সত্যিই সত্যিই জল আছে চাঁদে। জলের অণুর খোঁজ মিলেছে চাঁদের গহ্বরে। সূর্যের আলো চাঁদের যে অংশকে আলোকিত করে, জল আছে সেখানেই।
যুগান্তকারী খোঁজ দিয়েছে নাসা। পৃথিবীর আত্মজা চাঁদের বুকে জল আছে কিনা সে নিয়ে এতদিন এত হইহই রইরই। চাঁদের মেরুতে বরফ জমে আছে এ খোঁজ আগেই দিয়েছিল নাসা, ইসরো। এবার পাকাপাকিভাবেই নাসা ঘোষণা করে দিল, জল আছে চাঁদে। হিমশীতল, অন্ধকার পিঠে নয়, বরং চাঁদের আলোকিত পিঠেই।
নাসার সোফিয়া অর্থাৎ স্ট্র্যাটোস্ফেরিক অবজারভেটরি ফর ইনফ্র্যারেড অ্যাস্ট্রোনমি (SOFIA) একপ্রকার নিশ্চিত করেছে যে চাঁদের ক্লেভিয়াস গহ্বরে হাইড্রজেন ও অক্সিজেন মৌল জোট বেঁধে H2O জলের অণু তৈরি করেছে। চাঁদের পিঠে হাইড্রজেনের খোঁজ মিলেছিল। কিন্তু এই হাইড্রজেন, অক্সিজেনের সঙ্গে কোন রাসায়নিক ফর্মুলায় জোট বেঁধেছে সেটা জানা যায়নি এতদিন। নাসা জানিয়েছে, ক্লেভিয়াস ক্রেটারে ১২ আউন্স মতো জল জমে আছে। চাঁদের মাটি ও ধূলিকণায় এক ঘনমিটার অবধি জায়গা জুড়ে সেই জলের অণু ছড়িয়ে আছে।
চাঁদের দক্ষিণ পিঠে দ্বিতীয় বৃহত্তম গহ্বর ক্লেভিয়াস। রে-ক্রেটারের দক্ষিণে এই গহ্বরের নাম রাখা হয়েছে জার্মান গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ক্লেভিয়াসের নামে। চাঁদের বুকে তৈরি সবচেয়ে পুরনো গহ্বরগুলির মধ্যে একটি এই ক্লেভিয়াস। বিশাল এই ক্রেটারের মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তা জানার চেষ্টা চলছিল এতদিন। নাসার বোয়িং ৭৪৭এসপি জেটলাইনার ‘সোফিয়া’ ৪৫ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে চাঁদের গহ্বরগুলির দিকে সতর্ক নজর রেখেছিল। নাসা ও জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে জেটলাইনার সোফিয়া। মূলত এয়ারবোর্ন অবজারভেটরি। এই জেট প্লেনের পেটের ভেতর রয়েছে বিশাল টেলিস্কোপ। ইনফ্র্যারেড অ্যাস্ট্রনমির জন্য বানানো হয়েছে এই টেলিস্কোপ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্তরের উপর নজরদারি করে সোফিয়া। তারই ইনফ্র্যারেড টেলিস্কোপে ধরা পড়েছে ক্লেভিয়াস ক্রেটারে রয়েছে জলের অণু।
‘নেচার অ্যাস্ট্রনমি’ জার্নালে এই গবেষণার রিপোর্ট সামনে এনেছে নাসা। এই গবেষণার নেতৃত্বে থাকা ক্যাসি হোন্নিবল বলেছেন, এতদিন মনে করা হত চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অন্ধকার পিঠে জল জমে থাকলেও থাকতে পারে। এই আবিষ্কারের পরে সেই ধারণা বদলে গেছে। সোলার সারফেস অর্থাৎ চাঁদের যে পিঠে সূর্যের আসো পড়ে সেখানেই খোঁজ মিলেছে জলের। এই গবেষণা আরও বড় লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে।
নাসার অ্যাপোলো বলেছিল চাঁদের পিঠ শুষ্ক, ইসরোর চন্দ্রযান বলেছিল বরফ জমে আছে চাঁদে
