“আয়ুর্বেদ রসায়নে আচার্য প্রফু্লচন্দ্র রায়”

ভারতের প্রথম রাসায়ানিক দ্রব্য ও ওষুধ তৈরির কারখানা
বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটক্যালসের প্রতিষ্ঠাতা ও
মার্কারি নাইট্রাইটের আবিষ্কারক,
স্বাধীনচেতা বিজ্ঞান সাধক অধ্যাপক বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিন।

যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম বাংলা ও বাঙালিকে এক নতুন পরিচিতি দিয়েছে সেই মহামানব টি জন্মেছিলেন ২ আগস্ট ১৮৬১ অবিভক্ত বাংলাদেশের রাড়ুলি গ্রামে।
ডাকনাম ছিলো ফুলু।
বই পাগল ছেলেটি ১৮৭০ এ কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন কিন্তু রাতজেগে পড়াশোনার ধকল শরীর সইতে না পারায় হজমের সমস্যা ও রক্ত আমাশয় রোগে কাহিল হয়ে গ্রামে ফিরে যান। সেইসময়
পিতার লাইব্রেরীতে বিভিন্ন ধরনের বই পড়া ছিলো তার নেশা।
জানতে গেলে পড়তেই হবে এই আপ্তবাক্য নিয়ে সবসময় ডুবে থাকতেন পড়ার জগতে।
১৮৭৪ কলকাতার আলবার্ট স্কুলে পুনরায় ভর্তি হন।
সেখান থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজ তারপর ১৮৮১তে প্রেসিডেন্সিতে বি.এ তে ভর্তি হন এবং গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি পাশ করেন।
পরবর্তীতে ১৮৮৮ তে প্রেসিডেন্সিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

আবিষ্কার:

রসায়ন প্রেমী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র সর্বদা
“বিজ্ঞানের মৌলিক ভিত্তি পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ”
এই নীতিমালার উপর অনড় – অচল মনোভাবাপন্ন ছিলেন।
ক্রমেই ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইড আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে এছাড়াও তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২ টি যৌগিক লবন আবিষ্কার করেন।

আয়ুর্বেদ রসায়নে প্রফুল্লচন্দ্র:

আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রাচীনতা,শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবময় চিকিৎসা খ্যাতির অন্তরালে নিরন্তর পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চার অভাব যে ক্রমশ বাড়ছিলো বলতে গেলে তা প্রথম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের দৃষ্টিগোচরে আসে।

একাধারে পরীক্ষাবাদী বিজ্ঞানচর্চার একনিষ্ঠ সাধক অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতি স্বদেশী ধারার গবেষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র নেমে পড়েন হারানো বিজ্ঞানের গুপ্তধনের সন্ধানে।
উনিশ শতকের শেষদিক।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
কর্মসূত্রে তার যোগাযোগ হয় প্রখ্যাত রসায়নবিদ বার্থেলেট র সাথে।
তারপর আয়ুর্বেদ রস শাস্ত্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রসেন্দ্রসার সংগ্রহ নামক পুঁথি অবলম্বনে প্রফুল্লচন্দ্র
বিশেষ প্রবন্ধ পাঠান বার্থেলেটকে।
উপহার স্বরূপ ফরাসি পন্ডিত বার্থেলেটও তার রচিত মধ্যযুগের রসায়ন সংক্রান্ত তিন খণ্ডের সুবৃহৎ রচনাবলী দেন যাতে মূলত সিরিয়ান ও আরবদের অবদান লিপিবদ্ধ ছিলো।
যা অধ্যয়ন করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তখন
হিন্দু রসায়নবিদ্যা সমন্ধে জানতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন এবং প্রবল উদ্যমে কাজ শুরু করেন।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেমন মাদ্রাস, কাশ্মীর, বেনারস এছাড়াও কাঠমান্ডু, তিব্বত থেকেও আসতে থাকে অসংখ্য প্রাচীন কীট ভক্ষিত রসায়ন পাণ্ডুলিপি।

আয়ুর্বেদ রসায়ন ও চরক – সুশ্রুত:

