতিষ্ঠিত হোক, আমার মন বেদবাক্যে প্রতিষ্ঠিত হোক, সত্য আমার নিকটে আবির্ভূত হোক, বেদের কেন্দ্রস্থ বিজ্ঞানশ্রুতি আমি যেন পরিহার না করি।
ছবি: নাসার ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত।
©️শান্তনু দাশগুপ্ত।
লেখা ও সংরচনা: শান্তনু দাশগুপ্ত।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার বেলা বাসিনী গুহ’র কাছে।