১৯৬৯ সালে নাসার অ্যাপোলো মিশনে জানা গিয়েছিল চাঁদের পিঠ একেবারে রুক্ষ, শুষ্ক। জলের ছিটেফোঁটাও থাকতে পারে না। পরবর্তীতে ‘নাসার লুনার ক্রেটার অবজারভেশন অ্যান্ড সেন্সিং স্যাটেলাইট’ জানান দিয়েছিল, শুষ্ক নয় চাঁদের পিঠ, বরং বরফ জমে আছে চাঁদের মেরুতে। এরপরে নাসার একাধিক চন্দ্র-অভিযানে সে প্রমাণ মিলেছে। ক্যাসিনি মিশন, ডিপ ইমপ্যাক্ট কমেট মিশনে মহাকাশবিজ্ঞানীরা একই কথা বলেছিলেন। ইসরোর প্রথম চন্দ্রযাত্রা তথা চন্দ্রযান-১ মিশন সফল না হলেও, মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলেছিলেন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বরফ জমে আছে সেটা ধরা পড়েছিল চন্দ্রযান-১ এর অরবিটারে।
অক্সিজেন আছে চাঁদে
চাঁদে হাইড্রজেন আয়ন আছে সে প্রমাণ আগেই মিলেছিল। অক্সিজেন যে আছে তা প্রমাণ হয়েছে এর মধ্যেই। ইসরোর চন্দ্রযান-১ এর পাঠানো ছবি ও তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, চাঁদের মেরুতে মরচে ধরছে। যার মানে চাঁদের ধূলিকণায় জমে থাকা লোহার সঙ্গে অক্সিজেনের বিক্রিয়া হচ্ছে। চাঁদের লোহা, জল আর অক্সিজেন মিশে গিয়ে মরচে ধরতে শুরু করেছে। আর এই ঘটনা এক আধদিনের নয়। কয়েক কোটি বছর ধরেই মরচে পড়ছে চাঁদে। ক্ষয় হচ্ছে দুই মেরুতে।
বিজ্ঞানীদের দাবি, পৃথিবী থেকেই অক্সিজেন উড়ে যাচ্ছে তার আত্মজার কাছে। সেটা কীভাবে? সৌরঝড়ের হাত থেকে পৃথিবীকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার। এখান তড়িৎ-চুম্বকীয় কণার স্রোত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু চাঁদে পৃথিবীর মতো এমন সুরক্ষার আবরণী নেই। তার ভরসা পৃথিবীর আঁচলই। কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ যখন পৃথিবীর পিছনে চলে যায় তখন তার সামনে একটা সুরক্ষার বর্ম তৈরি হয়। সেই সময় যদি মহাশূন্যে সৌরঝড় ধেয়ে আসে তাহলে চাঁদের খুব একটা ক্ষতি করতে পারে না। চাঁদকে রক্ষা করে পৃথিবীর আঁচল এই ম্যাগনেটোস্ফিয়ার। আবার এই ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন পৌঁছে যায় চাঁদে। গবেষকরা বলছেন, পৃথিবী যখন আবর্তন করে তার সঙ্গে এই ম্যাগনেটোস্ফিয়ারও ঘুরপাক খায়। এইভাবে আবর্তনের সময় চাঁদের যে অংশ এই ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের কাছাকাছি আসে সেখানে পৃথিবী থেকে ছিটকে বেরনো অক্সিজেন আয়ন পৌঁছে যায়। রাতের দিকে এই অক্সিজেন পৌঁছনোর মাত্রা বেশি হয়। কারণ ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের বিস্তৃতি রাতের দিকেই বাড়ে। চাঁদের যে পিঠ পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের কাছে আসে সেখানে অক্সিজেন পৌঁছয় এবং সেই অংশই সৌরকণার হাত থেকেও রক্ষা পায়।