১৯১৮ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তার বক্তৃতায় বলেন রসায়ন ও গণিত হিন্দুরা আরবদের থেকে শেখেনি, বরং তারাই আরবদের শিখিয়েছে।
দশম ও একাদশ শতাব্দীর আরবীয় লেখকরা যা বিভিন্ন জায়গায় কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে খলিফ মনসুর ও খলিফ হারুন তাদের রাজত্বকালে হিন্দু পণ্ডিতদের দ্বারা চরক, সুশ্রুত ও আরও অনেক চিকিৎসা গ্রন্থ অনুবাদ করিয়েছিলেন।
এছাড়াও বিখ্যাত চরক টিকাকার চক্রপানী দত্তের
রসপর্পটিকা ব্যাবহার আয়ুর্বেদে রসায়ন চিকিৎসার এক অন্যতম উদাহরণ।

পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের আলোয় আয়ুর্বেদ রসশাস্ত্র ও
হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি:

হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের বিশিষ্ট গ্রন্থ “রসেন্দ্র চিন্তমনি” এর লেখক রামচন্দ্রের একটি বক্তব্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে আজীবন যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিলো সেটি হলো,

জ্ঞানী ব্যাক্তিদের কাছ থেকে আমি যা কিছু শুনেছি এবং বিভিন্ন শাস্ত্রে যা কিছু পড়েছি অথচ নিজে যা কিছু যাচাই করতে পারিনি তা আমি বাতিল করে দিয়েছি। অন্যদিকে আমার প্রাজ্ঞ শিক্ষকদের নির্দেশ অনুযায়ী যে সব বিষয় আমি নিজের হাতে পরীক্ষা করে দেখতে সক্ষম হয়েছি, শুধুমাত্র সেইগুলি আমি লিখেছি।
তারাই প্রকৃত শিক্ষক যারা যা শেখাচ্ছেন ত পরীক্ষা দ্বারা যাচাই করতে সক্ষম, তারাই উপযুক্ত ছাত্র যারা যা কিছু শিখছে তা করে দেখাতে পারে, এরাই প্রকৃত শিক্ষক ও ছাত্র, অন্যরা নিছকই রঙ্গ মঞ্চের অভিনেতা মাত্র”

রসেন্দ্র চিন্তমনি, রসপ্রকাশ সুধাকর, রসর্ণব ইত্যাদি আয়ুর্বেদ রস শাস্ত্রের পাশাপাশি
নেপাল রাজবাড়ীর দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি থেকে আয়ুর্বেদ রস চিকিৎসার গভীর রসায়ন তত্ত্ব নিয়ে বিভোর থাকতেন এই পোশাক আসাকে ঔদাসীন্য বিজ্ঞানী।
যিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত পারদ ভস্ম নিজেহাতে তৈরি করে গবেষণা করতেন।
শ্বেত ভস্ম যে আসলে মারকিউরাস ক্লোরাইড এবং কৃষ্ণ ভস্ম, লোহিত ভস্ম মারকিউরিক সালফাইড তা তার লেখা থেকে জানা যায়। মুসা, পুটপাক,
ধাতুর জারন, মারন, বিভিন্ন প্রকার পাতন ও ধাতুর
পুনর্জীবিতকরণ ইত্যাদি নিয়ে তার লেখা
হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি আধুনিক রসায়নে অতন্ত্য মূল্যবান দলিল।

ধাতুবিদ্যা ও ক্ষার চিকিৎসা:

খনিজ আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন ও ইস্পাতকে নির্দিষ্ট মাত্রায় শান দেওয়ার দক্ষতায় ভারতীয়দের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।
দামাস্কাসের তরোয়াল, পুরীর লোহার তৈরি বিশাল কড়ি, কুতুব মিনারের কাছে প্রায় ১৫০০ বছর পুরনো পেটা লোহার স্তম্ভ,তক্ষশিলায় সংরক্ষিত লোহার তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি, রান্নার বাসনপত্র, তলোয়ার, বল্লম ইত্যাদি অতীত শিল্পকর্মের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে।
অন্যদিকে আয়ুর্বেদে বর্ণিত রসক অর্থাৎ আকরিক ক্যালামাইন থেকে দস্তা নিষ্কাশন পদ্ধতিটি রসরত্নসমুচ্চয় এর নিখুঁত
বর্ণনা দেখে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র যথেষ্ট বিস্মিত ও আয়ুর্বেদ রসায়ন প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ হতে থাকেন।
আয়ুর্বেদে বর্ণিত পারদের অষ্টাদশ সংস্কার, স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ ইত্যাদি ভস্ম তৈরি ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাবহার, মকরধ্বজ নির্মাণ, বিশুদ্ধ ধাতু লক্ষণ, ধাতুর গলনে মুচি ব্যাবহার, কজ্জলী নির্মাণ, ভারতীয় কিমিয়াবিদ্যা, পঞ্চমহাভূত ও মৌলের
পরমাণু তত্ত্ব ইত্যাদি ছিলো তার গবেষণার বিষয়বস্তু।
এছাড়াও সুশ্রুত সংহিতায় বর্ণিত বিভিন্ন ভেষজের ভস্ম থেকে ক্ষার তৈরির নীতিমালার ব্যাবহারিক প্রয়োগ ও রসায়নগারে সেই ক্ষারের বিশ্লেষণমূলক গবেষণার পাশাপাশি সুশ্রুত মতে তীব্র ক্ষারীয় বস্তু কে লৌহ পাত্রে রাখার সর্বপ্রথম বর্ণনা যে পূর্ণরূপে বিজ্ঞানভিত্তিক সেটা যুক্তি সহ ব্যাখ্যা করেন।
সুশ্রুতে বর্ণিত ক্ষার নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন “ক্ষার ধর্মের এই বিবরণ এত সুন্দর ও বিজ্ঞানসম্মত যে আধুনিক ক্ষারধর্ম পদ্ধতির সহিত ইহার কোনও প্রভেদ দেখা যায় না”

বেঙ্গল কেমিক্যাল ও আয়ুর্বেদ ওষুধ :

একদিকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে দেশীয় শিল্পোদ্যোগ বিকাশের প্রচেষ্টা অন্যদিকে বাঙালির আর্থিক দুর্দশা, বাঙালির দীনতা, বাঙালিদের পরনির্ভরশীলতার নাগপাশ থেকে মুক্তির নিরন্তর সদিচ্ছায় মাত্র সাতশো টাকা মূলধনের ভিত্তিতে ও অগাধ আত্মবিশ্বাসে গড়ে উঠেছিলো আচার্য প্রফুললচন্দ্র রায়ের সাধের বেঙ্গল কেমিক্যাল।

যেখানে ফিনাইল, ন্যাপথলিন, ব্লিচিং পাউডার ইত্যাদির পাশাপাশি কালমেঘ সিরাপ, চার্মস, আক্যোয়া টাইকোসিস, হিমোবিন সিরাপ, কুরচি ঘনসার, বাসক সিরাপ ইত্যাদি আয়ুর্বেদ ওষুধ উৎপাদন হতে থাকে।

আজ বর্তমান প্রেক্ষাপটে আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পূর্ণাঙ্গ রূপে আধুনিক চিন্তাধারার সাথে যুগের সমান্তরাল পথে চালিত করতে অজস্র তথ্যভিত্তিক নীতিমালাকে নবরূপে
পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যাবহারিক প্রয়োগের সিদ্ধান্তদ্বারা প্রতিষ্ঠা করার যোগ্য সময় এসেছে, যা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তৎকালীন
ভাবধারা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।
গবেষণাগুলো কেবল কাগজের কালিতে সীমাবন্ধ না থেকে হাতেকলমে জেগে উঠুক রস শাস্ত্রের রসায়ন কর্মের মাধ্যমে।
পুনরায় বাংলার বুকে পারদ,গন্ধক, হরিতাল,হিঙ্গুল,তাম্র, প্রবাল, মুক্তা,দস্তা,লৌহ,স্বর্ণ প্রভৃতি ধাতুর বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ স্বগর্বে জেগে উঠুক।
বাঙালির তৈরি মকরধ্বজ, স্বর্ণ সিন্দুর, রসপর্পটিকা
আবার শ্রেষ্ঠতর শিরোপা পাক দেশে বিদেশে।
আজকের এই পুণ্যলগ্নে আশা রাখি যুগে যুগে স্মরণ হোক এই বিপ্লবী বাঙালি বিজ্ঞানীর চিন্তাধারা।
রাজ অনুগ্রহে সংরক্ষিত ও পুনর্মুদ্রিত হোক লুপ্তপ্রায় শতাধিক বাংলা ভাষায় রচিত রস চিকিৎসার অজস্র পুঁথি, পান্ডুলিপি ও গবেষণা পত্র।

লেখক আয়ুর্বেদাচার্য ডাঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ
আয়ুর্বেদ মেডিক্যাল অফিসার,মানিকচক, মালদা।([email protected])

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.